চিরন্তন স্নেহময়ী

প্রকাশ : ১৪ মে ২০১৭, ১৪:১৯

মাহবুবা সুলতানা মনি

শীতের সকাল। তখনও কুয়াশা কাটেনি। ঘুম থেকে ডেকে তুলে এক কাপ চায়ের সঙ্গে হারমোনিয়ামটা সামনে দিয়ে মা বলতেন, ‘রেওয়াজ কর।’ তিনি আমার গায়ের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসতেন আর আমি মহাবিরক্তি নিয়ে রেওয়াজ করতাম। ভাবতাম, আসলেই কি মা আমাকে ভালোবাসেন? ভালোবাসলে পারতেন এই শীতের মধ্যে আমার ঘুম ভাঙাতে? সবেমাত্র কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে পা রেখেছি। ক্লাসের পরে ইচ্ছে করে একটু বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা দিই, কোথাও ঘুরতে যাই। কিন্তু বিধি বাম। মায়ের কড়া নির্দেশ- সন্ধ্যার আগেই বাসায় আসতে হবে, যাকে কি-না বলে সান্ধ্য আইন। উঃ! কী যে বিরক্তি লাগত! বন্ধুরা ঘুরতে যেত, আড্ডা দিত আর আমি একরাশ মনোকষ্ট নিয়ে বাসায় ফিরে আসতাম। কোথাও গেলে যদি ফিরতে দেরি হতো, মা ফোনের পরে ফোন দিতেন। ফিরে এলে কখনও কখনও জড়িয়ে ধরে কাঁদতেন। খুব অবাক হতাম তার এই আচরণে আর ভাবতাম, আমার মা কি কখনোই বুঝবেন না- আমি বড় হয়েছি! তখন মাকে মনে হতো পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন মানবী। মনে হতো, কেন মা আমার নিজের কোনো কাজে সম্মতি দেন না? কেন তিনি আমার কোনো কাজ পছন্দ করেন না? তখনও বুঝতে পারিনি, পৃথিবীতে যে ক'জন মানুষ নিঃস্বার্থভাবে আমার মঙ্গল কামনা করে, আমার মা তাদের মধ্যে প্রথম। খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, যেসব কাজে মা তখন সম্মতি দেননি, সেই কাজগুলো পরবর্তী জীবনে সত্যিই ভালো ফল দেয়নি। এখন ভাবি, কেমন করে ওই সময়ে মা বুঝতেন- কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ আমার জন্য? হয়তো মা বলেই বুঝতেন।

আমার পড়াশোনা থেকে শুরু করে সব কাজে নীরব ও নিঃস্বার্থ সহায়তা যিনি দিয়েছেন তিনি আমার মা। রাত জেগে খেয়াল রাখা, জোর করে করে গান, কবিতা, বিতর্ক- সবকিছু করিয়েছেন। নিজেকে খুব অভাগা মনে হয়; তার এই অবদান, কষ্টগুলো আমি বুঝেছি নিজে মা হওয়ার পর। বুঝেছি কোথায় কষ্ট হয় নিজের সন্তানের জন্য। আমি আমার মেয়ের জন্য যেমন মায়া-মমতা-ভালোবাসা বোধ করি, তেমনটাই তো আমার মা বোধ করতেন আমার জন্য। নিশ্চয় রাতের পর রাত আমাকে নিয়ে জেগে কাটিয়েছেন, আমার অসুখে কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন। আমার অতটুকুন মেয়েকে গোসল করাতে আমি খুবই ভয় পেতাম- যদি বাথটাবে পড়ে যায়! যদি নাকে-মুখে পানি চলে যায়! তাহলে উপায়? উপায় মা। আমি তেল মালিশ করে দিতাম, আমার মা তার নাতনিকে গোসল করাতেন। আমি দেখতাম কীভাবে এই অসাধ্য সাধন করছেন আমার মা। কীভাবে মেয়েকে শক্ত খাবার খাওয়াব? ভরসা- মা। হঠাৎ মেয়ে কাঁদতে শুরু করল। কেন কাঁদছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। মুহূর্তে সেই কান্না থামিয়ে দেওয়ার উপায় কী? উপায় একজনই- মা। আমার জন্য যেমন কষ্ট করেছেন, তার চেয়েও বেশি কষ্ট করছেন এখন আমার মেয়ের জন্য। আমি যখন চাকরিটা শুরু করি আমার মেয়ের বয়স মাত্র ১০ মাস। খুব নিশ্চিন্তে নতুন চাকরিতে মনোযোগ দিতে পেরেছি, শ্রম দিতে পেরেছি শুধু আমার মায়ের জন্য। মায়ের ছায়া না থাকলে আমার কখনোই আজকের আমি হয়ে ওঠা হতো না। এখনও যখন রাত জেগে কাজ করি কিছুক্ষণ পর পর এসে খোঁজ নেন, চা করে দেন। আজকের যেই আমি, একজন মা, শিক্ষিকা, সংগঠক, উপস্থাপিকা- সবই আমার মায়ের পরিশ্রম আর ধৈর্যের ফসল। আমি আমার মায়ের কথা বলতে পারি, আমি জানি পৃথিবীর সব মা-ই তাদের সন্তানের জন্য এমন শ্রম দেন, কষ্ট করেন। পৃথিবীর সব মায়ের জন্য বিনম্র শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। আমাদের সন্তানদের কোনো ক্ষমতাই নেই মায়ের এক সেকেন্ডের কষ্টের প্রতিদান দেওয়ার বা কিঞ্চিৎ ঋণ শোধ করার। একটাই চাওয়া- আপনারা আজীবন আমাদের ছায়া হয়ে থাকুন। আমরা আপনাদের ছায়ায় নিঃশ্বাস নিই, বাঁচি।

সূত্র: সমকাল

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত