পরিবর্তনের জন্য সাহসী হতেই হবে

প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০১৭, ০৪:২৪

সাহসী হওয়া মানে শুধু যুদ্ধ করা নয়, নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়াটাও জরুরী। একটা সময় ছিলো যখন কন্যা সন্তান হলে তাকে হত্যা করে মাটিতে পুঁতে ফেলা হতো। ইসলামের পরিভাষায় একে বলা হয় আইয়ালে জাহিলিয়াতের যুগ। স্বামী মৃত্যুবরণ করলে একসময় স্ত্রীকে চিতায় পুড়ে সতীত্বের প্রমাণ দিতে হতো। এখনো পরিবারের সম্মান রক্ষায় মেয়েদের হত্যা করাকে কেউ কেউ সমর্থন এমনকি অনুসরণ করেও আত্মতৃপ্তি পায়। সেই সময় আমরা পার করে এসেছি মনে করে যারা প্রশান্তির ঢেকুর তুলছি তাদের মনে করিয়ে দেয়ার জন্যই হয়তো এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় #beboldforchange, পরিবর্তনের জন্য সাহসী হও। 

স্বামীর নির্যাতনের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে লম্বা কালো চুল কেটে ফেলা কোন যৌক্তিক সমাধান নয়। তার মানে এই নয় ঘরেও আপনি হেনস্তার শিকার হবেন। একটা সচেতনতামূলক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দেখতে পেলাম আজ, ভীষনই ক্ষুব্ধ করেছে আমাকে, একজন পুরুষ বলে নয় একজন বাবা হিসেবেও। তোমার ঘন কালো চুলে হারিয়ে যাওয়া মন এতো নিষ্ঠুর হতে পারলো!

নারীর প্রতি অবমাননা হয়েছে যুগের পর যুগ, হচ্ছে এখনো। আগে হতো প্রকাশ্যে, এখন হয় লুকিয়ে। একটা সময় যেটা ছিলো অবধারিত বা পুরুষের অধিকার সেটা এখন আইন করে নিষিদ্ধ। তাই নারীদের প্রটেকশন দেয়ার জন্য, তাদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রণীত হয়েছ বেশ কিছু আইন। আইন এর ফাঁক ফোকর গলে আবার বেরিয়েও যাচ্ছে কাপুরুষ অপরাধীর দল। ছলে বলে কৌশলে সুযোগ নিচ্ছে কতিপয় দুর্বৃত্ত।

নারীর জাগরণই পারে নিজেদের মুক্তি নিশ্চিত করতে, তাদের সচেতন করতে। আর এই ক্ষেত্রে শিক্ষা একটা গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। শিক্ষার প্রথম পাঠ মায়ের কাছে। তাই প্রতিটি মায়ের দায়িত্ব নিতে হবে সন্তানদের মাঝে এই বোধ ছড়িয়ে দেয়া। সেটা হচ্ছে কি? আপনার পুত্রবধূ নির্যাতিত হলে আপনার কন্যাও নিরাপদ থাকবে না।

সংসার যুদ্ধক্ষেত্র নয়, পারস্পরিক বোঝাপড়ার আনন্দ বেদনার কাব্য। প্রতিটি সংসারেই আছে হাসি কান্নার সংমিশ্রণ। তার পরেও দেশে ক্রমেই বেড়ে চলছে বিবাহ বিচ্ছেদের হার। স্বামী স্ত্রীর মনোমালিন্য নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি থেকে শুরু করে সন্তানের মৃত্যু/খুন পর্যন্ত হচ্ছে। বেঁচে থাকার জন্য বরং দূরে থাকাও ভালো।

রাজনীতিবিদ বাবাকে প্রশ্ন করেছিলাম, দেশের দুটি প্রধান দলের কাণ্ডারী নারী, তাহলে আলাদা মহিলা অঙ্গসংগঠন এর কি দরকার? সন্তোষজনক উত্তর পাইনি। প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নারী নেই, তা কিন্তু নয়। প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার আমাদেরই ঘরের মেয়ে, সম্মুখ যুদ্ধে আত্মাহুতি দিয়েছেন। ইলা মিত্র তেভাগা আন্দোলনে সাঁওতালদের নেতৃত্ব দিয়ে অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করেছেন। মতিয়া চৌধুরী অগ্নিকন্যা নামে পরিচিত হয়ে এখনো মূল রাজনীতিতেই মুখ্য ভুমিকা পালন করছেন। আছেন সাজেদা চৌধুরী, সেলিনা হায়াত আইভি সহ আরো অনেকেই। গণজাগরণের শ্লোগান কন্যা লাকি আক্তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন একটি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনকে। আর এই আন্দোলন সংগ্রামে হারিয়ে গেছে কল্পনা চাকমা।

এরশাদ সাহেবের সময় সংসদে সংরক্ষিত আসন এর ৩০ জন নারী সংসদ সদস্যদের কটাক্ষ করে বলা হতো সংসদের ৩০ সেট গহনা! এখন এই সংখ্যা বেড়েছে, এতে নারীর সম্মান, মর্যাদা বা অধিকার কি বেড়েছে? স্থানীয় নির্বাচনে নারীদের সংরক্ষিত আসনে বন্দী করে রাখা হয়েছে, কেউ কেউ যে সরাসরি নির্বাচন করছে না, তা নয়। মজার বিষয় হলো একেকটি ওয়ার্ডে যেখানে একজন পুরুষ হিমশিম খাচ্ছেন, সেখানে একজন নারীকে দৌড়াতে হয় তিনটি ওয়ার্ডে। নির্বাচিত হলেও তার জন্য নেই সুনির্দিষ্ট কোন দায়িত্ব, ক্ষমতা বা বিশেষ বরাদ্দ। এটা প্রহসন ছাড়া আর কি? নারী অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সবার আগে প্রয়োজন এই সংরক্ষণ ব্যবস্থার আমূল সংস্কার। 

গৃহবন্দী নারী বাইরে এসেছে সাহস করে, আরেকটু সাহস করে চাইলেই পারে পরিবর্তনে মুখ্য ভুমিকা রাখতে। বিশেষ পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে বাল্য বিবাহের বিধান বাতিলের দাবিতে সোচ্চার নয় কেন আজকের নারী সমাজ? ধর্ষকের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে হবে? আমার দুই কন্যাকে নিয়ে সত্যিই আমি আতঙ্কিত। ওড়না পড়াতে হবে আমার ক্লাস ওয়ানে পড়া মেয়েটিকে? কিলিয়ে কাঁঠাল না পাকালেই কি নয়?

পরিবার নয় গোটা বংশে একটা মাত্র ছেলে আমি, চার বোন। মা আমাকে দিয়ে ঘর ঝাড়ু দেয়াতেন, ন্যাকরা ভিজিয়ে মুছতে শিখিয়েছেন। মশলা বেটেছি শিল পাটা ঘষে ঘষে, থালাবাটি ধুয়েছি। মা রাজনৈতিক আড্ডায় থাকলে আন্টিদের চা করে খাইয়েছি। ভালো হয়তো হতো না, কিন্তু শিখিয়েছেন আমায়। মায়ের এই সাহসিকতা আমাকে ইভ টিজার বানায়নি। গর্ব করে বলতে পারি এটা আমার মায়ের দেয়া শিক্ষার কারণেই সম্ভব হয়েছে।

সময়টা খুব ভালো যাচ্ছে না। গাইবান্ধার ছোট্ট শিশু তৃষার কথা মনে আছে আমার, সম্ভ্রম বাঁচাতে যে ঝাঁপ দিয়েছিলো পুকুরে। লাশ ভেসে উঠেছিলো। নারায়ণগঞ্জের চারুকলার ছাত্রী সিমিকে বখাটেরা উত্যক্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি বাধ্য করেছিলো আত্মহত্যা করতে। দিনাজপুরের সেই শিশুটি প্রতিবেশী মধ্যবয়েসী পাড়াতো চাচার কাছে নিগৃহীত হয়ে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে হাসপাতালের বেডে। মিতু, তনু কেউ কি ছিলো এই দেশে?

সাহসী হতেই হবে। উপায় কি?

লেখক: উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত