শিক্ষক- দেখা এবং হয়ে ওঠা

প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০১৭, ২০:২১

পড়েছি অগ্রণী স্কুল এন্ড কলেজে। ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাবার পরে ২০০১ এ যখন স্কুলটাতে মা আগ্রহ নিয়ে ভর্তি করিয়েছিলেন তখনো বেশ নাম করা স্কুল ছিল ওটা। ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু নামের সাথে ভেসে যাচ্ছিল স্কুলের সহ শিক্ষা কার্যকলাপ। নৈতিক শিক্ষা সহ বেশিরভাগ শিক্ষকই জানতেন না কীভাবে ছাত্রীদের সাথে আচরণ করতে হয়। কেউ কেউ তো ছাত্রীদের যৌনহেনস্তা করে ছাড়তেন। (তেমনই একজন ছিলেন ইংরেজির বাবুল স্যার। তার সুনাম ছিল ছাত্রীদের পিঠে হাত দিয়ে ব্রার অস্তিত্ব বুঝে নেয়ায়। এ নিয়ে যথেষ্ট মিটিং মিছিলের পরেও বদমাসশটা শিক্ষক হিসেবে এখনও বহাল আছে। স্কুল কর্তৃপক্ষকে যথেষ্ট উদার বলতে হবে এজন্যে) 

ছাত্র ভুল করবেই সেই ভুল নিয়ে খ্যাঁচখেঁচি না করে তাকে বুঝিয়ে বললেই সে ভুল বুঝতে পেরে শুধরে নেবে নিজেকে। নামকা ওয়াস্তে ক্লাস নিয়ে আর এর ওর বিরুদ্ধে কথা বলা ছিল তাদের নিত্যদিনের সুঅভ্যাস। ক্লাস ভর্তি ছাত্রীদের সামনে তাদেরই কোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অপলাপ যে বাচ্চাদের ভালো কিছুই শেখায় না তা তারা বুঝতে পারতেন না। ক্রুদ্ধ হলেই অনেকে আবার মা-বাবা পরিবার জড়িয়ে বাজে কথা বলতেও ছাড়তেন না।

দুজন শিক্ষক আমার মারাত্মক পছন্দের ছিলেন। স্কুল সেকশনের শামিম আক্তার আপা আর কলেজ সেকশনের শিল্পি আপা। এই দুজন আমাকে শিখিয়েছিলেন বই পড়া, নেতৃত্ব, শুভ বোধগুলোকে জাগ্রত করতে। আমি যখন স্কুলের একাডেমিক পড়ায় ক্লান্ত হয়ে যেতাম শামিম আপা তখন বলে দিতেন কোন কোন বই পড়তে হবে ক্লাসের ফাঁকেফাঁকে। শিল্পি আপা তার উচ্চারণের জন্যে প্রথম প্রথম আমার পছন্দের তালিকায় ছিলেন না। কিন্তু শুভবোধের স্পর্শ পেয়ে ঐ উচ্চারণজনিত আক্ষেপ কবে কেটে গিয়েছিল মিসের ক্লাসে। মিস শেখাতেন ভালোবাসতে, একাডেমিকের বাইরের জগত কতটা সুন্দরভাবে আয়ত্বে আনতে হবে। টেস্টের ফলাফলে ৪.৩৭ পেয়েছিলাম শুনে মিসের মুখটা চুপসে গেল কেমন। বললেন "তোমার কাছ থেকে এর চাইতেও বেশি কিছু আশা করি।" আমি মন খারাপ করে বাসায় গিয়েছিলাম। এর উত্তরটা দিয়েছিলাম এসএসসি হল টেস্টে।

দশ বছরের স্কুলের স্মৃতিতে মাত্র দুজন মানুষ ভাস্বর তাদের মননের ঔদার্যে। বাকিরা ভেসে গেছেন বিস্মৃতির স্রোতে।

হলি ক্রস কলেজ আমাকে একটা বিশাল ভিত্তিপ্রস্তরস্থাপন করে দিয়েছে একাদশ শ্রেণিতে। সেটা নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের। ঐ ভিত্তিটা আমি আজো লালন করছি যত্নসহকারে। কলেজের শিক্ষকেরা আমার কতটা প্রিয় তা বলে বোঝানো যাবে না। আইডি স্যারের 'কটকটি' নিউটন স্যারের 'আম্মা' ডাকগুলো অদ্ভুর আদরে ভরা। জীবনে কলেজে উঠেই প্রথম জেনেছিলাম অফিসিয়ালি 'তুই'ও ব্যবহার করা যায় নির্বিঘ্নে। যেটা আইডি স্যার, নিউটন স্যার করতেন সবসময়। উমা মিস ভীষণ প্রিয় ছিলেন আচরণের জন্যে।

ব্যক্তিগত জীবনে আমি একজন শিক্ষক। ছাত্রছাত্রী সবাই আমার কাছে সমান। বয়সের খুব বেশি পার্থক্য না হওয়ায় তাদের কাছে আমি কখনো বোন, কখনো বন্ধুর মত। আমি তাদের পড়ানোর ফাঁকেফাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করি আমাদের শুভবোধের জাগরণ, আমাদের আচরণের বর্ণবাদ যেটা চাইলেই আমরা বাদ দিতে পারি। আমি তাদের কাছে মননের গার্বেজ সেন্টার। যেটা তারা কাউকে বলতে পারে না সেটা তারা নির্বিঘ্নে বলতে পারবে আমাকে। আমি মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনবো। শুনে তাকে জিজ্ঞেস করবো তারা আমার কাছ থেকে কিছু শুনতে চায় কিনা। যদি না চায় তাহলে শুনেই আমি চুপ করে থাকবো। যদি চায় তাহলে ঠিক কী শুনতে চায় জেনে আমি কথা বলা শুরু করি যাতে খুব স্পর্শকাতর বিষয়েও তাদের কোন কষ্ট না লাগে। কলেজের উমা মিসের একটা বৈশিষ্ট্য ভয়াবহ অনুসরণ করি সেটা হল ধৈর্য। আমি কখনোই ছাত্রদের উপরে রেগে যাই না। একবার না বুঝলে বারবার বোঝাব তবুও রাগ হওয়া যাবে না বাচ্চাদের উপরে। প্রথম প্রথম কষ্ট হলেও বোঝাতে আমার ভালোই লাগে এখন। 

আমার খুব মনে হয় এরকম একজন শিক্ষক পেলে আমার ছোটবেলাটা কাটতো আনন্দময় হয়ে। আমি পাই নি তাই হয়ে উঠি বরং!
শিক্ষকদের শুধু কাগজে কলমে শিক্ষক হলে চলে না, শিক্ষক হয়ে ওঠা লাগে মননে।
জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক। ভালোবাসা সবার জন্যে!

লেখক: জাবি শিক্ষার্থী ও সমাজকর্মী

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত