প্রসঙ্গ: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ভ্যাকেন্ট

প্রকাশ : ২৮ মে ২০১৭, ২০:১১

সৌমিত জয়দ্বীপ

এদিক দিয়ে অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবীরকে বেশ স্মার্ট উপাচার্য মনে হয়েছে আমার। কেন? বলছি।

আমি যখন জাহাঙ্গীরনগরে পড়তাম, তার সিংহভাগ সময় উপাচার্য ছিলেন শরীফ স্যার। শুরুর কয়েক মাস ছিলেন অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান, শেষের কয়েক মাস ঢাবি থেকে আগত অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন।

এই মিলিনিয়ামে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী ছাত্রআন্দোলন হয়েছে ২০১২ সালের শুরুতে। জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর' ব্যানারে।

সে এক সময় ছিল বটে! কী রকম উত্তপ্ত ক্যাম্পাস সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলো ইউটিউবে দেখে নিতে পারেন। বোঝার জন্য বলছি, অনেকেই মনে করেন, জাবির ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ ও প্রতাপশালী মশাল মিছিল হয়েছিল এই আন্দোলনে। টানটান উত্তেজনা ক্যাম্পাসজুড়ে। আন্দোলনকারীদের গুণে টানা চার-পাঁচদিন জাহাঙ্গীরনগর ছিল প্রতিটি মিডিয়ার প্রধান শিরোনাম। সেবার আমরা ২০ দিনের লাগাতার আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করেই ক্ষান্ত দিয়েছিলাম।

এছাড়াও, বিভিন্ন সময়েই আরও আরও ছাত্রআন্দোলন করেছি আমরা, আমাদের সময়ে। শরীফ স্যার ও তার তৎকালীন প্রশাসনকে পদত্যাগের দিন পর্যন্ত চাপে থাকতে হয়েছে। খুব ভালো শেয়ানে-শেয়ানে লড়াই হতো তখন প্রশাসন ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে। কিন্তু একটা বিষয় খুবই পরিষ্কার ছিল এবং এজন্য আমি শরীফ স্যারকে ক্রেডিট দেই— অন্তত হল ভ্যাকেন্ট করে দেওয়ার মতো হীনকাজ তার প্রশাসন কখনই করেনি। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ আছে, কিন্তু এই সাহসিকতা ও মানসিকতার জন্য তিনি লেটারগ্রেড পাবেন। এজন্যই তাকে স্মার্ট বলেছি শুরুতে।

পট-পরিবর্তনের পর, উপাচার্য হয়ে এলেন আনোয়ার স্যার। মনে পড়ে, ২০১২ সালের ২ আগস্ট রাতে মীর মশাররফ হোসেন হলে প্রবেশ করে পুলিশের গুলি ছোঁড়ার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছিল ক্যাম্পাস। কী হয়নি সেদিন! ঢাকা-আরিচা অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল বহু ঘন্টা। আজকের মতো সেদিনও ছিল প্রথম সেহেরীর রাত। সেই উত্তেজনা রাত গড়িয়ে সকালে স্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠল। এর পর দুপুর না হতেই ক্যাম্পাস পিষ্ট হলো বুট আর বেয়োনেটে। মাত্র ২ ঘন্টার নোটিশে হল ভ্যাকেন্টের ঘোষণা এলো। প্রতিবাদে রাস্তায় নামলাম। টেকা গেল না!

ইতিহাস নাকি ফিরে ফিরে আসে! পাঁচ বছর পর সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি, আরও ভয়ঙ্করভাবে!

আচ্ছা, জাহাঙ্গীরনগরের ভাবনা এতো 'সুশীল' হলো কবে থেকে? দু'জন ছাত্রকে ক্যাম্পাসের সামনে দিয়ে যে মহাসড়ক গেছে, সেখানে হত্যা করল একটা বেপরোয়া বাস, লাশগুলো পর্যন্ত ক্যাম্পাসে আনতে দেয়নি প্রশাসন, তো এর প্রতিক্রিয়া তীব্র ও ভয়াবহ হবে না! সেই সড়কে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ উগরে পড়বে না! সুশীল পুতুপুতু বক্তব্য ও কর্মসূচি দিয়ে জাহাঙ্গীরনগরের চিরন্তন গর্জনকে নস্যাত করে দেওয়ার এই নতুন খেলা কবে থেকে শুরু হলো শুনি?

হ্যাঁ, প্রথম দিন ওরা কিছুই করেনি। তাতে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। তো, দ্বিতীয় দিনে ওরা আরও সংগঠিত হয়ে নেমেছে। জাহাঙ্গীরনগরের প্রতিবাদের যে ইজ্জত সেটার মর্ম ওরা বুঝেছে তো একটু দেরিতে হলেও। এটা নিয়েও বিতর্ক!

প্রশাসন নাকি আশ্বাস দেওয়ার পরও আন্দোলনকারীদের একটা অংশ তা না মেনেই আন্দোলন চালিয়ে গেছে। অনেককেই দেখলাম, গালির স্বরে এদের বলছেন ‘বাম' আর আমি গর্বের স্বরে বলছি, হ্যাঁ, এরাই ‘বামপন্থি’। সাহসী ও সাচ্চা। মাথা বর্গা দেয়নি। কত আশ্বাস জলে তলিয়ে গেছে, তা এদের চেয়ে বেশি কেউ জানে না। সারা বছর প্রশাসনের কাছে আপনাদের দাবিদাওয়া নিয়ে তো এরাই যায়। তো মায়ের কাছে মামা বাড়ির গল্প দিতে আসেন কেন!

যুক্তি-বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে আন্দোলনের ইতি টানলে বলেন দালাল, না ইতি টানলে বলেন আবাল— এসবই তো আপনাদের চরিত্র!

আর ওরা তো রাতের অন্ধকারে পুলিশের প্রহার ও গ্রেফতার, আপনার গালি ও আপনার মিত্রশক্তির ‘অ্যাটাক’ পান করার জন্য ভিসির বাসা ঘেরাও করেছিল, তাই না? ওদের জীবন তো জীবন না, তেলাপোকার জীবন! তাই, ওদের ৪৫ জন ছেলেমেয়েকে রাতের অন্ধকারে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন আপনাদের ‘প্রথম নারী ভিসি'। ওখানে মেয়েরাও ছিল, তিনি কি সেটা জানতেন না? আপনাদের তালির শব্দ শোনা যাচ্ছে অনেক জোরে!

ও ভাই, শাহবাগে পুলিশ কী করেছে জানেন তো? লিটন নন্দীসহ ৪ জনকে তো গ্রেফতার করেছেই, তার চেয়েও ঘৃণ্য কাজ করেছে। নারীদেহের স্পর্শকাতর অংশগুলোর দিকে জলকামান তাক করে সমানে গরম ও রঙিন পানি ছুঁড়েছে অশ্লীল পুলিশ। আর আপনাদের ভিসি ‘ম্যাডাম’, তার লর্ড ক্লাইভ সেনাপতি, জাবির ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে ও ধুরন্ধর প্রক্টর সেই পুলিশের হাতেই আপনার ভাই ও বোনদের, আই রিপিট, বোনদের রাতের আঁধারে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। আপনারা এদেরই তো গালি দিলেন সারাদিন ফেসবুকে, তাই না?

আহা রে, আপনাদের জাহাঙ্গীরনগরের ‘ইন্টিমিসি'; একটা সাহসী ও যৌক্তিক আন্দোলনকে পর্যন্ত আপনারা ফেসবুকে উল্টাপাল্টা লেখালেখি করে ভাগাভাগি করে নিলেন বাপের সম্পত্তির মতো! আপনাদের 'জাহাঙ্গীরনগরীয় ভাবমূর্তি'র পাছাটা এবার দেখা হয়ে গেল!

ফাঁকে, এই বিভাজনটা প্রশাসনের পছন্দ হলো। ড. ফারজানা ইসলাম তো হরেদরে প্রধানমন্ত্রীরই কার্বনকপি। নারী, কিন্তু আচরণে প্রচণ্ড পুরুষতান্ত্রিক। সুযোগ বুঝে দিলেন হলটা ভ্যাকেন্ট করে। প্রথম রোজার দিন, এটাও ভাবলেন না, ছেলেমেয়েগুলোর কত কষ্ট হবে। যে ছেলেমেয়েগুলো টিউশনি করে পেট চালায়, আসছে ঈদে হয়তো এ টাকা থেকেই কিছু সখ আহ্লাদ পূরণ করবে, তাদের মাথায় দুম করে বাজ ফেললেন! আসলেই, হিস্ট্রি রিপিট ইটসেলফ!

আপনারা কিনা তার আশ্বাসে বিশ্বাস রাখেন! উনার পরম সৌভাগ্য যে, উনি আমাদের সময়ে ভিসি ছিলেন না, নইলে গদিচ্যুত হতে সময় খুব বেশি লাগত না!

শিক্ষার্থীদের হল ভ্যাকেন্ট করে কারা বুঝলেন তো?

যারা ভীরু, ভীতু, পরিস্থিতি সামাল দিতে অক্ষম, নৈতিক আন্দোলনের কাছে নতজানু এবং আনস্মার্ট— তারাই হল ভ্যাকেন্ট করে শিক্ষার্থীদের কষ্ট দেয়। কোন শিক্ষকই এসব অবস্থায় শিক্ষার্থীবান্ধব হন না। শেইম!

হল ভ্যাকেন্ট ও ৪৫ জন শিক্ষার্থীকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার নিন্দা জানাতেও আমার লজ্জা হচ্ছে! সারা দেশ মূর্তি কি ভাস্কর্য তা নিয়ে ভাবছে, বিতর্ক করছে, কথা বলছে। আর খোদ একটা মূর্তিমান আতংক জাহাঙ্গীরনগরের ওপর ভর করে বসে আছে! শেইম!

সৌমিত জয়দ্বীপের ফেসবুক থেকে

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত