মাসিক ঋতুশ্রাবের একাল আর সেকাল

প্রকাশ | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২০:০৯ | আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৭, ২০:২৮

আমার মেয়ের বয়স যখন এগারো তখন একদিন সকালে সে খুশিতে নাচতে নাচতে আমার কামরায় এসে ঢুকলো। তার উজ্জ্বল চোখেমুখে নেচে যাচ্ছে অজস্র অনুভূতি- গর্ব, আনন্দ, লজ্জা, উত্তেজনা।

‘মামা হয়ে গেছে’।
‘কী হয়ে গেছে? এভাবে লাফাচ্ছ কেন?’ 
‘আমার ওটা হয়ে গেছে মা, আমার শরীর পারফেক্টলি নরমাল’।

মেয়েটা এতো স্বাভাবিকভাবে কথাগুলো বলল যেন সে এইমাত্র সাফল্যের সাথে কোন পরীক্ষা পাশ করেছে, অথবা কারো কাছ থেকে খুব মূল্যবান কোন উপহার পেয়েছে। এতো আনন্দিত হতে তাকে আগে কখনো দেখিনি। আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করলাম, আর সেই ফাঁকে মুছে নিলাম আমার ভিজে উঠা চোখ। এই অশ্রু ছিল একাধারে সুখের এবং দুঃখের। কি অদ্ভুত সহজতার সাথে নিজের শরীরের এই পরিবর্তনকে আলিঙ্গন করেছে আমার মেয়ে, কি গৌরবের সাথে ঘোষণা দিয়েছে নিজের সুস্থ স্বাভাবিক শরীরের কথা! 

কিন্তু নিজের এই উত্তেজনার মধ্যে সে লক্ষ্য করেনি তাকে জড়িয়ে ধরা তার মায়ের হাত দু’টো একটু একটু কাঁপছিল। আমার মনে পড়ছিল আমার নিজের প্রথম মাসিক রক্তশ্রাবের কথা। আমার বরাবরের বদভ্যাস অনুযায়ী আগের রাতে স্কুলের পোষাক না বদলেই বিছানায় গিয়েছিলাম। সকালে উঠে বাথরুমে গিয়ে আমি সাপ দেখার মত চমকে উঠলাম, আমার ইউনিফর্মের সাদা পাজামার সন্ধিস্থল রক্তে লাল হয়ে আছে। সেই মুহুর্তের ভয়াবহ অনুভূতির কথা আমি কখনো ভুলবো না। 

শুনতে হাস্যকর শোনাতে পারে, কিন্তু আমি আসলেই ভেবেছিলাম আমার গোপনাঙ্গটি কেটে গেছে, অথবা বনের পথে হাঁটার সময় ওখানটায় জোঁক ঢুকে গেছে, তা না হলে এতো রক্ত আসবে কোথা থেকে? মা কতবার আমাকে বারণ করেছিলেন বনে বাদাড়ে না ঘুরতে, আমাকে ভয় দেখাতে গোপনাঙ্গ দিয়ে জোঁক ঢুকে অসংখ্য মেয়ের মৃত্যুর কাহিনীও মা শুনিয়েছিলেন। বকা খাওয়ার ভয়ে আমি ব্যাপারটি মা’কে না জানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু এই রক্তভেজা পাজামা নিয়ে এখন আমি কী করব?

বাথরুমে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। পানি দিয়ে আমার যোনি ধুতে থাকলাম বারবার, কিন্তু আমাকে ভীত আর বিস্মিত করে দিয়ে একটু পর পর রক্ত বের হতেই থাকল। বাইরে থেকে আমার চার বছরের বড় ভাই বাথরুমের দরজায় নক করে সারাদিন ভেতরে বসে থাকব নাকি জানতে চাইছিল। উপায়ান্তর না দেখে আমার প্রচন্ড আঠালো নোংরা পাজামা কোনমতে দুই হাতে কোমারের কাছে জাপটে ধরে আমি বেরিয়ে এলাম। পুরো পরিবারের মধ্যে যার কাছ থেকে কিছুটা সমবেদনা পাওয়া যেতে পারে বলে মনে হলো, সে আমার সেঝ বোন। আমরা তাকে ডাকতাম ছোটাপা।
 
কিছুদিন আগে ছোটাপার একটা মেয়ে হয়েছে, তার চারপাশ ঘিরে বসে আছে গ্রামের বাড়ি থেকে আসা তার ননদেরা। আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না, ছোটাপার কাছে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম, ‘ছোটাপা আমার ঐ জায়গাটা কেটে গেছে, অনেক রক্ত’। আমার সমবেদনার আশাকে ধূলায় মিটিয়ে দিয়ে ছোটাপা ধমকে উঠল, ‘বাথরুমে যা, পাগল কোথাকার!’ 

আমি বাথরুমের কালো সিমেন্টের মেঝে আর ঠান্ডা দেয়ালের কাছে ফিরে গেলাম। আপা আসা পর্যন্ত কাটলো আমার জীবনের সবচেয়ে বিভীষিকাময় কিছু মুহুর্ত। আমি আকাশ পাতাল হাতড়ে পেলাম না আমার কী হয়েছে, আর কিভাবে আবার আমি ঠিক হব। পৃথিবীর সমস্ত শব্দমালা একত্রিত করলেও সেই ছোট্ট চার দেয়ালের অন্ধকার বেষ্টনীর ভেতরে বসে থাকা এগারো বছরের বোকাসোকা অনভিজ্ঞ মেয়েটির ভয় আর কষ্টের কথা বুঝিয়ে বলা যাবে না। 

যোজন যোজন কাল ধরে পার হওয়া কয়েকটি মিনিট পর ছোটাপা অবশেষে এলো। আমি তখন দুই উরু চেপে ধরে হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছিলাম। আপা আরেকটা ধমক দিল, ‘হয়েছে আর কাঁদতে হবে না, এসব সবার হয়'। 

তারপর সে আমার হাতে একটা ছেঁড়া শাড়ির টুকরা ধরিয়ে দিল, দেখিয়ে দিল কিভাবে ওটা সুন্দর করে পাট পাট করে ভাঁজ করে দুই পাশে বেল্টের মত ফিতা লাগাতে হবে। অনেকবার দেখানোর পরও আমি ঠিকমত করতে পারছিলাম না আর বকা খাচ্ছিলাম বারবার। আসলে আমি বুঝতেই পারছিলাম না এই কাজটা আমাকে কেন করতে হবে। আমার সবচেয়ে গোপন স্থানটা কেটে রক্তে ভেসে যাচ্ছে আর আপা আমাকে শাড়ির টুকরা রুমালের মত ভাঁজ করা শেখাচ্ছে। কি অদ্ভুত!

তারপর ঐ কাপড়ের বস্তুটা আমার গোপনাঙ্গে প্যান্টের মত করে পরতে বলে আপা আমাকে বাথরুমে রেখে চলে গেল, তেমন কিছুই বুঝিয়ে বলে গেল না। আমার আকাশ পাতাল হাতড়ানো চলতে থাকল। 

অনেকক্ষণ ধরে আমি বাথরুমের ভেতরেই বসে রইলাম। অসহায়ের মত কাঁদতে থাকলাম, প্রচন্ড রাগে নিজের চুল টানতে থাকলাম, ভীষণ ক্ষোভে নিজের হাতে আঁচড় কাটতে থাকলাম। মনে হলো, আমি না জন্মালেই সবচেয়ে ভাল ছিল। মায়ের কথামত কত নামাজ পড়েছি, রোজার মাসে ঘন্টার পর ঘন্টা দোয়া দুরুদ আর কোরান শরীফ পড়েছি যে আল্লাহর কাছে তিনিও কি আমাকে সাহায্য করবেন না? 

আমি মনে প্রাণে আল্লাহকে ডাকতে থাকলাম। একবার আমাকে ঠিক করে দাও আল্লাহ, আমি আর দুষ্টুমি করবো না, মা’র সব কথা শুনবো, আর বনের পথে হাঁটতে যাব না, এক ওয়াক্ত নামাজও বাদ দেব না। একবার ভাল হয়ে গেলে আর আপাদের ড্রয়ার থেকে টাকাও চুরি করবো না, আর কখনো মিথ্যা কথা বলবো না। বলা বাহুল্য, এতো আন্তরিক প্রতিশ্রুতির পরও আল্লাহর কাছে আমার সমস্ত প্রার্থনা অনুত্তরিতই থেকে গেল। 

আমি ভেবেছিলাম জীবনে এর থেকে খারাপ আর কিছু ঘটতে পারে না। আমার এই চিন্তাটা যে ভুল ছিল, তা অচিরেই ধরা পড়ল যখন আপা এসে আমাকে আরো একটুকরা কাপড় দিয়ে বলল ঐ রক্ত-ভেজা কাপড়ের টুকরা ধুয়ে বাথরুমের ভেতরে মেলে দিতে হবে যাতে আবার ব্যবহার করা যায়। 

আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘আবার মানে?’ 
আমার বোকামিতে আপা হেসে উঠল, 
‘ওরে আমার বনুরে, এখন থেকে প্রতিমাসে সাতদিন ধরে এইভাবে রক্ত যাবে তোমার'।
‘সারা জীবন?’ 
‘সারা জীবন, বুড়া হওয়া পর্যন্ত। যদি না ধোও তাহলে প্রতি মাসে এতো এতো কাপড় আসবে কোত্থেকে?’  

আমার মনের ভেতর একটা ক্ষীণকায় আশা ছিল যে আপা আমার সাথে ঠাট্টা করছে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর যখন মা আমাকে ডেকে নিয়ে পাশে বসলেন, তখন এই শেষ আলোটুকুও নিভে গেল। তারপরও আমি ভেবেছিলাম মা আমাকে বলবেন, আমার কোন দুষ্টুমির কারণে এটা হয়েছে, আমি ভাল মেয়ে হয়ে গেলে এটা দূর হয়ে যাবে। কোন বিশেষ দোয়া, বা সূরা নির্দিষ্ট সংখ্যকবার পড়ে সমস্যাটা সমাধান করে ফেলা যাবে। কিন্তু আমার আশার গুড়ে বালি ঢেলে দিয়ে মা-ও ভারিক্কি গলায় একরাশ উপদেশ ছাড়া আর কিছুই বললেন না। কেন এটা হচ্ছে? আসলেই কি এটা সবার হয়? একটা মানুষ সারাজীবন ধরে তার বিশেষ অঙ্গ দিয়ে রক্তপাত কিভাবে সহ্য করবে? এই সমস্ত প্রশ্ন অনুত্তরিত রেখেই মা বললেন, ‘এখন তুমি বড় হয়েছ, আর ছেলেদের সাথে খেলবে না’। মা জানতেও পারলেন না তার এই কথার অর্থ আমি বুঝতেই পারলাম না, অনেক কষ্ট আর বিভ্রান্তিতে আমার মন আরো ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। 

তারপরের কয়েকদিন ধরে চলতে থাকা নির্যাতনের কথা গুটিকয় ভাগ্যবান ছাড়া বাঙালি নারী মাত্রই জানেন। কয়েকদিন ধরে আমাকে শুধু দুধ আর কলা দিয়ে মেখে ভাত খেতে দেয়া হলো। মা বললেন, প্রথম তিন মাস রক্তশ্রাব চলাকালীন সময়ে মাছ মাংস পেঁয়াজ রসুন খেলে সারা জীবন গায়ে দুর্গন্ধ করবে। আমাকে বলা হলো কাউকে যেন এটা হবার কথা না বলি, এটা যতদিন সম্ভব গোপন রাখতে হবে। এই সতর্কবাণীতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হলো আমার আসলেই ভয়াবহ কিছু একটা হয়েছে যা সবার হয় না, তা না হলে এটা গোপন রাখতে হবে কেন?

সন্দেহাতীতভাবে ঐ দিনগুলো ছিল আমার শৈশব কৈশোরের নিকৃষ্টতম সময়। আপা আর মা আমার উপর কড়া নজর রাখতেন যাতে আমি ছেলেদের সাথে খেলাধূলা না করি। তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমি প্রায়ই আমার গুপ্ত আশ্রয় টিলার ঢালের আড়ালে ঢাকা কাজুবাদাম গাছের নিচে গিয়ে বসতাম। নীচু একটা ডালে হেলান দিয়ে বসে নীরবে কাঁদতাম। যদিও আপা বলেছিল এটা সবার হয়, আমার বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গিয়েছিল এই বিশাল পৃথিবীতে এই মারাত্মক দুর্ঘটনাটি শুধু আমার ক্ষেত্রেই ঘটেছে কারণ এর আগে কখনো কাউকে এই বিষয়ে কিছু বলতে শুনিনি। আব্বা-মা’র কথাই ঠিক, আমি একটা ভীষণ খারাপ মেয়ে, একটা ভাল মেয়ের জীবনের এতো জঘন্য একটা ঘটনা ঘটতেই পারে না।

আমি আমার বড়ভাইকে একদিন চুপিচুপি জিজ্ঞেস করেছিলাম তার প্রতি মাসে রক্ত বের হয় কি’না। উত্তরে সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল আমার দিকে, যেন খুব অদ্ভুত কোন কথা শুনছে। আমি বুঝে গিয়েছিলাম সে আমার মত দুর্ভাগা নয়। যেহেতু আমাকে বলা হয়েছিল এসব কথা কাউকে না বলতে, সেহেতু এই বিষয়টা যে আসলেই খুব স্বাভাবিক এবং সব মেয়ের ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে এই সত্যটা উদঘাটন করতে আমার আরো বহুদিন লেগেছিল। এবং এই সত্য জানার পরও প্রচন্ড অভিমানবোধ করেছিলাম মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে।

আমার মেয়ের প্রথম ঋতুশ্রাবের অভিজ্ঞতা ছিল সম্পূর্ন অন্যরকম। খুব ছোটবেলা ত্থেকেই সে জেনেছিল যে বয়স বাড়ার সাথে সাথে এরকম একটা ব্যাপার তার শরীরে ঘটবে। সে শিখেছিল এটা ঘটা লজ্জার নয়, বরং স্বস্তির বিষয়, আনন্দের বিষয়। ঘটনাটা ঘটবার অনেক আগেই সে জেনেছিল সব মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা ঘটে, এবং এটা নারী হিসেবে তার শারীরিক সুস্থতা এবং পূর্নতার পরিচায়ক। আর তাকে এই প্রশিক্ষণ দিয়েছিল উপরের করুণ গল্পের এগারো বছর বয়সের ক্ষুদে নায়িকাটি যে নিজে মা হবার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তার মেয়ের জীবনে এই করুণ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না কিছুতেই। তার মেয়ে নিজের শারীরিক পরিবর্তনগুলোকে বুঝবে, নিজের শরীরকে ভালবেসে বড় হবে। 

আমি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম আমার মেয়ের প্রথম ঋতুশ্রাব হবে একটা উৎসবের উপলক্ষ, কষ্টের নয়। তাই সেদিন বিকেলেই মা মেয়ে মিলে কিনে এনেছিলাম তার জীবনের প্রথম ড্রেসিং টেবিল- মজবুত কাঠ আর ঝকঝকে আয়নার এই টেবিলের সামনে বসে সে যখন তার আত্মপ্রত্যয়ী গর্বিত নারীদেহের দিকে তাকিয়ে খুশির হাসি হাসছিল, আমি তখন রান্নাঘরের পেছনের সবজি বাগানে বেরিয়ে গিয়ে আবারও লুকিয়ে চোখের পানি মুছেছিলাম।

কেন কাঁদছিলাম আমি? পৃথিবীতে ছোটখাটো একটা পরিবর্তন আনতে পারার আনন্দে? নাকি আমার এগারো বছরের আমিটির কষ্টে যে ড্রেসিং টেবিল তো দূরের কথা, নিজের নারীত্বের প্রথম আভাসে একটা আদরের আলিঙ্গন পর্যন্ত পায়নি? উত্তরটা আমারও জানা নেই। তবে এটুকু জানি কিছু ক্ষত শুকিয়ে গেলেও দাগটা কোনদিনই মুছে যায় না। 

(নিষিদ্ধ দিনলিপি থেকে)

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী শিক্ষক, নাট্যকর্মী, ও অনুবাদক