এ দেশেও ভোর নেমে আসুক

প্রকাশ | ১০ জানুয়ারি ২০১৮, ০০:৫৯ | আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৮, ০১:০৭

হালদা মুভি দেখতে যাচ্ছি। বিকেলের টিকেট কেটেছি। বিকেল সাড়ে পাঁচটায়, শ্যামলী সিনেমা হল। সিনেমা দেখতে যাওয়ার সময় থেকেই কেমন যেন সবকিছু অদ্ভুত লাগছে। ঘরটা চেনা না, রাস্তা চেনা না, কেমন জানি অদ্ভুতুড়ে। রিকশা চলছে তো চলছেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত সাড়ে দশটা বাজে। আমি বুঝলাম না, কি করে বিকেল থেকে রাত সাড়ে দশটা হয়ে গেল। এখনো কি মুভি চলছে নাকি? আমি দেখলাম প্রচুর মানুষ সিনেমা হলের আশপাশটায়, যেন কিসের উৎসব। নাহ মানুষ আছে, মানুষ থাকলে আর কোন সমস্যা নেই। আমি সিনেমা হলে ঢুকলাম। হল ভর্তি দর্শক। বাহ! এতো মানুষ এসেছে! কিন্তু অনেক বেশি মানুষ মনে হচ্ছে, কেমন যেন গিজ গিজ করছে। আমি আমার সিট খুঁজে বসে পড়লাম। মানুষগুলো বেশ পরিচিত লাগছে। কেমন করে সবাইকে এতো চেনা লাগছে বুঝতে পারলাম না। কারণ কি? এদেরকে ফেসবুকে দেখেছি? হয়ত, কিন্তু এতো মানুষ একসাথে পরিচিত লাগছে কেন বুঝতে পারছি না। আমি হালদা দেখতে এসেছি, মানুষ, প্রকৃতি জীবন সংগ্রাম আর স্বপ্নের গল্প নিয়ে হালদা ছবি।

আশেপাশের মানুষের কথা শুনছি। খুব বেশি কথা বলছে। কেমন জানি বাজার বানিয়ে ফেলেছে। হলের আলো কমানো। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আমার পেছনে বসা এক ভদ্র লোক, উচ্চস্বরে মোবাইলে কথা বলছে। নিশ্চয়ই কোন ব্যবসার কথা, বলেই যাচ্ছে, এক কথা, ও দিকে বন্যার কি অবস্থা, আমি তো এই অবস্থায় ওখানে যেতেও পারবো না, বুঝতেই পারছো কি অবস্থায় এসেছি এখানে ইত্যাদি। আর ডান দিকের কিছু দূরে বেশ কয়েকজন লোক, তাদের মধ্যে বেশ জ্ঞানী কথা বার্তা চলছে। তাদের মধ্যে একজন বলল, আরে না এই বাংলা চলচ্চিত্র জগত দেখবেন ঘুরে দাঁড়াবে, তাই তো এই মুভি দেখতে এসেছি। আরেকজন বলল যে, মুভির হাত থাকলেই হয় না, দেশ সমাজ রাষ্ট্রের প্রতি একটা কমিটমেন্ট থাকতে হয়, নইলে তো জানেনই সেই পপুলার লাইনটা, সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে, হাহাহাহা।

বাম দিকের পাশের এক জায়গা থেকে এক বাচ্চা বার বার করে বলছে, আমাকে কেন এনেছো, বাসায় যাবো, বাসায় যাব্বোওওওও ... উফ বাবা মা গুলো যে কেন বোঝে না। শিশুরা সিনেমার কি বোঝে, এই পিচ্চিগুলোকে নিয়ে কেন আসে সিনেমা হলে। আর আমার পাশে বসা এক যুবক, বার বার কাকে যেন টেক্সট করছে, একটা চোখে পড়ল, ম্যাসেজে লেখা বাবু খাইছ? তার হাতের তালুর চাইতে বড় মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠছে তার প্রেম নামা। উফ মুভিটা কখন শুরু হবে।

জাতীয় সঙ্গীতের আগে সিনেমা হলের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো একটা বিজ্ঞাপন, “এখানে সৃজনশীল পদ্ধতিতে, সহনশীল মাত্রায় ঘুষ খাওয়ার উপযুক্ত করে তোলা হয়” হলের দর্শকদের অনেকেই হেসে উঠলো। জাতীয় সঙ্গীতের সুর বেজে উঠলো, আমি দাঁড়ালাম যতক্ষণ সুর বাজলো কোথা থেকে একটা কান্নার আওয়াজ আসতে লাগলো। কেমন যেন ভালো লাগছে না আমার। এই সিনেমা এমন কেন? আমি একা এসে ভুল করেছি। আমার অন্যদিন আসা উচিত ছিল। সিনেমা শুরু হল। একি!! এটা তো হালদা সিনেমা না, কোথায় মোশাররফ করিম, তিশা, জাহিদ হাসান? এরা কারা? এই দৃশ্য তো ছিল না ট্রেইলারে।

এক দলের নেতা হয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক যুবক, আর অন্যদিক থেকে একজন ডায়লগ দিল, কি কুবের মিছিল কিবা? কুবের বলল, এই গণেশ এই দিকে আয়। গণেশ এসে বলল, মাঝি, আমারে নিবা দলে?

নাহ এই সিনেমা আমি দেখতে চাই না। নিশ্চয়ই কোন ঘাপলা আছে। হলে ঢোকার আগে, পপকর্ন কিনতে গিয়ে দেখি একটা মেয়ে বারো তেরো বয়স, সে বলল এখানে পপকর্ন পাওয়া যায় না। আমি বললাম তো চিপ্স দাও, বলল ভাত ছাড়া এখানে কিছুই নাই। আশ্চর্য, নিশ্চয়ই এখানে সমস্যা আছে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে লাগলাম, মোবাইলের লাইট জ্বালাতে গিয়ে দেখি মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। আমাকে সেই পিছনে বসা ভদ্র লোক তার হাতের মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে দিলেন, আমি আঁতকে উঠলাম, আমি ভয়ে আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ভয়ে আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল, আমি কাকে দেখছি, আমি এ কাদের দেখছি! আলো জ্বালিয়ে রাখা ভদ্র লোককে আমি চিনি। তিনি অভিজিৎ রায়, তার পাশে বসে আছে অনন্ত বিজয় দাশ, সাথে রাজীব হায়দার, সাথে নীলয় নীল, সাথে আরেফিন দীপন, আমি ভয়ে আতঙ্কে ছুটে যেতে গিয়ে ডান দিকে বের হতে অদ্ভুত এক আলো জ্বলে উঠলো পুরো হল জুড়ে। সিনেমা আর হচ্ছে না, সব একদম নীরব। সবাই কেমন যেন ভেসে ভেসে যাচ্ছে। ডান দিকে বের হওয়ার রাস্তা ছিল, আমি শরীরের সব শক্তি দিয়ে ছুটে বের হতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম, পায়ে প্রচন্ড চোট পেয়েছি, একজন বলল এই মেয়ে দেখে চলতে পারো না? ব্যাথা পেলে তো। আমি অসম্ভব ভয়ে তাকে বললাম, আমাকে ধরার দরকার নেই, তিনি মমতা নিয়ে বললেন, আরে ভয় পাচ্ছ কেন, আমি প্রাণপণ চেষ্টা করে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়তে লাগলাম, কারণ আমি তাদের সবাইকে চিনে ফেলেছি। আমি জেনে গেছি ধমক দিয়েও আবার আমাকে তুলতে আসা লোকটি ডঃ হুমায়ুন আজাদ, তার পাশে বসে গল্প করছিলেন মিশুক মুনীর আর তারেক মাসুদ। 

আমি দৌড়াচ্ছি কারণ সেই হলভর্তি সমস্ত মৃত মানুষ যাদের এইভাবে মারা যাবার কথা ছিল না। আমি দৌড়াচ্ছি কারণ তাদের নাম আমি জেনে গেছি, ছোট বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বেড়িয়ে যেতে চেয়েছিল যে সে মিঠুন চাকমা, যে মেয়েটি আমাকে পপকর্ন না দিয়ে ভাত দিতে চেয়েছিল সে কণিকা। আমার হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে, আমি তবুও প্রচন্ড জোরে ছুটতে চাইছি কারণ, আমার মনে পড়েছে হলে ঢোকার মুখে যে দুটি মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের একজন রূপা। তাদের সাথে নিশ্চয়ই আছে তনু, এবং নিশ্চয়ই একই সাথে বসে ছিল শাজনীন আর সুখিয়া রবি দাস। আমার পায়ে প্রচন্ড চোট লেগেছে। আমার গলা শুকিয়ে আসছে। আমার ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের নখ উলটে গেছে, ইস কি কষ্ট! কি কষ্ট! আমি দৌড়াতে পারছি না।

আমি ছুটছি, ছুটছি, আমি বাঁচার লোভে ছুটছি। তবুও আমি নির্লজ্জের মতো বাঁচার লোভে ছুটছি। আমার মস্তিষ্ক আমাকে ছুটতে বলছে, আমার নিউরন থেকে আমাকে সিগন্যাল দিয়েছে, বারবার করে বলছে, তবুও বাঁচতে হয়, তবুও মানুষ বেঁচে থাকে। আর পেছন থেকে সারি সারি কন্ঠস্বর আমাকে বলছে, তুমি দৌড়িও না, সাবধানে যাও, তুমি বেঁচে আছ, যেন আমাদের কথা তুমি ওখানে গিয়ে বলতে পারো।

আমি হঠাৎ একটু শান্ত হলাম। সামনে আমার চেনা রাস্তা দেখতে পাচ্ছি। আমি শেষ বারের মতো সবাইকে একটু দেখে নিতে গেলাম, এবং হোঁচট খেয়ে আবারো পড়ে গেলাম, হঠাৎ আমার কানের কাছে এসে কে যেন বলে চলে গেল, বলল ব্যাথা পেয়েছো? আদর সোনা।

আমার ঘুম ভাঙ্গে, আমি দেখি আমি বাস্তবে আছি, পাশের জানালা খুলে দেই, চুপচাপ এক ভোর, আমার ঘরে এসে বসে।

এ দেশেও ভোর নেমে আসুক। ভোর নামুক প্রতিটি দুঃস্বপ্নে।

লেখক: আইনজীবী