হালদা কেন জাতীয় নদী নয়!

প্রকাশ | ১১ জানুয়ারি ২০১৭, ২০:১৯ | আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৭, ২১:১১

বাংলাদেশের মৎস্য খনি খ্যাত ছোট একটি নদীর নাম হালদা। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড় উপজেলার পাহাড়ী ক্রীক থেকে উৎপত্তি হয়ে এ নদী রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার মধ্য দিয়ে কর্ণফুলী নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। অপার জীববৈচিত্র্যময় ও মৎস্য সম্পদে ভরপুর এ নদী জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রেখে আসছে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। 

রুই জাতীয় মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ) পোনার জন্য এ নদীর আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকলেও এটি যোগাযোগ, কৃষি ও পানি সম্পদেরও একটি বড় উৎস। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ যে কয়েকটি প্রাকৃতিক সম্পদ বাংলাদেশে রয়েছে তার মধ্যে হালদা অন্যতম। বর্তমানে এ নদী যথাযথ পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, মা-মাছ শিকার, অপরিকল্পিত স্লুইস গেইট নির্মাণ এবং বাঁক কেটে দেওয়াসহ মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে হুমকির সম্মুখীন। এর ফলে প্রতি বছর মা-মাছের ডিম ছাড়ার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে। এতে হালদা পাড়ের ডিম সংগ্রহকারী ও জেলেদের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি ও যুগ যুগ ধরে তাদের পূর্বসূরীদের ঐতিহ্যবাহী পেশা বন্ধ হয়ে যাওয়ার অজানা আশঙ্কায় তারা দিনযাপন করছে।

হালদা নদীর প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের উদ্দেশে বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য অধিদপ্তর ২০০৭ সালের জুলাই থেকে “হালদা নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র পুনরুদ্ধার প্রকল্প” নামে একটি প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করে। পাঁচ বছর মেয়াদী এ প্রকল্পের মেয়াদ ২০১২ সালে শেষ হয়ে যায়। এ প্রকল্প থেকে হালদা নদী কতটুকু পুনরুদ্ধার হয়েছে এবং হালদা পাড়ের জনগণ কতখানি সুফলভোগ করতে পেরেছে তা মূল্যায়নের জন্য হালদা পাড়ের জনগণ যথেষ্ট অবহিত। প্রকৃতপক্ষে, দেশের ঐতিহ্য ও সম্পদ হিসাবে হালদাকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন দীর্ঘ মেয়াদী সঠিক পরিকল্পনা। এখন থেকে যদি এর জন্য কোন সঠিক পদক্ষেপ নেয়া না হয় তবে এ প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রের সংরক্ষণ সম্ভব নয়।

হালদা নদীর সম্পদ, ঐতিহ্য এবং অর্থনৈতিক অবদান বিবেচনা করলে এ নদী বাংলাদেশের জাতীয় নদীর স্বীকৃতি পাওয়ার উপযুক্ত তেমনি বেশকিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের জন্য এটি আমাদের দেশের জাতীয় মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্যের দাবিদার। অথচ গুণগত গবেষণা, সঠিক তথ্য-উপাত্ত ও প্রচারের অভাবে এখনো হালদা নদীর জাতীয় ঐতিহ্য সম্পর্কিত পরিচয় সবার দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে গেছে। 

হালদা কেন বাংলাদেশের জাতীয় নদী?

পৃথিবীর প্রতিটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে কিছু জাতীয় প্রতীক থাকে, যেমন জাতীয় ফুল, জাতীয় গাছ, জাতীয় মাছ, জাতীয় পশু ইত্যাদি যা সে দেশের জাতীয় ঐতিহ্য বহন করে তেমনি পৃথিবীর নদী নির্ভর বা নদী প্রধান দেশগুলোতেও জাতীয় নদী থাকে, বিশেষ করে যে সমস্ত নদীর আর্থিক অবদান, যোগাযোগ, পানি, মৎস্য ও কৃষিজ উৎপাদনে, বা পর্যটন ও ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং নদীটি সংশ্লিষ্ট দেশের নিজস্ব নদী হলে রাষ্ট্রীয় মার্যাদা ও ঐতিহ্যের প্রতীক হিসাবে সেই নদীকে জাতীয় নদীর স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে নদীমাতৃক বাংলাদেশ এবং নদী কেন্দ্রিক অর্থনীতি বাংলাদেশের প্রধান চালিকা শক্তি হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও আমাদের কোন নদীকে জাতীয় নদী ঘোষণা করা হয়নি। আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের জাতীয় নদী হচ্ছে গঙ্গা, পাকিস্তানের জাতীয় নদী সিন্ধু, মিশরের জাতীয় নদী নীল নদ। চট্টগ্রামের হালদা নদীর উৎস, বিস্তার, অর্থনৈতিক অবদানসহ সার্বিক বিষয় বিবেচনা করলে একমাত্র হালদা আমাদের জাতীয় নদীর স্বীকৃতি পেতে পারে কারণ অন্যান্য নদীগুলোর দৈর্ঘ্য এবং অর্থনেতিক অবদান বিবেচনা করলেও সেইসব নদীর উৎস বাংলাদেশ নয় এবং যার ফলে এ নদীগুলোর ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। হালদা নদী দেশের একমাত্র নদী যা আমাদের জাতীয় নদী হিসাবে সব শর্ত পূরণ করে। 

হালদা নদী কেন আমাদের জাতীয় প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্য?

ঐতিহ্য, সম্পদ ও অর্থনৈতিক অবদানসহ নিম্মোক্ত বেশকিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের জন্য হালদা নদী আমাদের দেশের জাতীয় মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্যের দাবিদার। উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলো হলো-

অদ্বিতীয় নদী (Unique River)
হালদা নদী বাংলাদেশের একমাত্র রুই জাতীয় মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেল এবং কালিগনি) প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র এবং বিশ্বের একমাত্র জোয়ারভাটার নদী যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়।

প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক (Natural Gene Bank)
হালদা নদী বাংলাদেশের রুই জাতীয় মাছের একমাত্র বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক। বর্তমানে ইনব্রিডিং-এর কারণে মাছের বৃদ্ধি মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য হালদা নদী এই প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক সংরক্ষণের বিকল্প নেই।

ঐতিহ্যবাহী (Traditional)
হালদা নদী থেকে ডিম আহরণ, আহরিত ডিম থেকে রেণু উৎপাদন এবং পরিচর্যা প্রযুক্তি স্থানীয়দের সম্পূর্ণ নিজস্ব (Indigenous)। স্মরণাতীতকাল থেকে ধর্মীয় অনুভূতি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সংমিশ্রনের এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিম আহরণ, আহরিত ডিম থেকে রেণূ উৎপাদন করে আসছে। 

আর্থিক অবদান (Economic Contribution)
হালদা নদী থেকে প্রাপ্ত ডিম, উৎপাদিত রেণু এবং উৎপাদিত মাছের পরিমাণ হিসাব করলে দেখা যায়, এক বছরে জাতীয় অর্থনীতিতে হালদার অবদান প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। একক নদী হিসাবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে হালদা নদীর অবদান খুবই তাৎপর্যবহ। 

পরিবেশ (Environment)
বাংলাদেশের অসংখ্য নদী থেকে হালদা নদীর বিশেষ পার্থক্য মূলতঃ পরিবেশগত। বর্ষা মৌসুমে নদীর পরিবেশগত কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য এখানে মাছ ডিম ছাড়তে আসে। এ বৈশিষ্ট্যগুলো ভৌতিক, রাসায়নিক এবং জৈবিক। 

পানি সম্পদ (Water Resources)
বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী ও বন্দর নগরী চট্টগ্রাম শহরের সুপেয় পানির প্রধান উৎস হালদা নদী থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি গ্যালন পানি উত্তোলন করে। এ নদীর পানিতে হেভী মেটালের পরিমাণ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান থেকে কম হওয়ায় বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানির উৎস হিসাবে হালদা নদীর পানি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়