পারিবারিক বন্ধন: নারীর দায়?

প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০১৭, ১৩:১১

"এখন পর্যন্ত দেশের শ্রমশক্তিতে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছেলেদের তুলনায় কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, শ্রমশক্তিতে ১৫ থেকে ২৯ বছর পর্যন্ত বয়সী মানুষের সংখ্যা ২ কোটি ৭ লাখ ৯৮ হাজার। তাদের মধ্যে ১ কোটি ৩৭ লাখ ২৮ হাজার পুরুষ হলেও মেয়েদের সংখ্যা মাত্র ৭০ লাখ ৭০ হাজার। সুতরাং এমনিতেই দেশে মেয়েদের জন্য কাজ করার সুযোগ কম। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আনুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়তে শুরু করেছে। আরও একটু ভালো থাকার আশায়, সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তায় অনেক মা-ই কাজ করতে যাচ্ছেন। মায়েদের আয় বাড়তি স্বাচ্ছন্দ্য দিলেও সন্তানেরা আবার এ কারণে দূরত্ববোধও করে। জরিপ বিশ্লেষণে এমনটাই দেখা যাচ্ছে।"

দেশের প্রথম সারির দৈনিক 'প্রথম আলো' একটা জরিপ করেছে। সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে এই জরিপ। জরিপে উঠে এসেছে যে মা এবং বাবা দুজনেই কর্মজীবী হওয়ায় পরিবারের বন্ধন হালকা হচ্ছে। উপরের অংশটুকু প্রথম আলোর রিপোর্টারের এনালিসিস। জরুরী আর গুরত্বপূর্ণ এনালিসিস। ৮৯ দশমিক এক ভাগ তরুণ তরুণী মনে করেন মা-বাবা দুজনেই কর্মজীবী হওয়ায় বন্ধন শিথিল হচ্ছে। প্রশ্নে এবং উত্তরে একটা বিষয় স্পষ্ট, মায়েরা শুধুই সন্তানদের ভালো রাখার জন্যই চাকরি করেন। সন্তানরা স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবেন এই আশায়। মায়েরা মানে নারীরা। আবার মায়েরা কাজ করায় সংসারে বাড়তি অর্থ এলেও এর বিনিময়ে পরিবারিক বন্ধন আলগা হচ্ছে। নারীরা শুধুই নিজের পরিচয় এবং আত্মসম্মানের জন্য কাজ করবে, নিজের খুশি তাই কাজ করবে বা নিজেরে সুখী করার জন্য কাজ করবে- এ ধরণের ভয়ংকর স্বার্থপর কথাবার্তা বা ভাবনা ভাবার প্রশ্নই ওঠে না। শুধু সংসারের জন্য কাজ করারও এতো হ্যাঁপা। জরিপে এমন কোন প্রশ্ন করা হয়েছিল কি না জানা নেই যে বাবারা যদি চাকরি না করতেন মায়েদের হাতে থাকতো আয় রোজগারের প্রধান দায়িত্ব তাহলেও কি সন্তানেরা মনে করতেন যে পরিবারের বাঁধন আলগা হচ্ছে? তখন তো মা এবং বাবার মধ্যে একজন (বাবা) থাকতেন ঘরে। না কি "নারীর কোমল হাতের ছোঁয়া" ছাড়া পরিবারের বন্ধন শক্ত থাকে না?

এই যে নারী মানে ঘরে থাকা এবং ঘরে থেকে কাজকর্ম করা- এই ভাবনা আমাদের তরুণ সমাজেরও দেখছি। মা অফিসে যাচ্ছে বলে শিশুসন্তান কাঁদছে, মাকে অফিসে যেতে নিষেধ করে অনুনয় বিনয় করছে- এরকম গল্প আমরা প্রতিনিয়ত শুনি। এইসব গল্পে একটা প্রচ্ছন্ন ভাব থাকে যে মেয়েরা কাজ করলে পরিবার বিশেষ করে সন্তান ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মেয়েরাও একধরনের অপরাধবোধ নিয়েই চাকরি বা কাজ করেন। এ অবস্থার বদল হয়তো কিছুটা হয়েছে কিন্তু তা ঠিক উল্লেখ করার মতো নয়।

এখন আমার জানতে ইচ্ছা করে, এর সমাধানটা কি? মেয়েরা কাজকর্ম না করে ঘরে বসে থাকবে? মা কাজ করলে পারিবারিক বন্ধন ঠিকঠাক রাখার নিদান কি? আমাদের স্কুলগুলো আনন্দময় না, খেলার একটা মাঠ নেই, একটা শিশুতোষ সিনেমা নাই, টেলিভিশনে শিশুদের জন্য কোন অনুষ্ঠান নেই, পাড়ার পাঁচটা বাচ্চা একসাথে মিট করবে তার কোন জায়গা নাই, শিশুদের জন্য বই নেই, ছোটদের জন্য লেখক নেই -শুধু মা চাকরি না করলেই শিশুদের আনন্দময় শৈশব হবে, পরিবারের বন্ধন মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা হবে? রাষ্ট্রের এই দায়িত্ব মেয়েদের কেন নিতে হবে? 

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিবছর এতো এতো সমাজবিজ্ঞান এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান এর ছাত্র প্রসব করে তারা কি করেন? তারা কি কোন গবেষণা করেন যাতে এইসব সমস্যা অ্যাড্রেস হয়? রাষ্ট্র এসব নিয়ে ভাবে? নারীর ক্ষমতায়ন, সুষম ক্ষমতায়ন কেমনে হয় তা নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলোচনা কই? সংসার-সন্তান ঠিকঠাক রাখাই নারীর সকল সুখ- এইসব টক্সিন জাতীয় কথাবার্তা কি ধীরে ধীরে আবারও নারীর মাথায় সূক্ষ্মভাবে ঢোকানো হচ্ছে? মেয়েদেরকে অর্ধমানব ভাবার, তারা কেন কি উদ্দেশ্যে কাজ করবে সেইটা ঠিক করে দেয়ার, নানান রকম অপরাধবোধে নারীকে ভোগানোর নানান কায়দা ইদানিং আবিস্কৃত হচ্ছে। তো এই কায়দাকানুন আবিস্কার না করে প্রত্যেকটা মানুষকে তার ইচ্ছামতো কাজ করার স্বাধীনতাটুকু দিতে রাষ্ট্রের যা করার তা করুক। তারপর সন্তানেরা কি ভাবেন তা নতুন করে জরিপ করে দেখেন।

লেখক: সাংবাদিক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত