ধর্মের নামে ভয়ংকর এক আচার: কন্যা শিশুর খৎনা

প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০১৭, ১৯:৪০

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা এবং কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই থেকে নারীর শ্রমের মর্যাদায় বৈষম্যের কারণে বিশ্বে পালিত হচ্ছে নারী দিবস। কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দিতেও ধর্ম সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে শত শত বছর ধরে সংস্কৃতি রক্ষার জন্য নারীর শরীরের উপর যেসব অমানবিক ভয়ংকর আচারগুলো পরিপালিত হয়ে আসছে, সেসব আচার নির্মূল ও নারীর শরীরকে স্বাধীন করার উদ্দেশ্য অচিরেই হয়তো প্রয়োজন হবে 'নারীর শারীরিক স্বাধীনতা' অর্জনের জন্য একটি দিবস।

পৃথিবীতে গোষ্ঠীগত আগ্রাসন ও যুদ্ধবিগ্রহে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী ও শিশু। সমাজ, সভ্যতা সংস্কৃতি প্রথা ও ধর্মীয় আচারেও এরা সবসময়ই বলির পাঁঠা। যেন নারীর শরীরের উপর খড়গ নামিয়েই সকল ধর্ম ও আচার পালনে পরিশুদ্ধ হয় মানব জাতির কল্যাণ। সভ্যতার প্রয়োজনে আবির্ভূত দাবীকৃত এসকল সামাজিক আচার প্রথা ও গোষ্ঠীগত সংস্কারগুলো হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ অনুসরণ করে আসছে। মানুষকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার তাগিদে এবং কখনো কখনো অবরুদ্ধ, নিয়ন্ত্রণ ও নিপীড়ন করার প্রয়োজনে ঐশী গ্রন্থগুলোর দোহাই দিয়ে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ আদিকাল থেকে নারীর উপর নিক্ষেপ করেছে অনেক ধরণের মর্মান্তিক ভয়ঙ্কর খড়গ। যা যুগে যুগে নারীকে করেছে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত এবং বঞ্চিত। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রথা এবং আচারগুলো যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর কিছু মানুষ এখনো অন্ধভাবেই পালন করে আসছে। কখনো ধর্মের অজুহাতে, আবার কখনো প্রথা ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে এই খড়গ চরম হিংস্র হয়ে চড়াও হয়ে শোষণ করছে নারীর শরীর। এসব থেকে শিশুরাও রক্ষা পায়নি। নিজের সন্তানকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রথায় বলি দিয়েও কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙ্গেনি। সন্তানের অঙ্গহানি করে রক্তাক্ত হয়ে উৎসবমুখর হয় ধর্মান্ধ মানুষ। তথ্য প্রযুক্তি জ্ঞানবিজ্ঞানের এই যুগেও কোন রেফারেন্স ছাড়াই নিষ্ঠুর এই প্রথা চাপিয়ে সমাজে ধার্মিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভালো মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা চাচ্ছে এক শ্রেণীর মানুষ।

পৃথিবীর অনেক দেশেই এখনো ধর্ষকদের শাস্তির আওতায় না নিয়ে বিয়ে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। কখনো বৃদ্ধদের সাথে বাল্যবিবাহ, কখনো ধর্ষকের সাথে বিয়ে দিয়ে আবার কখনো ধর্মের দোহাই দিয়ে অঙ্গহানি করছে কন্যাশিশুদের। আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রচলিত ফিমেল জেনিটাল মিউটেলেশন (এফজিএম) এমনই একটি প্রথা যে প্রথা পালন করতে গিয়ে প্রতি বছরই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে হাজার হাজার কন্যা শিশু। এটি নারীর শারীরিক অধিকারকে বঞ্চিত করার জন্য সমাজে প্রচলিত একটি ভয়ংকর মহামারীর নাম। যা ঠিক ধর্মীয় নির্দেশ, না ধর্মীয় অভ্যাস, না কি প্রথা তা নিয়ে রয়েছে ব্যাপক অসমাধানযোগ্য বিতর্ক এবং গবেষণা। কোন প্রকার চিকিৎসা বিজ্ঞানের রেফারেন্স ছাড়াই ধর্ম ও সংস্কারের দোহাই দিয়ে নারীর অধিকার হরণের জন্যে পুরুষতন্ত্রের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের কথা পৃথিবীর সভ্য দেশগুলোর আর বুঝতে বাকি নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের ২৯টি দেশের মোট সাড়ে বারো কোটি কন্যা শিশুর যৌনাঙ্গচ্ছেদের খবর প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনে প্রচলিত এই রীতিকে বর্বরোচিত এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করে এর নিন্দা জানানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয় এ ধরণের প্রথা কোন সংস্কৃতি হতে পারে না, এই প্রথায় চরমভাবে নারী ও শিশুর মানবধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে।

আফ্রিকার মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে এর প্রচলন হলেও অতি সম্প্রতি বেশ কিছু দেশ নারী শিশুর যৌনাঙ্গচ্ছেদ বন্ধ করতে এগিয়ে এসেছে। তবে বহুকাল থেকে এ প্রথার প্রচলন থাকাতে প্রথাটি নির্মূল করা খুব সহজ নয়। এফজিএম বন্ধ করতে আইন করা হয়েছে তবে তা বাস্তবে রূপান্তর করা বেশ কঠিন কাজ। তাই গত দু’বছর যাবৎ জাতিসংঘ পৃথিবীব্যাপী এর বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন শুরু করে এর বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে । অন্ধভাবে এই সংস্কার ও প্রথাগুলো আজন্ম টিকিয়ে রাখতে অনেক আদিবাসীরা এখনো নিজেদের মধ্যে এই আগ্রাসী এবং অযৌক্তিক প্রথার সমর্থন করে আসছে। সোমালিয়ান লেখক রাজনীতিবিদ, সাবেক ডাচ এম পি এবং সোশ্যাল এক্টিভিস্ট আইয়ান হারসি আলী পাঁচ বছর বয়সে এই জেনিটাল কাটিং এর শিকার হয়েছিলেন। সেকথা জানাতে গিয়ে তিনি জানান এই আচার পরিপালনে তার দাদি মনে করেন নারী শিশুর ক্লিটোরি ছোটবেলা কেটে না দিলে সেটি বয়সের সাথে সাথে বড় হতে থাকে যা তাকে পরিশুদ্ধ এবং বিয়ের যোগ্যতা অর্জনে বাধা প্রদান করে থাকে। যার দরুণ কন্যাশিশুদের ছুঁড়ি কাঁচি গ্লাসের ভাঙা অংশ দিয়ে বল প্রয়োগ করে পিউবারটি হবার আগেই সেটি রিমুভ করে দেয়া হয় যেনো বড় হবার সাথে সাথে নারী যৌনানুভুতি অনুভব করতে না পারে।

তারা মনে করে এতে তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে এবং সম্পূর্ণভাবে ছেলেবেলা থেকেই তাদের মেয়েদের সতীত্ব ধরে রাখা সম্ভব হবে। তাই শিশু কিশোর বয়সেই জোর করে এ কাজটি তারা করে আসছে। সেই সাথে এরা বিশ্বাস করে এর মাধ্যমে কন্যা শিশুরা পবিত্র হয় এবং বিয়ের জন্যে উপযুক্ত হয়। প্রথাটি বহু বছর যাবৎ পালন করতে করতে এমন অবস্থায় চলে গেছে যে কোন ধরনের কারণ ছাড়াই পরিবারের সদস্যরা বছরের পর বছর বংশ পরম্পরায় প্রথাটি পালন করে যাচ্ছে। অত্যন্ত করুণ আর নিষ্ঠুরভাবে পশু কোরবানি দেয়ার মতো দশ বারোজন মানুষ হাত পা চেপে ধরে একজন ছোট কিশোরী বালিকাকে। যে হয়তো সহসাই জানে না কেন তাকে এমন করা হচ্ছে বা কি তার অপরাধ এবং কি কারণেই বা তাকে এমন করা হচ্ছে !

তবে এ কথা ঠিক যে এসব মানুষেরা বেশিরভাগই অনুন্নত দেশের কুসংস্কারাচ্ছন্ন আদি মানব গোষ্ঠী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ৪ থেকে ১৪ বছরের নারী শিশুদের অশিক্ষিত অনভিজ্ঞ মানুষ দিয়ে কোন ধরণের প্রস্তুতি এবং অনুমতি ছাড়া চেতনানাশক ঔষধ ব্যবহার না করেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে শিশুর স্পর্শকাতর অঙ্গচ্ছেদ করা হয়। যে কারণে তারা ভয়ে চেতনা হারিয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তাছাড়াও ইউরিন ইনফেকশন, ইনফারটিলিটি ব্লিডিং, ইনফেকশন সহ আরো নানা ধরণের সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে অসংখ্য কন্যা শিশু। এমনকি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যুর কোলেও ঢলে পড়ছে ।

ঐতিহ্য রক্ষা করতে গিয়ে এবং আইনের দণ্ডের ভয়ে অনেক পিতামাতাই এখনো খুব গোপনে তাদের মেয়েদের উপহারের লোভ দেখিয়ে এফজিএম করায় ৷ ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে বাচ্চা মেয়েটি ভয়ে মুখ খুলছে না বা সে কোন কথাই বলছে না ৷ নিজের বাবা মায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতেও তারা সাহস করে না।

পশ্চিম আফ্রিকার সেনেগাল থেকে পূর্ব উপকূলের ইথিওপিয়া, সেই সাথে মিশর এবং তাঞ্জানিয়া পর্যন্ত এই প্রথা কঠোরভাবে অনুসারিত হয়ে আসছে। এ ছাড়াও আরব উপদ্বীপের কিছু গোষ্ঠীর ভেতরে এই প্রথার চর্চা দেখা যায়। মিশর, সুদান ইথিওপিয়া এবং মালিতে এর প্রচলন দেখা যায়। সোমালিয়া ও মিশরে এ যাবৎ এই রীতি প্রচলিত থাকলেও অতি সম্প্রতি মিশরে এটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে সিরিয়া,পশ্চিম ইরান এবং তুরস্কের কিছু অঞ্চলে এখনো এর প্রচলন রয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের কিছু শ্রমিক গোষ্ঠীর মধ্যেও এটি বহুলভাবে প্রচলিত। ভারতের দাউদ বহরা নামের একটি গোষ্ঠীর মধ্যেও এ প্রথার প্রচলনের কথা শোনা যায়। ইন্দোনেশিয়ার মুসলিম নারীদের মধ্যেও আনুষ্ঠানিকভাবে এ রীতি পালন করা হয়। অভিবাসনের মাধ্যমে এটি অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও ইউরোপে ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

শুধু এফজিএম নয় সারা বিশ্বে এখনো ধর্ম ও সংস্কারের দোহাই দিয়ে নারী ও শিশুদের উপর চলছে অমানবিক নিষ্ঠুরতা। বিশ্বায়নের এই যুগে এখনো নারীর অঙ্গচ্ছেদ করবে, বিয়ে দেয়ার অজুহাতে শিশু ধর্ষণের নামে বাল্য বিবাহ দিবে, অনার কিলিং করবে, স্তন পুড়িয়ে দেবে- পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেও নারীর উপর এমন অনেক রীতি প্রচলিত আছে যা দেখাতো দূরের কথা, শুনলেও মেনে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর সকল নারী শিশুর শরীরকে রক্ষা করতে এবং বাল্য বিবাহ রোধ করতে বড় বেশি প্রয়োজন 'নারীর শারীরিক স্বাধীনতা' দিবস অর্জনের জন্য একটি আন্দোলন।

লেখক: কলামিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত