সবাই ওদেরকে ‘পতিতা’ বলে...

প্রকাশ | ১৮ মার্চ ২০১৭, ০০:০৯

প্রতিনিয়ত অস্তিত্বের সংগ্রামে টিকে থাকতে হয় ওদের। হাজারো রকম সমস্যার আবর্তে ওদের জীবন। জীবন তো নয়, এ যেন নির্মম বাস্তবতার সঙ্গে মৃত্যু অবধি ধারাবাহিক সংগ্রামের অসমাপ্ত কাহিনী।
সবাই ওদেরকে 'পতিতা' বলে। সবাইকেই কেন দোষটা দিচ্ছি, অভিধানেও শব্দটি রয়েছে--বহাল তবিয়তে। কিন্তু হাজারো অভিধান খুঁজে ওই শব্দটির কোনো পুরুষবাচক প্রতিশব্দ পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ পুরুষেরা 'পতিত' এ জাতীয় কোনো শব্দ অভিধানে পাওয়া যাবে না। কারণ অভিধান প্রণেতা পুরুষ।

পতিতাদের জীবনপ্রণালী নিয়ে লেখার মত অতটা জ্ঞান, বুদ্ধি আমার নেই। একইসাথে তাদের নিয়ে লড়াই করার যে সাহস, যোগ্যতা, মনোবল, শক্তি সেটাও নেই। ভোগবাদী সমাজে ভোগের বস্তু আমরা সবাই। কোনো না কোনো ভাবে, বুঝে না বুঝে। আর লিখেই বা কী হবে? আসবে কি এই 'পতিতা' নামক নারীদের মুক্তি? পাবে কি তারা সামাজিক অবক্ষয় থেকে মুক্তি? পারবে কি এই ভোগবাদীদের মুখে থুথু ফেলে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে? কোনো রাজনৈতিক সংগঠন/পার্টি আছে কি তাদের জীবনপ্রণালী জানবেন/বুঝবেন? তাদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলবেন? 

আর হ্যাঁ, আমার লেখা দেখে অনেকেই মনে করবেন, তুমি কি জানো/বুঝো? পতিতাদের নিয়ে যথেষ্ট আন্দোলন হয়েছে, তাদেরকে আমরা প্রতিষ্ঠিত করেছি, বৈধতা দিয়েছি। তাদেরকে 'পতিতা' থেকে যৌনকর্মী নাম দিয়েছি। বাহ্, চমৎকার। এর চেয়ে উপহাস আর হয় না। এই মানুষগুলো কেন পতিতাগিরি করেন, কেন এই অমানবিক পেশাকে বেছে নিয়েছে, সেটার খোঁজ না নিয়ে উল্টো ওই পথেই বৈধতা! তাদেরকে বের করে আনতে হবে এই নোংরা জীবনপ্রণালী থেকে। তাদেরকে অন্য সকল মানুষের মতো বাঁচার অধিকার দিতে হবে। এটা সমাজের দায়িত্ব, রাষ্ট্রের দায়িত্ব। 

কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ভোগবাদী, পুরুষশাসিত সমাজ কি আমাদের? সকল শ্রেণিপেশা মানুষের?

এই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় লাঞ্ছিত এবং অমানবিক জীবন-যাপন করা, পতিতাবৃত্তি করা নারীরা কি করবে তা আমরা না জানলেও ধারণা করতে পারি। তাদের বাইরে কোথাও কেউ কাজ দেবে না, প্রতিনিয়ত অপমান, অপদস্তের শিকার হতে হবে। 

আপনারা জেনে থাকবেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একজন নারী 'পতিতালয়' থেকে পালিয়ে এসে আদালতের কাছে আশ্রয় চেয়েছিল। আদালত তাকে আশ্রয় দেয়নি। ঐ মেয়েটিকে একজন চুলের ঝুটি ধরে আদালত পাড়া থেকে বের করে দেয়। আর ওই মেয়েটির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। নির্মমতাটা টের পাচ্ছেন?

পতিতালয় নিয়ে তৈরি একটি ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম। সেখানে একজন পতিতা তার জীবনপ্রণালী অকপটে বলেছিলেন। 'আমাদের তো কেউ কাজ দেয় না, পল্লীর বাইরে কোনো কাজের জন্য বের হলেও অশালীন আচরণের শিকার হতে হয়, এতোটাই কটুক্তি করে যে বেঁচে থাকা সম্ভব না। আমাদের এই কাজ ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব না'। বুঝতে পারছেন হাহাকারটা?

এই পুঁজিবাদী, ভোগবাদী সমাজের ভদ্রলোকরাই পতিতালয়ে গিয়ে পতিত হয়ে আসে, তারাই আবার সমাজকে অসামাজিক থেকে সামাজিক করতে চায়, হাস্যকর। এই নামধারীরা আবার পতিতা পেশাকে বৈধতা দেবার জন্য গোলটেবিল বৈঠকও করেন। ভাবতে পারেন সামাজিক অবক্ষয়টা? সত্যিই বলছি, এই ঘটনাগুলো যখন শুনি, দেখি, জানি, বুঝি, তখন ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নের সম্মুখীন করি। যুদ্ধের সময় পাকসেনাদের কবল থেকে হাজার হাজার মা-বোনকে রক্ষা করেছিল মুক্তিসেনারা। সেই স্বাধীনদেশে পতিতালয় বৈধ! কিভাবে সম্ভব! কতটা অমানবিক!

এই ভদ্র নামধারীরা কখনোই এই পেশার সাথে জড়িতদের শাস্তি দাবি করে না; পতিতালয়ে লাঞ্ছিতদের, অমানবিক জীবনযাপন করাদের পুনর্বাসন করার দাবি তুলে না। কারণ ওই একটাই: তারাও ওই পাড়ায় যান, খাবলে ধরেন, কামড়ে ধরেন, পৈশাচিক আচরণ করেন, পুরুষত্ব ফলান।

ওরা পতিতা। টাকার বিনিময়ে শরীর ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া ওদের কাজ। যেভাবেই হোক, যেখান থেকেই হোক। কিন্তু ওরা সৎ। কেননা, টাকা নিয়েছে কিন্তু দেহ দেয়নি, এমন কথা আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি। কিন্তু ঠিক বিপরীত ঘটেছে পুরুষদের বেলায়, তারা একজন বা দুজনের জন্য চুক্তি করে নিয়ে গিয়ে বিশ/ত্রিশ জন পুরুষ মিলে গণধর্ষণ করে টাকার পরিবর্তে মারপিট করে তাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয় মাঝে মাঝেই শোনা যায়, পাটের ক্ষেতে বা আখের ক্ষেতে ওদের বিবস্ত্র লাশ দেখতে পাওয়া যায়। মজা লুটে, পৈশাচিক আনন্দ করে ওদের দেহ নিয়ে, গণধর্ষণ করে, খুন করে, বিবস্ত্র অবস্থায় লাশ ফেলে রেখে সে দৃশ্য উপভোগ করে। এই হলো সমাজের চিত্র, পুরুষতন্ত্রের চিত্র। 

পতিতাবৃত্তির ইতিহাস খুঁজতে আমরা যদি একটু পিছনে যাই দেখতে পাব, সমাজের আদিম অবস্থায় আজকের মতো পরিবার প্রথা ছিল না। মানুষ দলবদ্ধভাবে বাস করত। একেকটা গোষ্ঠির মধ্যে অবাধ যৌন মিলন চলত। সেখানে প্রত্যেক পুরুষেরই প্রত্যেক নারীর উপর সমান অধিকার ছিল। আবার, প্রত্যেক নারীরও প্রত্যেক পুরুষের উপর সমান অধিকার ছিল। যাই হোক, তারপরেই মানুষ পদার্পণ করেছিল যৌথ বিবাহের যুগে। বাকোফোন এ বিষয়ে সর্বপ্রথম গুরুত্ব দিয়ে গবেষণা করেন এবং ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যের মধ্যে থেকে এর প্রমাণও হাজির করেছেন। যৌথ পরিবার ব্যবস্থায় নারীদের প্রাধান্য ছিল। মানব পরিবারের ক্রমবিকাশের পরবর্তীস্তরে আর যৌথ পরিবার প্রথা টিকল না। যৌন সম্পর্কের আওতা থেকে প্রথমে নিকটতম লোকদের তারপর একটু দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের বাদ দিতে থাকায় যৌথ পরিবার প্রথা লোপ পায়। অবশেষে একজোড়া নর-নারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল পরিবার। 

বিশ্বের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠিসমূহের পারিবারিক সংস্কৃতি বিশ্লেষণ করলে এখনও এসব তথ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। বলা যায়, একবিবাহ প্রথা প্রবর্তনের পিছনে নিয়ামক হিসেবে প্রধান ভূমিকা ছিল ব্যক্তিগত সম্পত্তির আবির্ভাব। পরিবর্তিত উৎপাদন ব্যবস্থার দ্বারা সৃষ্ট অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে অর্থাৎ সম্পত্তির উপর যৌথ অধিকারের স্থলে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলেই একবিবাহমূলক পরিবার প্রথার উদ্ভব হয়েছে। সুতরাং অবাধ যৌন মিলনের যুগে এবং যৌথ পরিবারের যুগে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো লিঙ্গবৈষম্য ছিল না। লিঙ্গ বৈষম্য শুরু হয়েছে পুরুষেরা যখন থেকে একচেটিয়া সম্পত্তির মালিক হয়েছে এবং তখন থেকেই একবিবাহমূলক পরিবার প্রথার প্রচলনও ঘটেছে। উহাই ছিল নারীজাতির ঐতিহাসিক মহাপরাজয়। সে সময় থেকেই ঘর-সংসারের কাজকে আর সামাজিক কাজ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। সাংসারিক কাজকর্মগুলো তখন হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তিগত বিষয়। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করলেও তা মূল্যায়িত হয় না। স্ত্রী হয়ে দাঁড়ায় পারিবারিক দাসী, বঞ্চিত হয় ধনসম্পদের মালিকানা থেকে। ঠিক ওই সময়কালীন থেকেই মেয়েদের নামানো হয়েছে বেশ্যাবৃত্তিতে। যা সম্পূর্ণভাবে পুরুষ আধিপত্যের সৃষ্টি। যে পরাজয়ের গ্লানি এই পুঁজিবাদী সমাজে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।

এই অমানবিক পেশা থেকে নিজেদের মুক্তির ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হবে, পথটা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। সমাজের সকল বৈষম্য থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যারা বৈষম্যের শিকার হয় তাদেরই লড়তে হবে। সেই হিসেবে পতিতাদেরই লড়াইটা করতে হবে। শুরুটা তাদেরই করতে হবে। 

তোমাদের উদ্দেশ্যে বলছি, অন্যেরা তোমাদের যতই ঘৃণা করুক, প্রকৃতপক্ষে তোমরা ঘৃণিত নয়। যৌনকর্ম হবে তোমাদের অনুভূতিকে তৃপ্ত রাখার জন্যে, ভালোবাসার জন্যে, ভালোবাসার মানুষের সাথে। টাকার বিনিময়ে শরীর দেওয়া মানেই দাসত্ব। এটা উপলব্ধি করতে হবে। 

পতিতালয় না থাকলে পুরুষদের মানসিক তৃপ্তি আসে না। পতিতাবৃত্তি পুরুষশাসিত, ভোগবাদী সমাজের গর্বের অন্ধকার উপস্থাপন। এই নগ্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। মানুষ তার মানবিক মর্যাদায় বেঁচে থাকবে। প্রত্যেকটি মানুষ তার 'মনুষ্যত্ব'কে জাগিয়ে তোলে সমাজের সকল অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য থেকে মুক্তির চিন্তা করবে- এটাই মনুষ্য সমাজের দায়িত্ব।

জয় হোক মানবতার।

লেখক: লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট