বাংলাদেশের দামাল মেয়েরা

প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০১৮, ০২:১২

‘বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা’ একটা বিহুল ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছ। ‘দামাল মেয়ে’ ব্যাপারটা আমাদের মগজে ঠিক স্থান করে নিতে পারেনি এখনো। ফেইসবুকের নিউজফিডের এক পোস্টে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বলা একটা কথা দেখেছিলাম; কথাটা মোটামুটি এরকম- খারাপ কাজের নিন্দা করলে ভালো কাজের প্রশংসাটাও করা চাই (মোটামুটি বললাম শব্দগুলো ঠিক এগুলো নাও হতে পারে কিন্তু মূল বার্তাটা এই)। মাঝে একবার সমালোচনার ঝড় উঠেছিলো কিশোরী খেলোয়াড়দের অবহেলা ভরে লোকাল বাসে চড়িয়ে বাড়ি ফেরত পাঠানোর সূত্র ধরে। প্রধানমন্ত্রীর কথাটা সে প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে এই লেখার উৎপত্তি সেপ্টেম্বর ২০১৬তে। প্রাসঙ্গিকভাবেই ব্যাখ্যায় আমার কাজের অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে।

২০১৫ সালের মে মাসে নওগাঁর সাপাহার উপজেলার পাতাড়ি ইউনিয়নের দুটো গ্রামে গিয়েছিলাম শিশু বিবাহ বিষয়ক এক গবেষণার কাজে। ওখানকার চিত্র অন্য যেকোনো প্রত্যন্ত এলাকার চেয়ে ভিন্ন। গ্রামগুলো যেমন ২০ বছর কি তারও আগের গ্রামের মতোন ছায়ায় ঘেরা; তেমনি গোয়াল, গরু, খড়ের গাদা, মহিষের গাড়ি, গাড়িয়াল, কৃষকের মাথাল এগুলো দৈনন্দিন জীবনের অংশ এখনো। সাথে যোগ হয়েছে কলম করে বাণিজ্যিকভাবে আম বাগান করার প্রচলন। হাতের নাগালে অহরহ আম ঝুলে থাকে, কেউ পেড়ে নেয় না। স্কুলের শিশুরাও না। এ নিয়ম বেশ পোক্ত। মন ভালো করা আমেজ! 

এই এলাকারই আরেক চিত্র হলো এখানে মেয়ে শিশুদের বিয়ে হওয়া শুরু হয় ছয়-সাত বছর বয়স থেকে। ছেলেদের শুরু হয় চৌদ্দ-পনেরোতে। তবে ছেলেদের ক্ষেত্রে এর হারটা কম। এখানে 'বিয়ে শুরু হয়' কথাটা বলার কারণ হলো একবারে থামে না এই প্রক্রিয়া। এক একজন মেয়ের শিশু অবস্থাতেই অনেক ক্ষেত্রে দুই-তিন বার বিয়ে হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। বিষয় আরো গভীরে, সে প্রসঙ্গে আপাতত যাচ্ছি না। তো, এই এলাকাতেই এক স্কুল শিক্ষকের সাথে কথায় কথায় জানলাম প্রাইমারী স্কুলের মেয়েরা ফুটবলে খুব ভালো করছে।

আনন্দে-বিস্ময়ে উদ্বেল আমি তার কাছেই জানলাম এর রহস্য। জানলাম 'বঙ্গমাতা বেগম ফজিলতুন্নেসা' নামে ফুটবল কাপ চালু হয়েছে প্রাইমারী লেভেলের মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য। এই শিক্ষক খেলাপ্রেমী মানুষ। শিক্ষক সংকট এবং স্থান সংকুলানের অভাবে জর্জরিত এই স্কুলে পড়ানোর চাপের মাঝেও অংকের এই শিক্ষক মেয়েগুলোকে নিয়ে লেগে আছেন যেন তারা উপজেলা পর্যায়ে কাপ জেতে। প্রতিযোগিতা জিতলে স্কুলের সুনাম হয়, আর স্কুলের সুনাম বাড়ানোতে প্রধান শিক্ষক উঠে পড়ে লেগেছেন- সুতরাং তিনিও পরোক্ষ সঙ্গ দিচ্ছেন। পরে আমি গ্রামের শিশুদের সাথে বসে ওদের মুখে শুনলাম ওরা শুধু মেয়েরা মেয়েরা নয়, প্রতিযোগিতায় না হলেও এমনিতে ছেলেদের সাথেও ওরা খেলে একসাথেই। আমি জানতে চাওয়াতে অকপটে উত্তর দিয়েছিলো “ছেলে-মেয়েতে একসাথে ফুটবল খেলা কোনো ব্যাপারই না।” মেয়েদের সাথে খেলায় কিছু ছেলে অনিচ্ছুক হলেও যার সাথে আমি কথা বলেছিলাম তার ধারণা আসলে মেয়েদের সাথে খেলায় 'না পেরে ওঠার ভয়' আছে ওদের মধ্যে! এই কথা বলার ধরনে সেই খেলোয়াড়ের আত্মবিশ্বাস আমার মনে আছে।

এখন বিষয়টা হলো, এমন একটা এলাকায় এ হেন পরিবর্তনের সূত্রপাত হওয়ার পেছনে মেয়েদের জন্য এই কাপ চালু করার বিশাল অবদান আছে। পরিবার, সমাজ পাল্টাতে এক একজন মানুষের অবদান অবশ্যই জরুরী, কিন্তু সরকারের একটা উদ্যোগ এই যাত্রাকে অনেকগুণ গতিশীল করতে পারে। অনেক সময় সিস্টেমে ফেলে ঘাড় ধরেই সিঁধে করে ফেলতে পারে। তাই হচ্ছে এখন। সাধুবাদ দিতে কার্পণ্য করবো না এজন্যে।

আমার একটু মন খারাপ হয়েছিলো এটা শুনে যে হাই স্কুলে উঠলে এই মেয়েগুলির আর কোনো সুযোগ নেই। আর পরিবার তো তখন একাই একশ' বাধ সাধতে। কিন্তু শুরু যে হয়েছে এই বা কম কী? ৬-১৩ যেখানে বিয়ের বয়স, সেখানে প্রাইমারী লেভেলের মেয়েদের ফুটবল খেলায় আনা গেলে অন্যান্য এলাকায় হাই স্কুলের মেয়েদের আনা যাবে না কেন? পরিবর্তন এদেশে গ্রাম থেকেই আসবে। কারণ ওদের সাহস অদম্য। ওদের হাতে দশটা পাঁচটা অপশন নেই। ওদের তাই এগোনোর সিদ্ধান্তই সম্বল। ঢাকা শহরে সাইকেল চালায় এমন মেয়ে এখনো নগন্য। অথচ আমি ২০১০ সালে রংপুরের বদরগঞ্জ, উলিপুর এলাকায় মেয়েদের সাইকেল চালাতে দেখেছি। সাইকেল চালিয়ে মেয়েরা স্কুলে, কলেজে যায়। আর মাঠ পর্যায়ে এনজিওতে কাজ করা নারীরা তো দুর্দান্ত! বিশ-ত্রিশ বছর আগেও তারা মোটরবাইক চালিয়ে দুর্বার গতিতে কাজ করে গেছেন গ্রামে গঞ্জে। গ্রামের মোড়লদের লাইফ থ্রেট কোনো অলীক ঘটনা ছিল না তাদের জন্য। আজকের এই দিনের সাহসী আর দুর্বার মেয়েগুলোর অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করেছেন এই নারীরা। আমি নিজেও এখনো অনুপ্রেরণা পাই তাদের কাছে। 

সেদিন কিশোরী ফুটবলারদের খেলা শেষে অবহেলা ভরে লোকাল বাসে ফেরত পাঠানোর ঘটনায় আমার লজ্জা আর রাগ হয়েছে, কারণ এই নয় যে মেয়েগুলিকে অকূল পাথারে ফেলা হয়েছে। আমি জানি এদের হেলাফেলা করে হারানো যাবে না। ওরা শিখে গেছে কিভাবে স্রোতের বিপরীতে এগোতে হয়। রাগ হয়েছে কারণ দায় ছিলো, দায়িত্বে অবহেলা হয়েছে। এতো চমৎকার একটা উদ্যোগে কালি ঢালার সুযোগ তৈরী হয়েছে। এতো চমৎকার অভিজ্ঞতার পর ক্লান্ত দেহেও ওদের এই সমাজের নোংরামী পেরিয়ে ঘরে ফিরতে হয়েছে। তবু এটাও আমি দেখতে পাচ্ছি, ছোট্ট কিন্তু চমৎকার একটা উদ্যোগ ওদেরকে দেখিয়ে দিয়েছে মাঠটাতে ওদের অধিকার আছে। ওদের পায়ে ওদের নিয়ন্ত্রণ আছে। অন্য অনেকের উপর ওদের প্রভাব আছে। ওরা এখন খেলোয়াড়। ওরা এখন মাঠে ছুটে বেড়ায়। ওরা এখন স্বপ্ন দেখছে, আর স্বপ্ন দেখাচ্ছে।

কিছু দাবি আছে এতোগুলি কথা শেষে। প্রথমত, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে খেলাধূলায় আগ্রহীদের প্রাধান্য দেওয়া হোক, সেই সাথে খেলাধূলায় মেয়েদের প্রতি বৈষম্যহীন চিন্তাভাবনার বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হোক। দ্বিতীয়ত, বঙ্গমাতা ফজিলতুন্নেসা ফুটবল কাপে অংশগ্রহণের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে উৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হোক (খেলার শিক্ষক নিয়োগের কথা বলছি না কারণ প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে এখনো পর্যন্ত শিক্ষক সংকট চরমে, এমপিও ভুক্তির তালিকায় অপেক্ষমান অনেকেই)। এই পদক্ষেপ এর সম্পদ শিশুবিয়ে ঠ্যাকানোর প্রকল্প থেকেও আসতে পারে। বিষয়গুলি বিচ্ছিন্ন নয়। তৃতীয়ত, উচ্চবিদ্যালয় পর্যায়ে চালু হোক মেয়েদের ফুটবল প্রতিযোগিতা। সময় হয়েছে এখন, নইলে যারা এতদিন প্রাথমিক পর্যায়ে খেলে স্বপ্ন দেখে এসেছে তাদেরকে দিন শেষে এই বার্তা পেতে হবে যে কৈশোরে পা দিলে বিয়ে এবং সংসারই তার দিনশেষে নিয়তি। সর্বশেষ কথাটি অভিভাবক, শিক্ষক, আয়োজক সবার প্রতি- খেলাধূলা কিংবা যে কোনো প্রতিযোগিতায় ‘এটা ছেলেদের’ আর ‘ওটা মেয়েদের’ এই ধ্যান ধারণার অবসানে মনোযোগ দিন। 

স্বপ্নগুলো ডানা মেলুক দ্বিগুণ শক্তিতে!  

লেখক: উন্নয়নকর্মী

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত