নারীবাদ মানেই পুরুষের অপ্রিয় হওয়া নয়

প্রকাশ | ০১ আগস্ট ২০১৭, ২৩:০২ | আপডেট: ০১ আগস্ট ২০১৭, ২৩:৩৮

প্রিয় ফেরদৌসি বিকন, আপনার ‘যে নারী পুরুষের প্রিয় হতে পারে না, সে হয়ে ওঠে নারীবাদী’ লেখাটি পড়ে মর্মাহত হলাম। আপনার লেখনী নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার, আপনার ব্যাখ্যা করার কৌশলও প্রশংসনীয়। লেখার বেশ কিছু বক্তব্যের সাথেও আমি একমত কিন্তু আপনার লেখার শিরোনামটি এবং লেখার সার্বিক বক্তব্য আমাকে শুধু হতচকিত নয়, ব্যথিত করেছে।

এখন এখানে গভীর রাত। আমার প্রিয়তম পুরুষ, যার কাছে আমি প্রিয়তমা নারী, দূরদেশে যাত্রা করেছেন। এই নিয়ে আমি মানসিক এবং বাস্তবিকভাবেই অত্যন্ত নিবিষ্ট। কাজেই আপনার প্রতিটি আপত্তিকর মন্তব্যের পাল্টা জবাব এই মুহুর্তে গুছিয়ে দিতে পারছি না। শুধু কয়েকটি কথা বলতে চাই।

প্রথমত, আপনার শিরোনামটির কথা ধরা যাক। যে নারী পুরুষের প্রিয় হতে পারে না, সে ই হয় নারীবাদী- এই কথাটি বলার আগে ‘নারীবাদ’ বা ‘নারীবাদী’ শব্দ দু’টোর অর্থ আপনি ভেবে দেখেছেন কি? 

নারীবাদের সহজ অর্থ হচ্ছে সামাজিক জীব হিসেবে সমাজে বসবাসের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান মর্যাদা ও অধিকারের বিশ্বাস। একজন সুবিধাভোগী নারী হিসেবে এসব বড় বড় কথা বলার সময় আপনার মত নারীরা সেইসব নারীদের কথা ভুলে যান যারা এখনো পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার যাতাকলে পিষ্ট, নির্যাতিত। আপনার প্রয়োজন না হতে পারে, সেসব নারীদের মুক্তির জন্য নারীবাদের প্রয়োজনের কথা সচেতন মানুষ মাত্রই স্বীকার করবেন।

মানুষ বুদ্ধিভিত্তিক প্রাণী হিসাবে গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠিত বাড়তি অধিকার নারী বা পুরুষ উভয়ের জন্যই লজ্জাজনক। নারীর শারিরীক শক্তি বেশি হলে হয়তো নারীই নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে পুরুষকে নির্যাতন করতো একথা মেনে নিয়েই বলছি, সেক্ষেত্রে পুরুষের পক্ষ নিয়ে আন্দোলনের প্রয়োজন পড়তো। কিন্তু যেহেতু পরিস্থিতি তেমন নয়, সেহেতু এ জাতীয় লেখা বর্তমান সময়ের দাবী নয়। পুরুষের গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠিত বাড়তি অধিকারের পক্ষে সাফাই গেয়ে আপনি কী অর্জনের চেষ্টা করছেন তা বুঝতে কষ্ট হয় না।

আপনি আগে নারীবাদী ছিলেন, কিন্তু এখন উচ্চতর মানসিকতায় পৌঁছে নারীবাদের কলঙ্ক থেকে মুক্ত হয়েছেন জেনে আনন্দিত হলাম। ভাল কথা, কিন্তু আমরা যারা এখনো আপনার মত উচ্চতায় পৌঁছুতে পারিনি এবং নারীর সম অধিকারের কথা বলে যাচ্ছি তারা ‘পুরুষের প্রিয়’ হতে পারিনি বলেই এমনটা করছি একথা বলার ধৃষ্টতা আপনার কী করে হলো? ঠুনকো বাহবা আর হাতে তালি থেকে?

আমি অল্পবয়সে নারীবাদী ছিলাম, এখনো নারীবাদী আছি, এবং খুব সম্ভব মৃত্যু পর্যন্ত আপনার মত মানসিক উচ্চতায় পৌঁছুতে পারব না বিধায় নারীবাদীই থাকব। কিন্তু আমার এই অবস্থানের হেতু এই নয় যে আমি পুরুষের প্রিয় হতে পারিনি। স্কুলে আমার প্রিয় বন্ধুদের অনেকেই ছিল ছেলে যাদের সাথে আমি হাডুডু খেলতাম, ধান ক্ষেতে গামছা পেতে পুঁটি মাছ ধরতাম। এখনো আমার বন্ধু মহলের অনেকেই পুরুষ যারা আমার ততটুকুই প্রিয় যতটুকু আমি তাদের। নারীবাদের অর্থ যে পুরুষ-বিদ্বেষ নয়, পুরুষকে অসম্মান করা নয়, পুরুষের অপ্রিয় হওয়া নয়- বিশেষ মানসিক উচ্চতায় পৌঁছুলে এই সামান্য বিষয়টুকুর বোধ হারিয়ে ফেলতে হয় তা আজ প্রথম জানলাম। আমার বন্ধু তালিকার অনেক পুরুষও কিন্তু নারীবাদী। তারাও কি পুরুষদের অপ্রিয় হয়ে নারীবাদী হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? বড় জানতে ইচ্ছা করছে।

আপনি যখন কিছু গবেট মার্কা পুরুষের কাছে নিজেকে প্রিয় করে তোলার সস্তা কলাকৌশলে ব্যস্ত আমরা তখন সুবিধা-বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে কাছে পেয়েছি অসংখ্য বুদ্ধিমান সমাজ সচেতন পুরুষকে যাদের কাছে আমরা খুব একটা কম প্রিয় নই।

দ্বিতীয়ত, আপনি বলেছেন ‘যে নারী পুরুষের প্রিয় হতে চায় না, পারে না অথবা পুরুষের পেছনে লেগে থাকে সে হয় নারীবাদী, নয় হিজড়া।’ বাহ, কী চমৎকার মানবিকতা আপনার! নারীবাদীদের অপমান করতে গিয়ে ‘হিজড়া’ শব্দটি ব্যবহার করে আপনি হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন যা অত্যন্ত আপত্তিকর। আমি ধরেই নিচ্ছি আপনি জানেন না জন্মগতভাবেই কিছু মানুষ হিজড়া হয়। প্রকৃতির খেয়ালে নারী-পুরুষের মাঝামাঝি একটা লিঙ্গ পরিচিতি নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় তাদেরকে, সহ্য করতে হয় নানা রকম সামাজিক অবহেলা এবং নির্যাতন যার ফলে তারা নিজেরাই একসময় টিকে থাকার প্রচেষ্টায় এগ্রেসিভ হয়ে যেতে বাধ্য হয়। সভ্য সমাজ থেকে নির্বাসিত এই সম্প্রদায়ের মধ্যে একসময় বিকৃত মানসিকতার সৃষ্টি হয় যার জন্য সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিই দায়ী। আর আপনি আজ সেই সমাজেরই একজন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন।

আমার মত নারীবাদীরা শুধু নারীর অধিকার নিয়েই কথা বলে না, ‘হিজড়া’ দের মত সুবিধাবঞ্চিতদের সামাজিক অধিকার নিয়েও কথা বলে। সেই হিসেবে আপনি আরো একবার আমাকে ‘হিজড়া’ বলে গালি দিতে পারেন নিঃসন্দেহে। তবে এতে করে সামাজিক সমস্যাগুলো সম্পর্কে আপনার অজ্ঞতাই প্রকাশ পায়। ‘হিজড়া’, ‘বেশ্যা’ এগুলো যে গালি হতে পারে না সেটা আপনার মত উচ্চস্তরের জীবকে আমি কী করে বোঝাব?

আপনি যে ধরণের লিখা লিখছেন তাতে করে আপনি প্রচুর হাতে তালি পাবেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দাস নারী এবং পুরুষরা আপনার লেখায় স্বস্তি খুঁজে পাবে, আপনাকে আরো বেশি করে লেখার উৎসাহ দিয়ে যাবে। আপনিও আপনার শাণিত লেখনী চালিয়ে যাবেন কিন্তু সমাজ পরিবর্তনে বা সুবিধাবঞ্চিতদের অধিকার আদায়ে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবেন সে বিষয়ে আমি সন্দিহান। কারণ আপনি যে গাছে পানি ঢালছেন সেটা একটা প্রতিষ্ঠিত বটগাছ যা আপনার যত্ন ছাড়াও নিচের চারাগাছগুলোর বৃদ্ধির পথ আগলে রেখে টিকে থাকবে। কাজেই আমি আপনার লেখনী নিয়ে তেমন উদ্বিগ্ন নই। 

নেহায়েতই আপনি আমার বন্ধু তালিকায় আছেন বিধায় নিজের মতামতটুকু জানানো থেকে বিরত থাকতে পারলাম না, এই যা!

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী শিক্ষক, নাট্যকর্মী, ও অনুবাদক