বদলে যাচ্ছে মায়ের ভাষা

প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২১:২৮

বর্তমানে বিশ্বে ৬৫০০টি ভাষায় মানুষ তার মনের কথা প্রকাশ করে থাকে। এর মধ্যে অনেক ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কোন একটি ভাষায় কথা বলতে পারা সর্বশেষ ব্যক্তির মৃত্যুর মাধ্যমে ভাষার বিলুপ্তি ঘটে যায়। পৃথিবীতে এমন ২০০০ ভাষা রয়েছে, যেগুলোর ভাষাভাষির সংখ্যা ১০০০ এর চেয়েও কম। 

ধারণা করা হয়, বর্তমানে প্রচলিত ৯০% ভাষাই ২০৫০ সালের মধ্যে চিরতরে হারিয়ে যাবে। একেকটির ভাষার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে প্রকৃতপক্ষে মৃত্যু ঘটে সংস্কৃতির, ইতিহাসের। মৃত্যু ঘটে পুরো একটি সভ্যতার। অথচ একদিন এই মৃত ভাষাগুলোতে মানুষ তাদের সুখ-দুঃখের গল্প করতো। ভাষার মৃত্যু একটি জাতির জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। আর মাতৃভাষা রক্ষার জন্য প্রাণ দেওয়ার এক গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে বাঙালিদের। সে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এখন ২১ ফেব্রুয়ারি সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু কেমন আছে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা?

ভাষা চলমান, ভাষা সময়ের সাথে বদলে গিয়ে নতুন প্রাণ পায়। এফএম রেডিওর উপস্থাপকদের বাংলা-ইংরেজি মিশেলের বিকৃত উচ্চারণে ভাষা কতখানি প্রাণ পায় কিংবা প্রাণ হারায় এটা একটি প্রশ্ন বটে। উঠতি তরুণেরাও বর্তমানে এমন বিকৃত উচ্চারণে কথা বলাকেই হাল ফ্যাশন হিসেবে গ্রহণ করছে। এছাড়া রয়েছে টিভিতে ‘আইসি, করসি, খাইসি’ মার্কা নাটক। আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে স্থূল রসিকতা। গণমাধ্যমে যখন ভাষার এমন অশুদ্ধ ও বিকৃত উচ্চারণ ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়, তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ভাষার বিকৃতি খুব সহজে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ‘মুরাদ টাকলা’ ভাষা আরো কিছু মাত্রা যোগ করেছে।

এখন ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখার জন্য অনেক পরিবারে সন্তানেরা ঠিকমত বাংলায় কথাও বলতে পারে না। পরিবারগুলোতেও বাংলায় কথা বলার চর্চা দিন দিন কমে যাচ্ছে। মায়ের মুখের ভাষাও বদলে যাচ্ছে। সন্তান তার মাকে সব সময় বিদেশী ভাষা কিংবা বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি ভাষার মিশ্রণে একটি ককটেল ভাষায় কথা বলতে দেখে। সুতরাং আমাদের মাতৃভাষা যে খুব দ্রুতই নানা ভাবে, নানা আঙ্গিকে বদলে যাচ্ছে, এ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। 

ভাষাতে প্রচুর বিদেশী শব্দের ঘনঘটা বাড়ছে দিন দিন। এক সময় মানুষ বিদেশী ভাষা বলতে শুধু ইংরেজীই শিখতো। এখন কাজের প্রয়োজনেই মানুষ ইংরেজীর পাশাপাশি ফ্রেঞ্চ, কোরিয়ান, আরবি ইত্যাদি নানা ভাষা শিখছে। আর বিদেশী ভাষার শব্দগুলোও টুপটাপ জায়গা করে নিচ্ছে বাংলাতে। প্রবাসী বাঙালিদের দ্বিতীয় প্রজন্ম বেড়ে উঠছে শিকড়ের ভাষা বাংলা না জেনেই। দেশের মধ্যকার নতুন প্রজন্মও যেন অনেকটা প্রবাসী বাঙালিদের দ্বিতীয় প্রজন্ম। বাংলা ভাষার যে একটি মিষ্টি সুর রয়েছে তার রেশ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। আদিবাসী ও আঞ্চলিক ভাষাগুলোর প্রতি অবহেলার কথা না-ই বা বললাম। 

লেখক: লেখক ও শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত