দেনমোহরের নীল চুক্তিতে সম্মান কই?

প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০১৭, ২২:৩৭

পাঁচ–দশ–বিশ-পঞ্চাশ লাখ দেনমোহরের নিলামে উঠে যখন তুমি মাথা নিচু করে স্বাক্ষর করো নীল কাবিনের চুক্তিতে, তখন কি তুমি বুঝতে পারো, তুমি আসলে দাসখত লিখছো নিজের জীবনের? পণ্য বললে তোমার গায়ে লাগে? ওই টাকার বিনিময়েই তো নারী তুমি 'হালাল' করেছো পুরুষের কাছে।

লাখ টাকার মোহর আর চলতি বাজারদরে খোরপোষের বিনিময়ে পুরুষ কিনে নিয়েছে তোমার শরীরের উপর তার নিরঙ্কুশ অধিকার। শরীর, মন, সেবা...চাওয়া মাত্র দিতে বাধ্য তুমি। তুমি তখন কেবলই বিকিকিনির হাটে উঠা মুলো, মাছ...আর মানুষ হলে খুব জোর অর্ধাঙ্গিনী বৈ কিছু নও তো!!

দেনমোহরের চুক্তি নারীকে আসলেই কতটুকু সম্মানিত করেছে তা বুঝতে হলে তোমাকে বুঝতে হবে ঐ নীল কাগজের প্রতিটি কলামে ছড়িয়ে থাকা বৈষম্য আর পুরুষতন্ত্রের চোরাগলি। তোমাকে জানতে হবে 'চুক্তি', 'বিয়ে' এবং 'দেনমোহর' আসলে কী।

চুক্তি আইন অনুযায়ী, একজন সুস্থ মস্তিস্ক, আইনের দৃষ্টিতে সাবালক ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে কোন বস্তু বা অর্থের বিনিময়ে লিখিত অঙ্গিকারাবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়াকে চুক্তি বলে। প্রত্যেক চুক্তিতে একপক্ষ প্রস্তাব করে এবং অন্য পক্ষ প্রস্তাব গ্রহণ করে কোন কিছু প্রতিদান করে।

"মুসলিম পারিবারিক আইনে বিয়ে একটি দেওয়ানি চুক্তি। এর মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন ও সন্তান জন্মদানের অধিকার পায়। একটি পূর্ণাঙ্গ বিয়ের চুক্তির জন্য যে সব শর্ত পুরণ করতে হয় তা হলো, বয়স, সম্মতি, দেনমোহর, সাক্ষী, এবং নিবন্ধন।"

খেয়াল করো, এখানে বয়স, সম্মতি, সাক্ষী এবং নিবন্ধন এই শর্তগুলো নারী-পুরুষ উভয় পক্ষকেই পালন করতে হয়। শুধুমাত্র 'দেনমোহর' ই একমাত্র শর্ত যা শুধু পুরুষকে পালন করতে হয়। বিয়ের চুক্তি তো নারী-পুরুষ দুই পক্ষের চুক্তি। তবে, কাবিনের ১৩ নং কলামে যখন চুক্তির একপক্ষ দেনমোহরের ঘরে তোমার মূল্য লিখে তখন অন্যপক্ষ তুমি কী লিখো? সম্ভ্রম?? শরীরের মালিকানা??

চুক্তি আইন অনুযায়ী, প্রতিদান ব্যতিত কোন চুক্তি কার্যকর হয় না। আমি যদি ধরে নিই, দেনমোহর হলো সেই প্রতিদান, তাহলে তা কিসের বিনিময়ে? তোমার জীবন নয় তো? বিয়ে নামক চুক্তির ফলে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের অধিকার তো নারী-পুরুষ দু’জনেই পায়, তবে মূল্য কেন পরিশোধ করতে হয় একজনকে? কেন দেওয়ার অধিকার বা ক্ষমতা শুধু পুরুষের? এই দাতা ভূমিকার সাথে পুরুষতন্ত্রের ক্ষমতাচর্চার কোন যোগসুত্র পাও?

তুমি মনে করো দেনমোহরের অংক তোমার সম্মান দেয়। কারণ, সারাজীবন তোমাকে শেখানো হয়েছে, এই দেনমোহর তোমার অধিকার, তোমার আর্থিক নিরাপত্তা দিয়েছে!! ওই নীল কাবিনে নীল হতে হতে একবার ভাবো তো মোহরের বিনিময়ে করা ওই চুক্তি তোমাদের দুজন মানুষকে আসলেই সমতার মর্যাদা দিয়েছে কিনা? দাতা গ্রহিতার চুক্তিতে আদৌ কি সমতা আসে?

এই পুরুষতান্ত্রিক স্কুলিংয়ে তুমি কখনো ভাবতেই শেখোনি যে, দেনমোহর যদি সম্মানের হয়, তবে সে সম্মান দুজনেরই সমান নয় কেন! পুরুষ দেনমোহর দিয়ে তোমাকে সম্মানিত করে, তুমি পুরুষকে কী দিয়ে সম্মান করো? পুরুষ চলতি বাজার মূল্যে তোমাকে ভরনপোষণ দিল, তুমি পুরুষকে কি দিলে? বিক্রি হবার দায় কি কেবল তোমার, শুধু 'ইজ্জত দায়গ্রস্থ' মেয়ে বলেই?

একবার ভাবো তো, সম্পর্কের ভিত্তি আসলে কী? ভালোবাসা, পারস্পরিক সম্মানবোধ, নাকি দেনমোহরের টাকা পরিশোধের ভয়? লক্ষ টাকার মোহরের বিনিময়ে যে সম্পর্কের ভিত্তি মজবুত করতে হয়, সে সম্পর্কে আদৌ পরস্পরের আস্থা আর কমিটমেন্ট থাকে?

নিজেকে বেচাকেনার নিক্তিপাল্লায় তুলে সুখী নারীর ব্রান্ডিং করা নারীদেরকে কিছু বলার নেই আমার। কিন্তু সম অধিকার চাওয়া নারী, তুমি বলো সমান অধিকার চাও, সমতার মর্যাদা চাও। কিন্তু তুমি জানো না, অধিকারের সমতা চাইতে গেলে দায়িত্বেও সমতা আনতে হয়। বিশাল অঙ্কের দেনমোহরের মূল্যে ইজ্জত (??) বিক্রি করে সোসাইটিতে গ্রীবা উঁচু করে সে সমতা আসে না। নিজের সম্মান টাকার অংকে বেচে দিয়ে অন্যের কাছে সম্মান আশা করা যায় না।

যদি সাহস থাকে, যদি আসলেই সম মর্যাদা চাও তবে চ্যালেঞ্জ করো ওই পুরুষতান্ত্রিক নীলকাবিনকে। দেনমোহরের ঘরে লিখে দাও 'সমতা'। এটাই হোক তোমার সমতার প্রথম লড়াই। সংসারের সব দায়িত্বে তুমিও হও সমান অংশিদার।

একজন টাকা দিবে, আরেকজন কামলা দিবে, এই সূত্র সমতার নয়। সমতার লড়াই করার আগে তোমাকে জয় করতে হবে নিজেকে। সুতরাং ঐ নীল কাগজের বায়বীয় সম্মানের আশায় বসে না থেকে নিজের জীবনটা নিজের হাতে নাও। অন্যের দেওয়া ভাত কাপড় আর বাজারদরে খোরপোষের জীবনে সম্মান থাকে না ,থাকতে পারে না।

মনে রেখো, শর্টকাট চোরাপথ দিয়ে মুক্তি আসে না। এটা সমুখ সমর। সুতরাং হাইহিল খুলে মাটির উপর শক্ত করে পা রেখে দাঁড়াও। মাটির দিকে তাকিয়ে না থেকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াও। তোতা পাখির মতো মগজে ঢুকিয়ে দেয়া মাইন্ডসেটকে চ্যালেঞ্জ করে সত্যিকারের সম-মর্যাদার আলোয় এসে দাঁড়াও।

এই আলো জমাট অন্ধকারের বুক ফেটে বেরিয়ে এসে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়। এই আলো মুক্তির, এই আলো সমতার। অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসরিত আলো, সে তোমারই আলো......সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো, সে তোমারই আলো।

লেখক: কলামিস্ট ও প্রধান নিরবাহী, সংযোগ বাংলাদেশ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত