তথ্যপ্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে টানা ৪র্থ বার পুরস্কার অর্জন বাংলাদেশের

প্রকাশ : ১৫ জুন ২০১৭, ১৬:৪০

জাগরণীয়া ডেস্ক

বিগত কয়েক বছরের ন্যায় এ বছরও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার “ওয়ার্ল্ড সামিট অন ইনফরমেশন সোসাইটি (ডব্লিউএসআইএস) পুরস্কার-২০১৭” অর্জন করেছে বাংলাদেশ।

জাতিসংঘের আইসিটি সংক্রান্ত বিশেষায়িত সংস্থা আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদর দপ্তর জেনেভায় ১৩ জুন ২০১৭ এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের হাতে ডব্লিউএসআইএস পুরস্কার-২০১৭ তুলে দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের পক্ষে এই পুরস্কার গ্রহণ করেন একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) কবির বিন আনোয়ার।

এ সময় বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম, এটুআই প্রোগ্রামের পলিসি অ্যাডভাইজর আনীর চৌধুরী, অধ্যাপক ড. খোন্দকার সিদ্দিক-ই-রব্বানী, ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট স্পেশালিস্ট মানিক মাহমুদ, উদ্ভাবক ভাস্কর ভট্টাচার্য, মো: খোরশেদ আলম খান, মো: সাখাওয়াতুল ইসলাম এবং তানভীর সাদিক উপস্থিত ছিলেন।

এ বছর মোট চারটি মৌলিক উদ্ভাবনী উদ্যোগের জন্য এটুআই ‘ডব্লিউএসআইএস’ সম্মাননা পেয়েছে। এটুআই প্রোগ্রামের “মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক” উদ্যোগটি চূড়ান্তভাবে ১ম স্থান অধিকার করেছে এবং ৩টি উদ্যোগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিমেডিসিন প্রজেক্ট, পাবলিক সার্ভিস ইনোভেশনে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার এবং ই-নথি রানারআপ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। এ উদ্যোগসমূহ হলো-

১. মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক
দৃষ্টি-প্রতিবন্ধীসহ সকল শিক্ষার্থীর জন্য ১ম থেকে ১০ম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক এটুআই প্রোগ্রামের সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ডের আওতায় উদ্ভাবক ভাস্কর ভট্টাচার্য প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সকল বই ও নবম-দশম শ্রেণির মানবিক বিভাগের পাঠ্যবই “ডেইজি মাল্টিমিডিয়া বই” আকারে দৃষ্টি-প্রতিবন্ধীসহ সকল শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীসহ দেশের প্রায় ৩০ ভাগ নিরক্ষর জনগোষ্ঠী অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস এবং কম্পিউটার ব্যবহার করে সহজেই পাঠের বিষয়বস্তু শুনে ও পড়ে বুঝতে পারবে।

ইউনিকোডে প্রণীত এই বইগুলো ডিজিটাল ভার্সনে থাকায় এর টেক্সট সহজে ব্যবহার করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের কনটেন্ট তৈরি করা যাবে এবং সহজে ব্রেইলে রূপান্তর সম্ভব হবে। এই অনুষ্ঠানে “মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক” অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যা সাউথ সাউথ সম্পর্ক জোরদারের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

২. টেলিমেডিসিন প্রজেক্ট
এটুআই প্রোগ্রামের সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ডের সহায়তায় গ্রামীণ পর্যায়ে উন্নতমানের স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ফিজিক্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ এই প্রকল্প শুরু করেছে। এর মাধ্যমে গ্রামের রোগীরা সহজেই শহরের ডাক্তারদের কাছ থেকে চিকিৎসা নিতে পারছেন। এছাড়া অধ্যাপক ড. খোন্দকার সিদ্দিক-ই-রব্বানীর নেতৃত্বে টেলিমেডিসিনের জন্য স্টেথোস্কোপ, ইসিজি ইত্যাদি যন্ত্রের ডিজিটাল রূপ এবং প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার উদ্ভাবন করা হয়েছে যার মাধ্যমে রোগীরা সহজেই ডিজিটাল পদ্ধতিতে কিছু বেসিক টেস্ট করে রিপোর্ট অনলাইনে ডাক্তারকে প্রেরন করতে পারছেন এবং ডাক্তাররা দ্রুততম সময়ে রোগ নির্ণয় করে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন। বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় পাইলট আকারে টেলিমেডিসিন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে এবং অচিরেই দেশের সর্বত্র এই সেবা ছড়িয়ে দেয়া হবে। 

৩. পাবলিক সার্ভিস ইনোভেশনে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার
পাবলিক সার্ভিস এর ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেইসবুক ব্যবহার এর মাধ্যমে নাগরিক সেবায় উদ্ভাবনী চর্চায় এক নতুন মাইলফলক তৈরী করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি সকল অফিসে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার চলমান রয়েছে যার মাধ্যমে  দ্রুততম সময়ে নাগরিকগণের সমস্যা সমাধানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। নাগরিক সেবায় উদ্ভাবনী আইডিয়া, উদ্ভাবনী উদ্যোগ  বাস্তবায়ন অভিজ্ঞতা, উদ্ভাবনী উদ্যোগ রেপ্লিকেশন বাস্তবায়ন অভিজ্ঞতা, উত্তম চর্চা, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নাগরিক সমস্যার সমাধানের এই উদ্যোগের মাধ্যমে জনপ্রশাসনে একটি জনবান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই উদ্যোগের সফল কয়েকটি দৃষ্টান্ত হলো জেলা প্রশাসনের নেতৃতে ‘সবুজ ত্রিশাল’, ‘লৌহজং নদী সংস্কার অভিযান’ ‘বরিশাল জেল খাল পরিচ্ছন্নতা অভিযান’ ইত্যাদি।  

৪. ই-নথি
লাল ফিতার দৌরাত্ব কমানোর লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত হাজারো সরকারি দপ্তরের নথি ব্যবস্থাপনা এবং দপ্তর থেকে প্রদেয় সেবাসমুহকে জনগনের হাতের মুঠোয় পৌঁছে দিতে ‘ই-নথি’র যাত্রা শুরু হয়। সরকারি অফিসে ফাইল নিষ্পত্তি সহজীকরণ এবং সেবা নিশ্চিত করার জন্য ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে অনলাইনে নথি ও ফাইল নিষ্পত্তির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আগামী ২০১৮ সালের মধ্যে উপজেলা হতে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সকল সরকারি অফিসে ‘ই-নথি’ বাস্তবায়ন করা হবে। নথি বা ই-ফাইল হলো প্রচলিত নথি ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে ইলেক্টনিক পদ্ধতিতে নথি নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া। এ পদ্ধতিতে প্রাপ্ত পত্র, নথিতে উত্থাপিত নোট, গৃহীত সিদ্ধান্ত, পত্রজারি, নথির অবস্থান, রেজিস্টার, বিভিন্ন রেফারেন্সের সকল তথ্য সিস্টেমে লিপিবদ্ধ থাকবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য উপাত্ত পর্যবেক্ষণ করাও সম্ভব হবে। ই-ফাইলিং পদ্ধতিতে ৭ দিন বা দ্রুততম সময়ে ফাইলের নিষ্পত্তি করা সম্ভব যা জনগণের টিসিভি (সময়, খরচ, যাতায়াত) কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।  

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ডব্লিউএসআইএস-২০১৭ এর সম্মাননা গ্রহণ করার পর এক প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) ও একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রাম এর প্রকল্প পরিচালক কবির বিন আনোয়ার জানান, এই অর্জন সমগ্র জাতির। এ প্রসঙ্গে তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ এর রূপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়’কে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি আরো বলেন, তাদের অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনায় ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তব রূপ লাভ করেছে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। আইটিইউ আয়োজিত ডব্লিউএসআইএস পুরস্কার-২০১৭ প্রতিযোগিতায় ১৭৭ টি দেশের মধ্যে চতুর্থবারের মত বিজয় লাভ করায় মাঠ প্রশাসনসহ সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি এবং এটুআই’এর সকল সদস্যদের অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। 

অন্যদিকে, ওয়ার্ল্ড সামিট অন ইনফরমেশন সোসাইটি (ডব্লিউএসআইএস) ফোরাম-২০১৭ আয়োজিত এক কর্মশালায় আইটিইউ টুলকিট ব্যবহার করে উদ্ভাবনের ইকোসিস্টেম মজবুত করার লক্ষ্যে আইটিইউ এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়েছে। এটুআই প্রোগ্রাম এই টুলকিট প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশে পাইলটিং করবে। গত কয়েক বছরে উদ্ভাবনী সংস্কৃতি সৃষ্টিতে বাংলাদেশ ঈর্ষনীয় সাফল্য অর্জন করেছে তার পরের ধাপ অর্জনে এই টুলকিট বিশেষ ভূমিকা রাখবে। আইটিইউ এর এই টুলকিট ব্যবহার করে গবেষণার মাধ্যমে ডিজিটাল ইনোভেশন ইকোসিস্টেম উন্নয়ন এবং বিভিন্ন অভিজ্ঞতা আইটিইউ সদস্যদের প্রদানের মধ্য দিয়ে আইটিইউ’র ইনোভেশন প্ল্যাটফর্ম এবং টুলকিটকে শক্তিশালী করা হবে। 

মাননীয় মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, “আমরা বাংলাদেশের পাবলিক সেক্টরে সফলভাবে একটি মজবুত উদ্ভাবন চর্চার উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম এবং প্রাইভেট সেক্টরে এই উদ্ভাবন চর্চা ইতোমধ্যে আমরা শুরু করে দিয়েছি। আমরা সঠিক সময়ে আইটিইউ-এর এই টুলকিট হাতে পাচ্ছি। আশা করি এটি আমাদের উন্নয়নের উল্লম্ফনকে আরো ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি সাউথ সাউথ কোঅপারেশনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে”।  

উল্লেখ্য, ওয়ার্ল্ড সামিট অন দ্য ইনফরমেশন সোসাইটি (WSIS) পুরস্কার তথ্য-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে উদ্যোগ ও বাস্তবায়নের বড় ধরণের স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হয়। এটুআই প্রোগ্রাম কর্তৃক জনগণের দোরগোড়ায় সেবা প্রদানের লক্ষ্যে বাস্তবায়িত অসংখ্য উদ্ভাবনী উদ্যোগের মধ্যে বিগত ৩ বছর যথাক্রমে ২০১৪ সালে ডিজিটাল সেন্টার, ২০১৫ সালে জাতীয় তথ্য বাতায়ন এবং ২০১৬ সালে সেবা পদ্ধতি সহজিকরণ-এসপিএস, পরিবেশ অধিদপ্তরের অনলাইন ছাড়পত্র, শিক্ষক বাতায়ন এবং কৃষকের জানালা উদ্যোগসমূহ ওয়ার্ল্ড সামিট অন ইনফরমেশন সোসাইটি (ডাব্লিউএসআইএস অ্যাওয়ার্ড) পুরস্কার অর্জন করেছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত