নাফাখুমের পথে (১ম পর্ব)

প্রকাশ | ১৫ এপ্রিল ২০১৭, ২০:৫৬ | আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৭, ২১:০৬

আমাদের দেশের মেয়েরা সাধারণত কোথাও বেড়াতে গেলে তার পরিবারের কারো সাথেই বেড়াতে যায়। পরিবারের কেউ যদি তাকে বেড়াতে না নিয়ে যায়, তবে তার আর বেড়ানো হয়ে উঠে না। কোথাও ঘুরে বেড়াতে প্রথমেই দরকার সমমনা বন্ধু। তেমন বন্ধু থাকলেও রক্ষণশীল পরিবারগুলোতে দেখা যায় মেয়েরা বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাবার অনুমতি পায় না। আবার বাস্তবতা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণেও মেয়েরা একা কোথাও ঘুরে আসার সাহস পায় না। চার দেয়ালের ভেতরেই তার ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছেগুলো বন্দী হয়ে যায়। বর্তমানে অনেক ট্রাভেলারস গ্রুপ/সংগঠন গড়ে উঠায় এখন মেয়েরা একাই নিরাপদে দেশে ও বিদেশে ঘুরে বেড়াতে পারছে। তেমনি দুটো সংগঠন মাস্টার ট্রাভেলারস ও ট্রাভেলারস নেস্ট। এই দুটি সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে আমাদের নাফাখুম অভিযান বেশ ভালোভাবেই সম্পন্ন হলো। বিভিন্ন বয়সী ৯ জন নারী নিয়ে ছিল এই অভিযান। আজ প্রথম পর্বে শুধু এই অভিযানে আমার নতুন বন্ধুদের গল্প করবো। 

আমাদের দলের সবচেয়ে অল্প বয়সী ছিল লিসা। ওর বয়স মাত্র ১৪, পড়ে ক্লাস এইটে। লিসা এত অল্প বয়সে এত দক্ষতার সাথে পাহাড়ে একটানা ট্র্যাক করে এলো, এটা সত্যি প্রশংসনীয়। নাগরিক জীবনে টিনএজারদের মধ্যে প্রকৃতির চেয়ে প্রযুক্তির সাথে সখ্যতা বেশি। কিন্তু লিসার বেলায় দেখা গেল, সে প্রকৃতির সাথেও খুব সহজে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। আর প্রকৃতির সংস্পর্শে এসে দলের বাকি সবার বয়সও কমে হয়ে গেলো ১৪। সাথে লিসার উচ্ছ্বল, উজ্জ্বল বোন লিরাও ছিল। লিরা ও লিসার ‘টম এন্ড জেরি’ খুনসুটি অভিযানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল।

আমাদের দলে আরো ছিল মৃদু ও নদী। সাথে ছিলো ওদের মা। তিনিও বেশ ভালোভাবেই পাহাড়ে ট্র্যাকিং করলেন, এতটুকুও ক্লান্ত হন নি। দলের সবার সাথে তারও বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল। দলের নেতৃত্বে ছিলেন রিমন ভাই ও পিয়া আপু। আমার দেখা অত্যন্ত সাহসী ও কঠিন একজন নারী পিয়া আপু। তিনি বলেন, "পাহাড়কে দেখেছো, কেমন শক্ত। মনটাকে এরকম শক্ত রাখতে হবে। অল্পতে দুর্বল হয়ে গেলে চলবে না"।

আমাদের দলের সবচেয়ে বয়সী নারী ছিলেন জেসমিন আলী আপা। ৬০ বছর, এটি তার ক্ষেত্রে একটি সংখ্যা মাত্র। কিন্তু মনের দিক দিয়ে তিনিও ছিলেন লিসার মত কিশোরী। সাদামনের, অত্যন্ত সহজ সরল, চিরসবুজ, চিরনবীন, সদা প্রফুল্ল, হাস্যজ্জ্বোল একজন মানুষ এই জেসমিন আপা। অত্যন্ত ইন্সপায়ারিং, এ কয়দিনে আমি তাকে একবারও রাগ করতে বা কারো উপর বিরক্ত হতে দেখি নি। বরং বিরক্ত হবার মত কোন পরিস্থিতি কখনো সৃষ্টি হলেও তিনি বিন্দুমাত্র অভিযোগ না করে তার সাথে ঝটপট মানিয়ে নিতেন। প্রচণ্ড ধৈর্যশীল একজন নারী। পাহাড়ের রুক্ষপথ মানুষকে যে স্থির ও ধৈর্যশীল করে, জেসমিন আপা তার প্রমাণ।

এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে যে অল্প কজন বাংলাদেশী নারী গিয়েছেন, তাদের মধ্যে জেসমিন আপাও একজন। বেস ক্যাম্পের কঠিন অভিজ্ঞতাগুলো তার মুখ থেকে শুনে রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম। সেই বেস ক্যাম্পে তিনি ও তার দল প্রথম শাড়ি পরেন, যা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এবং তিনি এই নাফাখুমেও আমাদের জন্য একাই লাল-সবুজ রঙের শাড়ি বহন করে নিয়ে এসেছেন। আমরাও পাহাড়ের উপরে পতাকার রঙে সেজে খুব খুশি হয়েছি।

সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম পাহাড়ে জেসমিন আপার কিছু ইয়োগা দেখে। শাড়ি পরে যে কোন শারীরিক কসরত করা যায়, এটা আমি কোনদিন ভাবতেই পারি নি। আর তিনি অবলীলায় তা করে দেখালেন, যা দেখে আমি সত্যিই খুব মুগ্ধ। 

এমনি দারুণ সব নারীদের সাথে অভিযানে অংশ নিতে পেরে আমি সত্যিই খুব আনন্দিত। হাসি গান আর উচ্ছ্বলতায় আমার আয়ু বাড়িয়ে দেবার জন্য তাদের প্রতি রইলো অনেক ভালোবাসা। 

(চলবে...)

লেখক: শিক্ষক