সবকিছু নষ্ট করার অধিকার আমাদের নেই

প্রকাশ : ২৩ জুন ২০১৭, ০১:৫৬

ঈর্ষা, হিংসা অথবা রেষারেষির বিষয়টা এত ভয়াবহ যে যুগ যুগ ধরে এগুলো নিয়ে অনেক গল্প, কাহিনি, উপকথা, লেখা হয়েছে, ভবিষ্যতে আরো হবে। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা আসলেই ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী তারা ঈর্ষার শিকার হন। কোনো দেশ যদি সমৃদ্ধশালী হয় তাহলে সেই লোভে বড় বড় পরাশক্তিগুলো ছলে বলে কৌশলে তা দখলে রাখতে চায়। যেমন ইরাককে দখল করার জন্য বুশকে কত রকম ছলনার আশ্রয় নিতে হয়েছে। সৃষ্টির সাথে সাথে ঈর্ষার ব্যাপারটিও চলে আসছে। মানুষ যেমন ঈর্ষার শিকার হয় তেমনি একটি প্রাকৃতিক সম্পদে সম্ভাবনাময় দেশও ঈর্ষার শিকার হতে পারে।

ছোটবেলা আমরা কিশোরদের জন্য প্রকাশিত ম্যাগাজিন ধান শালিখের দেশ পড়তাম। তখন মনে হয় অনেকদিন ধরে ভিয়েতনামে যুদ্ধ চলছিল। ভিয়েতনামিরা একটি ছবিসহ উক্তি দিয়েছিল। সেটা হল- জান দেব তবু দেশ দেব না: ভিয়েতনাম। এই বাক্যটি বড় করে লেখা থাকতো আর মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা একে ঘুরিয়ে বলতাম: জান দেব তবু দেশ দেব না: বাংলাদেশ। তখন ভাষার তাৎপর্য না বুঝলেও বুঝতাম কোনো কিছুর বিনিময়েই বাংলাদেশের উপর কারো অধিকার দেওয়া যায় না। জান দিয়ে দেওয়া যায় কিন্তু বাংলাদেশ দেওয়া যায় না। এটাই আমাদের বাবা মা এবং খালা চাচারা বুঝিয়েছিলেন। বুঝিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ডাকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ করতে হবে। এমন কি আব্বা ঐ শিশুবয়সেই আমাদের একধরনের গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং দিয়েছিলেন। এটি হল আমাদের মত বয়সের প্রতিটি মানুষের আত্মরক্ষার এবং দেশরক্ষার প্রাথমিক মূলমন্ত্র।

ভারত আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র, বলতে গেলে তিনদিকেই আমরা ভারত কর্তৃক পরিবেষ্টিত। ভৌগোলিক এ বিষয়টি দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে অতীতে মুক্তিযুদ্ধে তাদের সহযোগিতা আমাদের মুক্তিসংগ্রামকে এগিয়ে নিয়েছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন অসাধারণ দূরদর্শী এবং নিজ দেশের জন্য বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ। তার সাথে আমাদের বঙ্গবন্ধুর ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধার সম্পর্ক যে কারণে ইন্দিরা গান্ধী বালাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন। আমাদের বঙ্গবন্ধুও নেই আর ইন্ডিয়ার তৎকালীন স্নেহকাতর ইন্দিরা গান্ধীও নেই, সেই অপরিসীম ভালবাসার সম্পর্ক হয়তো সেইভাবে নেই। এখন যা আছে তা হল বৃহত্তর শক্তিশালি দেশগুলোর অর্থনীতিকে আরো মজবুত করার জন্য অন্যের ঘাড়ে কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার অপচেষ্টা। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এসব বিষয় আছে। ভারতকেও আমরা সুবিধা কম দিচ্ছি না। বড় মাছ ছোট মাছগুলিকে খেয়ে ফেলে এটাই নিয়ম। কিন্তু তারপরেও আমাদেরকে নিজেদের বুদ্ধি কৌশলের মাধ্যমে আত্মরক্ষা করতে হবে। তা জনগণকে সাথে নিয়েই করলে ভাল হবে। আমাদের ম্যাপ বা মানচিত্র হল আমাদের সম্পদ। একে খুব ভাল করে চিনতে হবে। এর প্রতিটি ইঞ্চি আমাদের রক্ত দিয়ে কেনা। এই ভূমির সার্বভৌমত্ব, নিজস্ব সংস্কৃতি, এর সুস্থিতি রক্ষায় বাঙালি এবং বাঙলা ভাষাকে বারবার রুখে দাঁড়াতে হয়েছে। সব কিছুই আমাদের অমূল্য সম্পদ। এর ধান, পাট, মাটি, পানি, মাছ, মধু, বিচিত্র পাখপাখালি বন বনানী, জীববৈচিত্র, গ্যাসসহ সব কিছুই আমাদের সম্পদ। 

এদেশের এক কোণে আছে আমাদের বিশাল বনজ সম্পদ। পৃথিবীতে এই সুন্দরবন সবচেয়ে সেরা। সুন্দরবনের জন্য বাংলাদেশ বিখ্যাত। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য যে বাংলাদেশে এখন আর সেরা কিছু নেই, অমূল্য প্রাকৃতিক সব সম্পদই হারাতে বসেছে। এদেশের বালাম চাউল এখন আর এদেশের মানুষ দেখতে পায় না। শীতলক্ষ্যার পানি যা দিয়ে এক সময় কলকাতায় শিশুদের জন্য গ্রাইপ ওয়াটার প্রস্তুত করা হতো। এদেশের রেশম শিল্পও বিলুপ্তির পথে। মসলিনও বিলুপ্ত। জামদানি নিয়ে অনেক রকম ষড়যন্ত্র হয়েছে কিন্তু এখানের নদীর পানির বিশেষত্বের কারণে অন্যরা একে পুরো গ্রাস করতে পারেনি। তাই এদেশের জনগণ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতায় এই শিল্পটি বেঁচে আছে। 

সুন্দরবন আমাদের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ। এর রয়েল বেঙ্গল টাইগার, আমাদের ইলিশ, সুন্দরবনের কাঠ, এর মধু, এসব কিছুকে আমরা ভালবাসি। আমাদের নদীনালা খালবিল আমাদের চিরচেনা আলো বাতাস যা সবুজ সুন্দর শ্যামলিমার কারণে সমৃদ্ধ সব কিছুকে ভালবাসি। ভালবাসা অন্যায় নয়। দেশকে ভালবাসাই বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা। আমরা বাংলাদেশকে ভালবাসি। আমাদের ঘরে ঘরে আছে মুক্তিযোদ্ধাদের বুকের রক্তের ঋণ। সবচেয়ে বড় কথা হল আমাদের বঙ্গবন্ধু শিখিয়েছেন ভালবাসার জন্য কেমন করে লড়াই করতে হয়। এখন আমাদের প্রাণপ্রিয় বঙ্গবন্ধুর প্রাণপ্রিয় কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই আমাদের সকল ভালবাসার মূলশক্তি। তিনি এ দেশকে ভালবাসেন বলেই বাংলাদেশের এত রকম অভূতপূর্ব উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। 

বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য ডিজিটাল বাংলাদেশের তরুণেরা স্বপ্ন দেখছে। আমরা ঘরে বসে এখন সুন্দরবন দেখতে পাই। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের সাফল্যের জয়গান শুনতে পাই। এমনকি বারাক ওবামা পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বে রোলমডেল। 

খেলাধুলার দিক থেকেও আমরা অনেক এগিয়ে আছি। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এ ব্যাপারে খেলোয়ারদের দিকে নিজে বিশেষভাবে নজর দেন, খেয়াল রাখেন। আমাদের খেলা এখন বিশ্বজোড়া সম্মান বয়ে এনেছে। তিনি খেলোয়ারদের উজ্জীবিত করেন বলেই খেলায় আজ বাংলাদেশ সেরা। বিভিন্ন সময়ে ক্রিকেট খেলায় জিতে গেলে আমরা বলি রয়েল বেঙ্গল টাইগার অব সুন্দরবন। বাংলাদেশ বাঘের দেশ। বাংলাদেশের জাতীয় পশু বাংলাদেশের সোনার ছেলেদের বীরত্বের প্রতীক এই রয়েল বেঙ্গল টাইগার। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের প্রিয় মানুষ। আমি বিশ্বাস করি, তিনি অবশ্যই বাংলার রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি সুন্দরবনের একটি পাতার গায়েও আগুনের আঁচ লাগতে দেবেন না। তিনি তার দেশপ্রেম দিয়ে আমাদের ঐতিহ্য আমাদের সম্পদ রক্ষা করবেন। 

আমাদের দেশে এখন প্রধান সক্রিয় বিরোধী দল নেই। এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্যেও একটু সমস্যার সৃষ্টি করেছে। একটি সুন্দর সার্বভৌম দেশের উপর বিভিন্ন রকম আগ্রাসনের সূচনা হতে পারে। এই সময় সমালোচনা এবং বিরোধিতার জন্য শক্তিশালি বিরোধিতা না করলে দেশের প্রধানের পক্ষে দেশের সব স্বার্থ একা রক্ষার দায়িত্ব পালন সম্ভব নাও হতে পারে। শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হতো। প্রধানমন্ত্রী হয়তো চান একটি শক্তিশালি বিরোধীদল গড়ে উঠুক তাই তিনি হাস্য রসিকতা করে বলেছিলেন রামপালে এটা করতে না দিলে সবাইকে হ্যারিকেন জ্বালাতে হবে। বোঝা যাচ্ছে না কী করবো কিন্তু হ্যারিকেন না হয় আবার রেডি রাখবো কিন্তু সুন্দরবনের একটি পাতা যদি বিদ্যুতের বিনিময় মূল্যে ঝরে পড়ে তা তো মেনে নিতে পারবো না। ভবিষ্যতে আমরা থাকবো না বলে নিজেদের সবকিছু নষ্ট করার অধিকার আমাদের নেই।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত