নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত অবৈধ ঘোষণা

কঠিন হয়ে যাবে অপরাধ নিয়ন্ত্রন

প্রকাশ | ১৪ মে ২০১৭, ১২:২৩

নাজমুল ইসলাম রাজু

সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল কোর্ট নিয়ে হাইকোর্টের রায় সামগ্রিক প্রশাসন ব্যবস্থাকে হঠাৎ করেই জটিল কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন করে দিয়েছে। কোর্টের রায় নমস্য, তবে যেহেতু বিষয়টি অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ এবং এতে মাঠ পর্যায়ে সাধারণ মানুষ ও সরকারি স্বার্থ ব্যহত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তাই মাঠের অভিজ্ঞতার আলোকে সামগ্রিক বিষয়টি পর্যালোচনা করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে বলে মনে করি।

মোবাইল কোর্ট কার্যক্রম সামগ্রিকভাবে বিচারিক কার্যক্রম কি না সেটা কোর্ট বিবেচনা করবে। তবে তৃণমূল পর্যায়ে যে প্রক্রিয়ায় মোবাইল কোর্টকে প্রয়োগ করা হয় সেই প্রক্রিয়াটি যতটা না বিচারিক তারচেয়ে বেশি নির্বাহী প্রকৃতির। মূলত মোবাইল কোর্ট আইনটিও সামগ্রিক পৃথকীকরণ নীতির উপর ভিত্তি করেই প্রস্তুত করা হয়েছিলো। মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ এর ৭(৪)ধারা অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তি কেবল দোষ স্বীকার করলেই তাকে দন্ড প্রদান করা যায়। মূলত দোষ স্বীকারের উপর ভিত্তি করেই মোবাইল কোর্ট দন্ড আরোপ করে থাকে। ফলে বিচারিক প্রক্রিয়া সামান্যই জড়িত এর সাথে।

তৃণমূল পর্যায়ে মোবাইল কোর্ট প্রয়োগ হয় নির্বাহী প্রক্রিয়ায় যেটি আমি শুরুতেই উল্লেখ করেছি। নানা ধরণের ক্ষুদ্র অপরাধের দন্ড এর মাধ্যমে প্রদান করা হয়ে থাকে। যে অপরাধগুলোর প্রকৃতি সামাজিক ধরণের (Social Crimes)। অপরাধ ক্ষুদ্র হলেও এর রয়েছে বড় ধরণের সামাজিক প্রভাব। কিন্তু মোবাইল কোর্ট অবৈধ হওয়ায় সেই প্রভাব বাধাগ্রস্থ হবে। 

১) বাল্যবিবাহ
বাল্যবিবাহের মূল ক্ষেত্র পল্লী এলাকা। অর্থাৎ প্রান্তিক পর্যায়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠী এর শিকার ব্যাপক হারে। মোবাইল কোর্ট বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। মাঠ পর্যায়ের একজন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মাত্রই জানেন যে বাল্যবিবাহ সংগঠনকারী ব্যক্তিদের কাছে বাল্যবিবাহের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক সময় হচ্ছে মধ্যরাত ও শুক্রবার। প্রায় সময়ই বাল্যবিবাহের খবর পাওয়া যায় স্বল্প সময়ের ব্যবধানে। কোন শুভাকাঙ্খী, স্কুলের মাস্টার, কোন ছাত্র, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার বা চেয়ারম্যান এই বিয়ের খবর অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বা সহকারী কমিশনার(ভূমি) বা অন্য কোন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়ে থাকেন। কাজেই বিয়ে বন্ধতে একজন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে তড়িৎগতিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। নিজে বিবাহস্থলে উপস্থিত হয়ে বিয়ে বন্ধ করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। বিগত বছরসমূহের বাল্যবিবাহের তথ্য দেখলেই বিষয়টি পরিস্কার হবে। ৯৮ ভাগের বেশি বিয়েই বন্ধ হয়েছে মোবাইল কোর্টের হস্তক্ষেপের কারণে। এখন যদি এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটগণ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা না করতে পারেন তবে তাদের পক্ষে বিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হবে না। সরকার এসডিজি বাস্তবায়নে চরম সমস্যার সম্মুখীন হবে বলে প্রতিয়মান হয়। প্রশ্ন হতে পারে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করলেই তো সে সমস্যার সমাধান হয়। কিন্তু বাস্তবে সেটি ফলপ্রসু কোন সমাধান হিসেবে বিবেচিত হয় না। কেননা এই প্রক্রিয়ার উভয়দিকে সমস্যা রয়েছে।

ক. জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণ উপজেলা পর্যায়ে থাকেন না। ফলে দ্রুত গতিতে তাদের পক্ষে ঘটনাস্থলে গিয়ে ব্যবস্থাগ্রহণ সম্ভব নয়।

খ. যেহেতু তাদের সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ আছে ফলে তড়িৎগতিতে তাদের পক্ষে খবর পাওয়া সম্ভব নয়।

গ. অপরাধ সংক্রান্ত খবর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রদানের জন্য জনগণের উপর যেহেতু কোন আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই ফলে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা বাল্যবিবাহের খবর জানতেই পারবেন না। তবে পুলিশ যদি অপরাধী গ্রেফতার করে থাকেন, সে ক্ষেত্রে তারা ২৪ ঘন্টার মধ্যে কোর্টের নিকট অপরাধী হাজির করবেন। এ প্রক্রিয়া এখনো করা হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার আবশ্যকতা নেই। মুসলিম বা হিন্দু বিয়ে যেহেতু একবার সংগঠিত হলে বাতিল হয় না ফলে বাল্যবিবাহ সংগঠণকারী হয়ত অপরাধের জন্য শাস্তি পাবেন কিন্তু তাতে বাল্যবিবাহ রোধ করা সম্ভব হবে না।

২) ইভটিজিং বা যৌন হয়রানী
যৌন হয়রানীর ব্যাপকতা রোধ করার জন্য পরবর্তীতে পেনাল কোডের এ সংক্রান্ত ধারা মোবাইল কোর্টের তফসিলভূক্ত হয়। যার ফল দেশবাসী হাতে নাতে পেয়েছিল। মহামারীর মতো ব্যাপক এ অপরাধ ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছিলো। যে প্রক্রিয়ায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ বাল্যবিবাহ নিয়ন্ত্রণে একটি সমন্বিত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন, মোবাইল কোর্ট না থাকলে সেই নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে পড়বে বলে মনে হয়।

৩) মাদক নিয়ন্ত্রণ
মাদক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ব্যহত হবে। বিশেষত মাদকব্যবসায়ীগণ লাভবান হবে।

৪) সরকারি সম্পত্তি, খাসজমি জবরদখল
সরকারি জবরদখলকৃত সম্পত্তি উদ্ধার প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্থ হবে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তয়ানের ফলে মাঠ প্রশাসন সরকারি সম্পদ উদ্ধারে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে না। এসি ল্যান্ড বা কালেক্টরকে থানা- পুলিশের মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রায় সময়ই দেখা যাবে আইনী প্রক্রিয়াগত দুর্বলতার কারণে সরকার তার মালিকানা সত্ব হারিয়েছে। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। কেননা সম্পত্তি রক্ষার জন্য তারা কর্তৃত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান নয়। বিচার বিভাগের সদস্য হিসেবে তারা নির্বাহী বিভাগের এ কাজ করার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত নন।

৫) রাস্তার গাছ কর্তন
সরকারি গাছ রক্ষা করা সম্ভব হবে না। প্রতিনিয়ত শত শত গাছ কাটা পড়বে। নিয়মিত মামলা হবে, অপরাধী শাস্তিও পাবেন। কিন্তু মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে গাছ কাটার পূর্বেই যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতো, সেটা সম্ভব হবে না। জেলা বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি হিসেবে জেলা প্রশাসক এবং উপজেলাতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার কার্যকরীভাবে গাছকাটা প্রতিহত করতে পারবেন না বলেই প্রতীয়মান হয়।

৬) অবৈধ বালু উত্তোলন
এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটগণের হাতে মোবাইল কের্ট না থাকলে এ সরকারি সম্পদ রক্ষা রক্ষা ব্যহত হবে। 

৭) হাটবাজারের জমি দখল
যে কোন জমি দখল বা জবরদখল সংক্রান্ত অপরাধ বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশে ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে প্রায় আশিভাগ অপরাধ জমি বা জমি থেকে উদ্ভূত। রাজস্ব প্রশাসনের কর্মকর্তাদেন হাতে তড়িৎগতিতে ব্যবস্থা গ্রহণের কোন উপায় না থাকলে দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। 

৮) পাবলিক পরীক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা
এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটদের তৎপড়তার কারণেই পরীক্ষা হলে বাহির থেকে নকল যোগান দেওয়ার তৎপরতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। পরীক্ষা হলের আশেপাশে মানুষের আনাগোনা কম হয়। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হলেও উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। কেননা, ফৌজদারী কার্যবিধি অনুসারে জরুরী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের নয়।

৯) খাদ্য ভেজাল প্রতিকার
ভেজাল খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ব্যহত হবে। এই সমস্যা বর্তমান সমাজে ব্যাপক, ভ্রাম্যমাণ আদালতের নিয়মিত অভিযানের ফলেই তা মহামারী রুপ নেয়নি। বলা যায় ভ্রাম্যমাণ আদালত এ ক্ষেত্রে বহুলাংশে সফল। 

১০) ভোক্তা অধিকার রক্ষা
এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত অবৈধ হওয়ায় ভোক্তা অধিকার হুমকিতে পড়বে। শহর থেকে শুরু করে একেবারে উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে একমাত্র ভরসা মোবাইল কোর্ট। মোবাইল কোর্ট অবৈধ হওয়ায় সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার খর্ব হবে ও বিচারের সবচেয়ে সহজ দড়জাটি চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। 

১১) পর্ণগ্রাফি
পর্ণগ্রাফি আসক্তি একটি সামাজিক ব্যধি। বিশেষত উঠতি বয়সী ছেলে মেয়েরা পর্ণগ্রাফির করালগ্রাসের শিকার মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এই সামাজিক ব্যাধী নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছিল অনেকাংশে। 

১২) জুয়া
জুয়া খেলা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসনকে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয় সব সময়। বিশেষত জুয়া খেলা সংগঠিত হয় গভীর রাতে। এর সাথে জড়িত থাকে স্থানীয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা। মোবাইল কোর্ট না থাকলে জুয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না।

১৩) রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ
রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সার্বক্ষণিক বাজার মনিটর করতে হয়। বাজার মনিটরিং এর মূল দায়িত্ব পালন করে জেলা প্রশাসন। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখতে জেলা প্রশাসনকে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। রমজান আসন্ন, মোবাইল কোর্ট কার্যকর না থাকার ফলে এবার সাধারণ মানুষকে সমূহ বিপদে পড়তে হতে পারে।

১৪) অবৈধ সমাবেশ প্রতিহতকরণ
দাঙ্গা, হাঙ্গামা প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হবে। যেহেতু অপরাধীরা জানবে যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা নেই, তাদেন হিংসাত্বক কার্যক্রম চালিয়ে নিতে বাধা থাকবে না। 

১৫) সড়ক নিরাপত্তা জোরদারকরণ
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা। সড়ক দুর্ঘটনা এখানকার নিত্যকার ঘটণা। মোবাইল কোর্ট না থাকায় সড়ক দুর্ঘটনার ঝুকি বৃদ্ধি পাবে। 

১৬) মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ
অবৈধ নোট ও গাইডবই নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ব্যহত হবে।

১৭) বড় বিপদে পড়বে বিশেষায়িত সেবা সংস্থাগুলো
নানা বিশেষায়িত সেবা সংস্থা যেমন ওয়াসা, ডেসকো, সিটি কর্পোরেশন, বন্দর, বিআরটিএ, মেট্রোপলিটন পুলিশসহ নানা সংস্থা এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা ও ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন তারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনায় বিপদে পড়বেন। এ সকল জায়গায় জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা সম্ভব হবে না কেননা তারা বিচার বিভাগের লোক এবং নির্বাহী বিভাগে তাদের নিয়োগ মাজদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থি। 

মোবাইল কোর্ট নিষিদ্ধ হওয়ার প্রভাব ইতোমধ্যেই তৃণমূলে পড়তে শুরু করেছে। মাঠ প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, মাদক, বালুউত্তোলন বা খাস জমি দখলের একাধিক ঘটনা জানার পরেও তারা কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন নি। এমন পরিস্থিতি বিরাজ করলে মাঠ প্রশাসনের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।