আমাদের শিক্ষানীতি: কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা

প্রকাশ : ০৭ অক্টোবর ২০১৭, ০১:২৮

এ বছরটা প্রায় শেষ হয়ে এলো। নতুন বছর শুরুর সাথে সাথে শুরু হয়ে যাবে স্কুলে স্কুলে অসুস্থ ভর্তি বাণিজ্য আর অপ্রয়োজনীয় বই খাতার লিস্টি বাচ্চাদের অভিভাবকদের ধরিয়ে দেয়া। এই দুটোর সাথেই ঘনিষ্ঠভাবে টাকার খেলা জড়িত। রাজধানী কিংবা বাণিজ্য নগরী, এখানে নামী স্কুলগুলিতে বাচ্চাকে ভর্তি করাতে পারা মানে সমাজে মান-সম্মানের দিক থেকে উপরে অবস্থান করা যায়। রীতিমত প্রতিযোগিতা চলে কার বাচ্চা কোন স্কুলে পড়ছে!

প্রথমেই আসি সরকারী স্কুলগুলির কথায়। সেগুলিতে চান্স পেতে কিন্তু এখন থেকেই কোচিং বাণিজ্য বেশ জমজমাট। স্বনামে বিখ্যাত কিছু শিক্ষকবৃন্দের বাসায় কিংবা কোচিং সেন্টারে চলছে মোটা ফি এর বিনিময়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি (প্রতি বছরই চলে)। এই শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণের কাছে পড়ানো মানে হল যে কোন একটায় হলেও মোটামুটি ভর্তি নিশ্চিত। সরকারী স্কুলগুলিতে টিউশন ফি যতটা কম, ঠিক সেই হারেই সরকারী স্কুলগুলির শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানোর ফি বেশি। দেখা যায়, স্কুলের বেতন হয়ত খুবই সামান্য, কিন্তু ভালো রেজাল্টের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে স্কুলের শিক্ষকদের কাছে পড়িয়ে মাস শেষে বেরিয়ে যাচ্ছে বাচ্চা প্রতি আট/দশ হাজার টাকা। দিশেহারা অভিভাবকরা সিস্টেমে পরে অস্থির। কিন্তু কিছুই করার থাকে না। কারণ প্রায় স্কুলগুলিতে সাবজেক্ট টিচারের কাছে পড়তে না গেলে ভালো নম্বর পাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়। আমার সাথে একমত হবেন না এমন অভিভাবক কমই পাওয়া যাবে। এই কথাটা বেসরকারি অনেক স্কুলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

এবার আসি বেসরকারি স্কুলগুলির কথায়। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলিতে প্রতিবছর এডমিশন/ রিএডমিশন এর নামে মোটা অংকের ফি নেয়া হয়। বিভিন্ন রকম নিয়মকানুন সংবলিত সরকারী রুলস আর রেগুলেশন পত্রিকায় নিয়মিত দেখি। কিন্তু সঠিকভাবে তা মনিটর হচ্ছে তা খুব কম দেখতে পাই। প্রশাসনের নাকের ডগায় কিভাবে এরা ভর্তি বাণিজ্যের নামে লক্ষকোটি টাকা হাতিয়ে নেয় তারাই ভালো বলতে পারবে। 

এতো গেলো ভর্তি বাণিজ্য। এবার আসি বইয়ের কথায়। বেসরকারি স্কুলগুলিতে (এন সি) নিয়মিত বোর্ডের সব পড়ানো হয় বাচ্চাদের। এর সাথে প্রতিবছর জুড়ে দেয়া হয় কমপক্ষে চারটি থেকে ছয়টি বাড়তি বই, যা বুক লিস্টির সাথেই অভিভাবকেরা উপহার পেয়ে থাকেন টাকার বিনিময়ে। একে তো এখন বোর্ডের নিয়মিত বইগুলি ব্যাপক বোঝা বাচ্চাদের জন্য, তার উপর বাড়তি আরও কিছু বইয়ের বোঝা। আমরা দিন দিন কোথায় নিয়ে যাচ্ছি এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে, তা আমরা নিজেরাও জানি না। এত পড়ে পড়ে দিন শেষে কি নিদারুণ মেধা শুন্য এক জাতি উপহার দিয়ে যাচ্ছি ভবিষ্যতের জন্য! খুবই পরিতাপ আর আফসোসের বিষয় হল এই ব্যাপারগুলি বুঝেও বুঝছেন না, দেখেও দেখছেন না যাদের দেখার কথা আর বোঝার কথা।

এর আগেও লিখেছিলাম এই ব্যাপার নিয়ে। আমার মত অনেকেই উদ্বিগ্ন, আগেও হয়েছিলেন, এখনও হচ্ছেন। ষষ্ঠ শ্রেণীতে বইয়ের সংখ্যা তেরটি। একটা এগারো কিংবা বার বছরের বাচ্চাকে এই তেরটি বই শিক্ষা ব্যবস্থার অসুস্থ অবস্থার শিকার হয়ে জোরপূর্বক গিলতে হয়। এভাবে সপ্তম, অষ্টম আর নবম/দশম শ্রেণীতেও অহেতুক অনেক বিষয়ের বোঝা বাচ্চাদের কলুর বলদের মত অনিচ্ছা সত্ত্বেও টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছে। সেইসাথে দেখেছিলাম এই বছর ইচ্ছেমত বইগুলিতে পরিবর্তন কিংবা পরিবর্ধন করা হয়েছিল। একটু এখানে বলতে চাই, নবম/দশম শ্রেণীর কথা। যে বাচ্চাটি বিজ্ঞান বিভাগ বেছে নিচ্ছে সে সমাজবিজ্ঞান পড়তে চায় না বলেই বেছে নিচ্ছে। আবার যে বাচ্চাটি মানবিক বিভাগে যাচ্ছে সে বিজ্ঞান পড়তে অনিচ্ছুক বলেই যাচ্ছে সেখানে। একই কথা প্রযোজ্য বাণিজ্য বিভাগ বেছে নেয়া বাচ্চাটার জন্য। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, এই প্রতিটা বিভাগের বাচ্চারা এখন জোরপূর্বক মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে সব বিষয়ে পারদর্শী হচ্ছে!! 

এইগুলির সাথে আছে আরও উদ্ভট কিছু বিষয়। ফিজিক্যাল এডুকেশন কিংবা ক্যারিয়ার এডুকেশন পড়িয়ে সব বাচ্চাকে খেলোয়াড় আর ক্যারিয়ার বিশেষজ্ঞ বানানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা ঢাকতে যে নিয়ম বোর্ড থেকে জারি করা হয়েছে, তা রীতিমত হাস্যকর। এখন বাচ্চারা এই বিষয়গুলির বোর্ড পরীক্ষা দেবে না, কিন্তু তাদের হয়ে শিক্ষকগণ কিছু ক্যাটাগরিতে মার্কস যোগ করে বোর্ডে পাঠাবেন। যদিও এই মার্কস তাদের রেজাল্টে কোন ভূমিকা রাখবে না। একসাথে তুলে দিল না বিষয়গুলি ঝুলিয়ে রাখল, কারণ বছরের শুরুতে গাইডবই বাবদ যে টাকা মাননীয়রা হজম করে ফেলেছেন তা হালাল থাকবে না শেষ মুহূর্তে। তবে একটা অনুরোধ করতেই পারি, যদিও শুনার কেউ নাই। এইসব ফালতু বিষয়গুলি বাদ দিয়ে তার জায়গায় মোরাল এডুকেশন চালু করা এখন সময়ের দাবী। এতে অন্তত জাতি রোবট একটা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম থেকে রক্ষা পাবে আশা করা যায়।

আসলে আর কতই লিখব। আমরা সাধারণ জনতা এইসব মেনে নিবো বিনা বাক্য ব্যয়ে। কারণ আমাদের কথা শুনার কেউ নাই, এইসব অব্যবস্থাপনা দেখার কেউ নাই। আমাদের পকেটে লাল/নীল/হলুদ পয়সাও নাই যে বাচ্চাকে বাইরে পড়তে পাঠিয়ে দিব। না আছে উপরি কামাই যে চুপচাপ হজমও করব। তাই বুকে ব্যথা হয়। শিক্ষা ব্যবস্থার বেহাল অবস্থা দেখে কষ্টে জর্জরিত হই। আর ভাবি দুনিয়া কত এগিয়ে গেছে, মেধা আর মননে। বাইরের দেশগুলিতে বাচ্চাদের আগ্রহ অনুযায়ী বিষয়গুলিতে পড়তে উৎসাহ আর সাহায্য সহযোগিতা করা হয়। আর আমরা?! প্রতিনিয়ত চাপিয়ে দিচ্ছি অহেতুক অপ্রয়োজনীয় বইয়ের বোঝা। যেখানে প্রতিদিন বাচ্চা বাসায় ফিরে বলছে, কাঁধ ব্যথা করে। পড়তে পড়তে পড়া শেষ হয় না, রাত ফুরায়। বাচ্চার পরীক্ষার সময় নির্ঘুম রাত পার করে বাবা-মা। পরীক্ষায় ফেল করার লজ্জায় নিজের ফুলের মত প্রাণ বাচ্চা নিজেই কেড়ে নেয়। আর কত সইবো এসব? কেনই বা সইবো? আমাদের কথা ভাবার বা দেখার কি কাউকে পাশে পাবো?

লেখক: শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত