গালির অপপ্রয়োগ, আইনের অন্ধ চোখ

প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ২০:২৬

"হারামজাদী ছিনাল, বজ্জাত মাগী, খানকী, বেইশ্যা" -ফেলু মিঞা কর্তৃক হুরমতীর উদ্দেশ্যে এই গালি দিয়েই শহীদুল্লা কায়সার তাঁর বিখ্যাত 'সংশপ্তক' উপন্যাস শুরু করেছিলেন। কিন্তু এটুকু পড়েই যদি কোন সভ্য মানুষ বইয়ের পাতা ভাঁজ করত তাহলে তাঁর বিখ্যাত এই উপন্যাস আর সফলতার মুখ দেখত না! এই গালির মাধ্যমেই লেখক তুলে ধরেছেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে শত শত নারীর প্রতিনিধিত্বকারী একজন হুরমতীর অসহায়ত্ব, হুরমতীদের প্রতি সমাজের অন্যায়, অবিচার ও নিষ্ঠুরতা।

শুনেছি গালি দিলে নাকি ভিতরের ক্ষোভ লাঘব হয়, শান্তি লাগে। মনে মনে গালি দিয়ে সেটার প্রমাণও পেয়েছি। অনেকে গালিকে একটা সমাজের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য হিসেবেও দেখে। গালিও নাকি একটা আর্ট! ঠিক আছে গালিকে তাহলে রাগ প্রশমনের উপায় হিসেবে না হয় স্বীকৃতিই দিলাম! তো আমি যখন চূড়ান্ত বিদ্রোহী মুডে থাকব, যখন আমার সভ্যতার শিক্ষাও আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, তখন আমি কি গালি দিব?

আমাদের সমাজে সবচেয়ে খারাপ গালিগুলো কি? নিশ্চয়ই আপনার মনে সেই গালিগুলো এতক্ষনে মনে পড়ে গেছে। আর এটা বুঝতেও কষ্ট হওয়ার কথা না যে সেই গালিগুলোতে একজন নারীকেই বোঝানো হচ্ছে, একজন নারীকেই অপমান করা হচ্ছে।

এই যে কিছুদিন আগে দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরের দুই কীট (নাম লিখতে ঘৃনা হচ্ছে) পাঁচ বছরের শিশুকে তাহাদের চরম উত্তেজনার মুহুর্ত দেখাইল, তাহাদের যে মনের অজান্তেই দুই চারখানা গালি দিয়া ফেলিলাম মনে মনে (উচ্চারণ করে আমি কোনদিন গালি দিতে পারি নাই), সেই গালি দিয়েই তাৎক্ষণিক বুঝিতে পারিলাম, এ কী করিলাম আমি! কি গালি দিলাম! এই গালিতেও যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরই প্রভাব! সবচেয়ে খারাপ গালিগুলোতেও যে একজন নারীকেই হেয় করা হচ্ছে, একজন মাকেই অপমান করা হচ্ছে! এই কীটদের জন্মদানে কি পুরুষের কোন ভূমিকা নাই! আরে সবখানে যে সন্তান জন্মদানে তোমরা (পুরুষ) নিজেদের ভূমিকাকেই জাহির করতে চাও বেশি, তো এইখানে তোমাদের (পুরুষদের) মিন করে এমন গালি কই! গালির কেন লিঙ্গান্তর নেই? আমি নিজে কেন এমন কোন গালি আবিষ্কার করে দিতে পারলাম না! তাহলে গালির আবিষ্কারক কারা? আমি একজন নারী হয়ে একজন নারীকেই গালি দিয়ে অপমান করলাম! সাথে সাথে হিরো আলমের সেই বিখ্যাত ডায়ালগ - "এ আমি কি কইল্লাম" আমার মনের অজান্তেই বেরিয়ে গেল!

যখন শিশু ধর্ষণের মত চূড়ান্ত জঘন্যতম ঘটনা ঘটে একের পর এক, এসব দেখে যখন আমার সারা শরীর মন বিদ্রোহ করে ওঠে, যখন খুব স্পষ্ট করে আমি উপলব্ধি করতে পারি একাত্তরে কোন বিপ্লবী অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল বলে এক মুহূর্ত জীবনের মায়ার কথা না ভেবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমার দেশের মানুষ, তখন আমি নিজেকে শান্ত করিতে কি অলটারনেটিভ গালি আবিষ্কার করিব, যে গালিতে আমার হৃদয়খানি একটু জুড়াইবে? কুত্তা, বিলাই, শূয়র কইয়া গালি দিলে কী আর এই জ্বালা জুড়াইবে! তাছাড়া এই প্রাণীগুলোকে তো আমি কখনো ঐ ধর্ষকদের মত জঘন্যরূপে দেখিনি। শুধু শুধু ওদের অপমান করব কেন!

গালি দিয়ে শান্ত হওয়া ছাড়া আমার উপায় কি! আমার তো একাত্তরের মত যুদ্ধের ময়দান নাই যে অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ব! অসির চেয়ে নাকি মসি বড়! তাই মসির (কলম) মাধ্যমেই যুদ্ধ করার চেষ্টা করছি আমরা অনেকেই। কিন্তু লাভ কী! এই কলমের ছোট্ট পিনের খোঁচা কি ঐ অনুর্বর মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছায়, যেখানে লাঙলের ফালও উর্বর করতে পারে না ঐ ঊষর মস্তিষ্ককে! তাহলে উপায়?

দেশের আইন তাই না?

এবার একটু আইনের প্রসঙ্গে বলি।

আইনের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কেন আইন হাতে তুলে নেয়ার মত সিদ্ধান্ত মাথায় কাজ করে তার ব্যাখ্যাটা দিতে হচ্ছে-

ফেসবুকে ধর্ষক কীট আর বাচ্চা মেয়েটার ছবি একসাথে পোস্ট করেছিল অনেকে! ঐ নিষ্পাপ শিশুর পাশে ঐ কিটের ছবি কিছুতেই দেখতে মন সায় দিচ্ছিল না। আমি এই কীটগুলোকে দেখতেই চাই না কখনো, ভীষন একটা ভয় কাজ করে আমার, আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী এরাই। সাপ, জোঁক, কেঁচো, তেলাপোকা, ভূত-প্রেত এসবও আমার কাছে ডাল-ভাত ঐ কীটদের তুলনায়। ওদের দেখার পর ঘৃণায় আমার সারা শরীর শিউরে ওঠে, বমি আসতে থাকে। কয়েকটা দিন ভীষণ অস্বস্তিতে কাটে আমার, ভয়ংকর অস্বস্তি, কিছুতেই চোখ থেকে ঐ কদাকার চেহারাটা সরাতে পারি না, ঘুমাতে পারি না। তাই সাবধানী সংকেত স্বরূপ চোখ দুটো আমাকে বলতে থাকে- প্লিজ এই কীট দেখ না,এই কীট দেখে আমার পবিত্রতা নষ্ট করো না, আমার শান্তি কেড়ে নিও না। আমি চোখের সতর্কতা শুনতে চেষ্টা করি, কারণ চোখের প্রভাব যে আমার সারা দেহেই পৌঁছে যায় এক নিমিষেই। আমি এড়িয়ে যাই, খুব দ্রুত ফেসবুকের নিউজফিড নিচের দিকে স্ক্রল করি। পত্রিকার পাতা ঝড়ের বেগে উল্টাতে থাকি। কিন্তু হায় ব্যর্থ চেষ্টা! এই বাস্তব ভংয়কর না দেখার উপায় কি আমার আছে! আমাকে কখনো না কখনো দেখতেই হয়!
 
যে আমি অমানবিক যেকোন দৃশ্যে শিশুর মত ভীত হয়ে পড়ি, সেই আমি তখন ভয়ংকররূপে নিজেকে আবিষ্কার করি সেই কীটকে টুকরো টুকরো করে লবণ দিয়ে গরম তেলে ভাজার কাল্পনিক দৃশ্যে! যদি কখনো এমন কোন কীট সামনে পড়ে আমি কী ঐ কাল্পনিক দৃশ্যকে বাস্তবায়িত করে আইন হাতে তুলে নেয়ার অপরাধে খুনী হব? ফাঁসি হবে আমার? আইনানুযায়ী হবে নিশ্চয়ই। যদি আইন এমনই হয় তবে সেই আইন কেন পারে না এমন জঘন্যতা নির্মূল করতে? কেন এমন কোন নজির আমরা দেখি না যাতে কেউ এমন জঘন্য কাজ করার সাহস না পায়? কি যুক্তি খাটবে এখানে? যা বলবে তা আমি জানি। সেই যুক্তির ******............. (আফসোস এখনও গালিটা দিতে পারলাম না! কী সভ্য অপারগ আমি!)

লেখক: সাংবাদিক ও তরুণ লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত