পাঁচ দিনের ব্যবধানে দু’বার এভারেস্ট জয়

প্রকাশ | ২২ মে ২০১৭, ১৩:৫৬

অনলাইন ডেস্ক

নজির গড়ার শেষ ধাপটা জোর পায়ে উঠে পড়লেন। আসলে যত তাড়াতাড়ি হাত-পায়ের কাজ মিটিয়ে ফেলা যায়, ততই জলদি মেয়েদের কাছে পৌঁছনো যাবে। মায়ের মন তো! তা বলে ১২ ঘণ্টার রাস্তা মাত্র ৯ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটে পাড়ি! তাও আবার যে সে রাস্তা নয়। সাউথ কল দিয়ে এভারেস্ট! মাত্র ১১৮ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের মধ্যে ৩৭ বছর বয়সী, দুই মেয়ের মা দু’বার এভারেস্টের মাথায়! দু’বারের ‘ডবল অ্যাসেন্ড’। দ্বিতীয় বার মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে। এমন নজির বিশ্বে আর কোনও নারীর নেই। তাও আবার এমন নারী, যিনি ছোট থেকে কখনও পাহাড় চড়েননি। ২০০০ সালে বিয়ে করে দিব্যি সংসার করছিলেন। মাথায় পাহাড় চড়ার ভূত চাপে ২০১০ সালে।

রবিবার সকাল পৌনে ৮টা নাগাদ প্রথম ভারতীয় নারী হিসেবে পঞ্চম বার এভারেস্ট জয় করলেন আনসু। না, সরি, এভারেস্টে চড়লেন। কারণ, বৌদ্ধ ধর্মের উপাসক আনসুর মতে, এভারেস্টকে ‘জয় করা’ বা এভারেস্টের ‘মাথায় পা রাখা’র মতো তকমা একজন পর্বতারোহীর কাছে চরম ধৃষ্টতা। এভারেস্ট তার কাছে ঈশ্বর। শিখরের দয়া হলে তবেই বহাল তবিয়তে তার মাথায় পৌঁছনো যায়। পঞ্চম আরোহণে শুধু দেশই নয় বিশ্বের দরবারেও আরও দু’টো রেকর্ড করে ফেললেন আদতে অসমীয়া দীপা কলিতা। প্রথম নারী হিসেবে মাত্র পাঁচ দিনে দু’বার এভারেস্টে চড়লেন তিনি। প্রথম নারী হিসেবে দুই বার ‘ডবল অ্যাসেন্ড’(এক অভিযানে দু’বার শীর্ষে ওঠা)-এর গৌরবও অর্জন করলেন। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি, আট বার এভারেস্ট জয়ের রেকর্ড রয়েছে লাকপা শেরপার দখলে।

ইন্দো তিব্বত সীমান্ত পুলিশে কর্মরত ছিলেন আনসুর বাবা, অধুনা অসমের গোহপুরের বাসিন্দা উপেন্দ্রনাথ কলিতা। কর্মসূত্রে বমডিলার কাছে দিরাংয়ে থাকার সময়ই স্থানীয় তরুণী সেঙ্গে মার প্রেমে পড়েন। বিয়ের পরে চার মেয়ে ও তিন ছেলে হয় তাদের। এক ছেলে জিতু কলিতা কার রেসিং করেন। ছোটো থেকেই মেয়ে দীপা মায়ের মতো বৌদ্ধ ধর্ম যেমন পালন করেছে, তেমনই বাবার মতো চোস্ত অসমীয়া বলতে শিখেছে। কিন্তু পর্বতারোহণ শেখার কথা তখন দূর অস্ত।

পর্যটন সংস্থা খোলা স্থানীয় যুবক সেরিং ওয়াঙ্গের সঙ্গে বমডিলায় আলাপ হয় দীপার। বিয়ের আগেই নাম বদলে দীপা হয়ে যায় আনসু। স্বামীর সঙ্গে পর্যটন সংস্থা চালানোর সময়, ২০১০ সালে পাহাড় চড়ার নেশা ধরে তার। উত্তর কাশীর নেহরু মাউন্টেনিয়াংরি ইনস্টিটিউটে প্রাথমিক পাঠ নেওয়ার পরে ‘অ্যাডভান্সড কোর্স’ করেন দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে।

২০১১ সালে প্রথম অভিযানেই এক যাত্রায় দু'বার এভারেস্ট চড়া প্রথম ভারতীয় নারী হিসেবে নজির গড়েন আনসু। ২০১৩ সালে তৃতীয় বার এভারেস্ট জয় করেন। পরের বছর অভিযানের সময় দুর্যোগে ১৬ জন পর্বতারোহী মারা যান। আনসুর এভারেস্ট অভিযান বাতিল হয়। সে বার ফেরার পথে নিখোঁজ ছন্দা গায়েনকে নিয়ে আনসু জানিয়েছিলেন, শুধু নেশা থাকলেই পাহাড় চড়া যায় না। থাকতে হয় কপাল। আর থাকতে হয় অনেক-অনেক টাকা। প্রথমবার অভিযানের সময় জমি বেচতে হয়েছিল তাদের। জানিয়েছিলেন, স্পনসরদের থেকে টাকা নিয়ে কিছু দায়িত্বও তার সঙ্গে বহন করতে হয় পর্বতারোহীদের। তাই কখনও ঝুঁকি নিয়েও শীর্ষে ওঠার শেষ চেষ্টা করেন তারা। আনসুর এবারের জোড়া অভিযানে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা। টাকা দিয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, নিপকো, নুমালিগড় শোধনাগার, টপসেম, উত্তর-পূর্ব পরিষদ।

২০১৫ সালে নেপালে ভূমিকম্পের জেরে ২২ জন পর্বতারোহী মারা যান। ফের বাতিল হয় আনসুর অভিযান। সে বারের দুর্যোগের পরে স্বামী সেরিং সাফ জানান, দুই মেয়ের মুখ চেয়ে আর কখনও বউকে এমন বিপদের মুখে ঠেলবেন না। কিন্তু ৩৭ বছর বয়সী আনসুর কথায়, “শীর্ষ আরোহণের নেশা এড়ানো যায় না। দুই মেয়েই আমার চালিকাশক্তি। ওঠার সময় লক্ষ্য থাকে, কত তাড়াতাড়ি ফের ওদের কাছে পৌঁছাতে পারব।” ২০১৬ সালে টাকার অভাবে অভিযানে যাওয়া হয়নি আনসুর।

এভারেস্টের টানে এ বছর ফের 'ডবল অ্যাসেন্ড' করার লক্ষ্যে আসেন তিনি। চার দিন আগে, ১৬ মে সকাল ৯টায় ফুরি শেরপাকে নিয়ে প্রথমবারের জয় সেরে ফেলেন তিনি। বৃহস্পতিবারে নামেন চতুর্থ বেসক্যাম্পে। আনসুর স্বামী সেরিং ওয়াঙ্গে জানান, দ্বিতীয় আরোহণ আনসু চার দিনের মধ্যেই করতে পারতেন। কিন্তু প্রথমবার নামার পরে এক দিন আনসুকে নিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের বৈঠক হয় বেস ক্যাম্পে। এবার অভিযানে দুই পর্বতারোহীর মৃত্যু হয়েছে। তাই আনসুর ক্ষেত্রে ঝুঁকি নেওয়ার আগে সব দিক যাচাই করে নেওয়া হয়। ডাক্তাররা আনসুকে ‘ফিট সার্টিফিকেট’ দেওয়ার পরে গত কাল রাত ১০টায় সাউথ কল দিয়ে আরোহণ শুরু করেন আনসু। ঠিক ছিল সময় লাগবে ১২ ঘণ্টার মতো। কিন্তু তার চেয়ে দুই ঘণ্টা কম সময়ে, ২১ মে সকালে পৌনে আটটায় কাজ সেরে ফেলেন আনসু। বিশ্বের শীর্ষে উড়িয়ে দেন চতুর্দশ দলাই লামার হাত থেকে নেওয়া ভারতের পতাকা। ২ এপ্রিল তিনিই আনসুর এবারের অভিযানের ‘ফ্ল্যাগ-অফ’ করেছিলেন গুয়াহাটিতে। দু’টি অভিযানেই আনসুর সঙ্গে ছিলেন ফুরি শেরপা।

সেরিং বলেন, “ভালবাসা, কঠোর পরিশ্রম আর জেদ আনসুকে সফল করেছে। একটা মেয়ে ৩০ বছর পার করে পর্বতারোহণ শেখা শুরু করলে তার পক্ষে এতদূর আসা কষ্টের। কারণ ততদিনে তার শরীরের বাইরের ও ভিতরের গঠন আর নমনীয় থাকে না। কিন্তু আনসু ২০১০ সালে পর্বতারোহণ শেখা শুরু করে মাত্র সাত বছরের মধ্যে অসাধ্য সাধন করল।”

মেয়ের গর্বে গর্বিত উপেন্দ্রবাবু বলেন, “সবই মানুষের ভালবাসা, ভগবানের আশীর্বাদের জোর।”

আনসুর বড় মেয়ে ১৬ বছরের পাসাং দ্রোমা আজ মায়ের জয়ের খবর পেয়ে কেঁদে ফেলে। এবারের অভিযানে, আনসু দুই মেয়ে পাসাং ও এঞ্জেলের স্কুল ‘কাজিরাঙা ইংলিশ অকাদেমি’র পতাকাও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেটিও পুঁতে এসেছেন শীর্ষে। তাই তার মেয়েদের নিয়ে গর্বের শেষ নেই স্কুলেরও।

বেলা ২টা নাগাদ স্যাটেলাইট ফোন আর ওয়াকি টকির মাধ্যমে সাউথ কলে থাকা স্ত্রীর সঙ্গে কথা হয় সেরিংয়ের। ক্লান্ত আনসু সকলকে ধন্যবাদ দেন। জানান সুস্থই আছেন। 

সেরিং বলেন, “যা চেয়েছিল অর্জন করেছ। এবার ধীরে সুস্থে নামো। সবাই অপেক্ষায় আছে।” পরে তিনি বলেন, “ওর যা স্বপ্ন ছিল তা সফল হয়েছে। আর কিছুতেই যেতে দেব না।” কিন্তু এমন কথা তো আগেও বলেছিলেন। হতাশ হেসে সেরিং বলেন, “বউরা কথা শোনে না। সেটাই তো সমস্যা।”

সূত্র: আনন্দবাজার