অনলাইন জার্নাল শনাক্তকরণে বিভ্রান্তি দূর হোক

প্রকাশ : ১৪ জুন ২০১৭, ২০:১৩

ড. মুহ. আমিনুল ইসলাম আকন্দ

বাংলাদেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি নীতিমালায় প্রকাশনার শর্তে প্রিন্টেড একাডেমিক জার্নালের কথা বলা আছে। এটি বলতে সাধারণত জার্নালের একটি সংখ্যায় সংকলিত গবেষণা প্রবন্ধগুলো নিয়ে ছাপানো বইকে বোঝায়। দেশে-বিদেশে একাডেমিক সোসাইটি ও প্রতিষ্ঠানগুলো সনাতন এই নিয়মেই জার্নাল প্রকাশ করত। ডিজিটাল যুগে এসে প্রিন্ট জার্নালগুলোর অনলাইন সংস্করণ প্রকাশ করায় ছাপানো কপির সংখ্যা কমে গেছে। কারণ যে কোনো জায়গা থেকে ইলেকট্রনিক কপির প্রাপ্যতা থাকছে। গবেষকরা কিনে কিনে পড়ছেন অনলাইনে দেওয়া নামি জার্নালগুলোর প্রবন্ধ। এখন ব্র্যান্ডধারী প্রকাশকরা লেখককে পর্যন্ত বিনামূল্যে প্রিন্ট আকারে পূর্ণ জার্নালের কপি দেন না। তাই কেউ অনলাইন বলে মন্তব্য করলে লেখক তাকে সহজে বোঝাতে ব্যর্থ হন।

উল্লেখ্য, বাজারে শুধু অনলাইন জার্নাল আছে যাদের বৈশিষ্ট্য আলাদা। তবে জার্নাল ব্র্যান্ডেড হলেও প্রবন্ধে অনলাইনে অবমুক্ত করার তারিখ থাকায় অনেকে অনলাইন বলে মন্তব্য করেন। আবার কেউ প্রিন্ট কপিতে ওয়েবসাইটের ঠিকানা দেখেও মন্তব্য করে। বিশ্বখ্যাত জার্নালগুলোর প্রকাশনা পদ্ধতি বিশ্লেষণের মাধ্যমেই কেবল এই বিভ্রান্তি দূর করা যেতে পারে।

একাডেমিক জার্নাল সাধারণত গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করে। যে প্রবন্ধ বেশি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ফলাফল ধারণ করে জ্ঞানবাজারে সেটি বেশি দামি। তবে প্রতিটি জার্নালকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে আট ডিজিটের International Standard Serial Number (ISSN) নিতে হয়। সেকেলে এই নম্বরটি প্রিন্ট জার্নালের জন্য দেওয়ার রীতি থাকলেও সময়ের আবর্তে অনলাইন প্রকাশনার জন্য eISSN দেওয়া হচ্ছে। তবে দীর্ঘকাল ধরে চলমান প্রিন্ট জার্নালগুলো আলাদা নম্বর না নিয়েও প্রবন্ধ অনলাইনে দিচ্ছে। উল্লেখ্য, প্রায় শত বছর আগে থেকেই বেশ কিছু নামি জার্নালের ইনডেক্স প্রকাশিত হয়ে আসছে। আশির দশকে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাজারে এনেছিল CD-Rom--এ করে অ্যাবস্ট্রাক্ট। এখনও CABI, Scopus, Proquest--এর মতো প্রতিষ্ঠান, যাদের ইনডেক্সিং ও অ্যাবস্ট্রাক্টিং করে তাদের মান কেমন এবং প্রিন্ট করা না করা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা বেমানান। অন্যদিকে শুধু eISSN নিয়ে শুধু যেসব অনলাইনে প্রবন্ধ প্রকাশ হচ্ছে সেগুলো অনলাইন জার্নাল। তবে বিশ্বখ্যাত প্রায় সব নামি জার্নালের দু’ধরনের নম্বর আছে। তবে সেগুলোর পূর্ণ প্রিন্ট কপি সহজলভ্য নয়। গ্রাহকরা প্রিন্টেড কপি কিনে যত জার্নাল পেত অনলাইন সমখরচে অনেক বেশি পাচ্ছে। তাই লাইব্রেরিগুলো যেন প্রিন্ট কপি সংগ্রহ থেকে সরে এসেছে।

উন্নত বিশ্বের বিখ্যাত জার্নালগুলোর প্রবন্ধ অনলাইনে পরিবেশনের জন্য নব্বইয়ের দশকে যাত্রা শুরু করেছিল ডিজিটাল জার্নাল লাইব্রেরিগুলো। তখন থেকেই JstorI
Ingentaconnect-এর মতো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে অনেক পুরনো সংস্করণও পাওয়া যেত। তারপর ব্র্যান্ডধারী জার্নাল প্রকাশক প্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যিক ওয়েবসাইট চালু করে অনলাইন পরিবেশক হয়ে গেছে। একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে বিশ্বের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও পেশাদার সোসাইটিগুলো মূলত ব্র্যান্ডধারী প্রকাশক_ যেমন Elsevier, John Wiley, Taylor & Francis, Springer, Oxford, Cambridge, Sage I World Scientific-এর সঙ্গে জার্নাল প্রকাশ করছে। সময়ের আবর্তে বিশ্বখ্যাত জার্নালগুলো ক্রমে ব্র্যান্ডধারী প্রকাশকদের আওতায় এসেছে। তবে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা, রয়েল সোসাইটি এবং র‌্যাংকধারী বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্বভাবেও প্রকাশ করছে। এগুলোর অনলাইন প্রাপ্যতাও আছে কোনো না কোনো ডিজিটাল লাইব্রেরিতে। বিভিন্ন দেশের শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো চাঁদা পরিশোধ করে এসব জার্নালের অনলাইন গ্রাহক হয়ে খুশিই থাকছে। আর ব্যক্তিগতভাবে ডাউনলোড করতে প্রবন্ধভেদে প্রতিটিতে বিশ ডলার থেকে চলি্লশ ইউরো পর্যন্ত লাগছে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গবেষণা করতে গিয়ে অদ্যাবধি কাজের ব্যাপ্তি ও পদ্ধতি জানতে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও রয়েল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো খুবই প্রয়োজন। গুণমান বিচারে আমরা যে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের কথা বলে থাকি, তা সাধারণত এসব জার্নালেই থাকে। অনলাইনের বড় বাজার সৃষ্টি হওয়ায় প্রকাশকরাও তৈরি করেছেন প্রিন্ট অন ডিমান্ড বা চঙউ নামে এক নতুন ব্যবস্থা। এখানে প্রবন্ধের লেখক কেউ কপি সংগ্রহ করতে চাইলেও খরচ পড়ে অনেক। উন্নত দেশের লেখকরা প্রিন্ট আর রিপ্রিন্ট নিয়ে ভাবেন না। কিন্তু এ দেশে লেখক না ভাবলেও ভাবানোর লোক আছে। অনেকে বুঝেও না বুঝে কাউকে আটকানোর জন্য ব্র্যান্ডেড জার্নালকে অনলাইন বলেন। অনুন্নত দেশের একজন লেখকের পক্ষে অর্থ পরিশোধের পদ্ধতিগত ঝামেলা পেরিয়ে এত খরচ করে পূর্ণ প্রিন্ট কপি সংগ্রহ কি কষ্টসাধ্য নয়? তবু প্রিন্টেড কপির কভার পেজের কোনায় find this journal online--এর নিচে ওয়েবসাইট লেখা দেখে অনলাইন বলে মন্তব্য করে। জার্নালের ISSN I eISSN থাকার পর সেটা কি অতিরিক্ত তথ্য নয়?

বিতর্ক বা বিভ্রাট সৃষ্টির আরেকটি সূত্র হলো ভলিউম ও সংখ্যা নম্বর দেওয়া রিপ্রিন্ট কপিতে অনলাইনে প্রকাশের তারিখ থাকা নিয়ে। একরকম বাধ্যবাধকতা থেকেই প্রকাশক সে তারিখ এড়াতে পারেন না। সাধারণত ব্র্যান্ডধারী জার্নাল প্রকাশকদের এডিটরিয়াল অফিস ও প্রকাশনা অফিস আলাদা থাকে। এডিটরিয়াল কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট জার্নালের প্রবন্ধ গ্রহণ, সফটওয়্যারের সাহায্যে নিজস্বতা যাচাই, লিখন-মান যাচাই, বিষয়বস্তুর প্রাথমিক রিভিউ, বিশেষজ্ঞ রিভিউয়ার নির্ধারণ এবং রিভিউ প্রক্রিয়া শেষে ছাপানোর উপযোগী প্রবন্ধ বাছাই করে। প্রকাশনা এডিটর পরে জার্নাল ফরমেট অনুসরণসহ অন্য শর্তগুলো নিরীক্ষা করেন। তারপর জার্নাল ভলিউম, সংখ্যা ও সাল নির্ধারণের আগেই ডিজিটাল অবজেক্ট আইডেনটিফিকেশন (উঙও) নম্বর যোগ করে প্রবন্ধগুলো অনলাইনে দেওয়া হয়। প্রকাশকভেদে সেগুলো online first, on press, not assigned in any issue ইত্যাদি শিরোনামের অধীনে থাকে। আমার জানামতে Springerএর একটি জার্নালে ইস্যুতে না দিতে পারা ১৮৪টি প্রবন্ধ অনলাইনে আছে। আগামী দু'বছরে হয়তো সব প্রবন্ধ ইস্যুতে যাবে না। কিন্তু এরূপ প্রবন্ধ ডাউনলোড করে অনেকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করছেন। তারপর প্রিন্টেড রূপে বের হলে অনলাইনে প্রথম প্রকাশের তারিখ বাদ দেওয়ার সুযোগ কোথায়? 

আমরা সবাই অভ্যস্ত পূর্ণ সংকলনের বইসদৃশ প্রিন্ট কপিতে। এই সুযোগে অর্থের বিনিময়ে প্রবন্ধ ছাপতে বাজারে এসেছে অনেক জার্নাল। দেশেই আছে দু-চার হাজার টাকা খরচে প্রবন্ধ ছাপা ও প্রিন্ট কপি পাওয়ার ব্যবস্থা। আর বিদেশি ঠিকানা সংবলিত জার্নালে লাগছে চারশ' ডলার পর্যন্ত। এরা প্রবন্ধ জমা দেওয়ার কয়েক দিনের মাথায় নামমাত্র সমীক্ষণে লেখককে প্রকাশের স্বীকৃতিপত্র আর অর্থ পরিশোধের পরপরই দেয় প্রিন্টেড কপি। সাধারণভাবে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত পুরনো ডাটা সংবলিত প্রবন্ধ প্রকাশের রীতি থাকলেও অনেকে অধিক পুরনো ডাটাযুক্ত প্রবন্ধ গ্রহণ করছে। গুণমান বিচার না করে আমরা কেন শুধু ওঝঝঘ ও প্রিন্ট দেখে সন্তুষ্ট থাকছি? স্বল্প সময়ে প্রিন্ট কপি প্রদানকারী নামসর্বস্ব জার্নালগুলো লেখককে খুশি রাখলেও সেগুলোর কোনো পাঠক আছে মনে হয় না। বিশ্ব জ্ঞানবাজারে যদি কোনো প্রভাব না-ই রাখে, তা নিয়ে প্রশ্ন করছি না কেন? অন্যদিকে কোনো গবেষক নামি জার্নালে প্রবন্ধ প্রকাশ করলে তাকে বিভ্রান্তিতে ফেলছি। দিন গুনে তো দূরের কথা বছরব্যাপী প্রতীক্ষা করেও মানসম্মত জার্নালে প্রকাশের সম্মতিপত্র পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু গুণমানের কদর না করলে নামসর্বস্ব প্রবন্ধের চাপে দেশ থেকে উঁচুমানের গবেষণা উঠে যাবে। 

উঁচুমানের জার্নালে যাদের গবেষণা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে তারাই কেবল পরিশ্রমটা আঁচ করতে পারে। তারা দশের স্কেলে শুধু দশমাংশের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারছে। আর সে পথে না গিয়ে গল্পের আসরে মশগুল কারও কাছে হয়তো এক-দুই মান কিছুই না। গত বছর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) প্রস্তাবিত অভিন্ন শিক্ষক পদোন্নতি নীতিমালায় প্রকাশনার ক্ষেত্রে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর যুক্ত জার্নালকে অগ্রাধিকারে রেখেছিল। এখানে শুধু Thomson Reuters-এর জার্নালটি গৃহীত হবে বলে শর্ত দেওয়া হয়েছিল। অথচ দুটি শব্দের বানানে ভুলসহ অ্যান্ড (্) যোগ করে নামটি Thompson & Reauter লিখেছিল। ইউজিসি অবশ্য সে শর্ত থেকে সরে এসেছে। তবে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর নয়, সেই প্রতিষ্ঠানের ইনডেক্স জার্নালেই যার প্রবন্ধ আছে তার শব্দ দুটির বানানে ভুল হওয়ার কথা নয়। দেশের নাজুক গবেষণা অবকাঠামো ও অপ্রতুল অর্থসংস্থানের মধ্যে যারা মানসম্মত গবেষণা করে তারা প্রশংসার দাবিদার। তাই তো ব্র্যান্ডেড ও উঁচু ইনডেক্সিং জার্নালগুলোকে অনলাইন বলতে কিংবা না-সূচক মন্তব্য করতে গিয়ে দু'বার ভাবা দরকার। ভুল ব্যাখ্যার কারণে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও গুণী কোনো গবেষকের অনুপ্রেরণা হারানো কাম্য নয়। 

[email protected]
সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: সমকাল

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত