বলতে মানা-৫

প্রকাশ | ১৮ এপ্রিল ২০১৭, ২২:০৮ | আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৭, ২২:১৮

আমার পরিবার এবং বন্ধুদের জীবনের ঘটে যাওয়া টুকরো ঘটনা নিয়েই এই লেখা। এ লেখার পেছনের কারণ অনেক গভীর। আমি বাঙালি ‘ভাল মেয়ে’ বিশেষণের উপর বিশ্বাস হারিয়েছি বহু বছর আগে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের জীবনের ছোট ছোট ঘটনা যা আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি এবং বারবার ভেবেছি তার কিছু অংশ এই লেখার ছোট ছোট টুকরো। কারো জীবন নয় এই সমাজ এর অনমনীয়তা তুলে ধরাই আমার লেখার উদ্দেশ্য। 

আশা করি না এই লেখা পড়ে রাতারাতি সভ্য জাতিতে পরিণত হবো আমরা। তবু একজন নারীর জীবনভাবনাও যদি এই লেখার কারণে পরিবর্তন হয় তাতেও তো এ সমাজ একজন সুখি নারী পাবে। এই গল্পের সব চরিত্র এখনো বেঁচে আছেন এবং আমার বেড়ে ওঠার সময়ে এদের সান্নিধ্যে আসার কারণেই আমার জীবনধারা ব্যতিক্রম হয়েছে। যে জীবন আমার নিঃশ্বাস আটকে রাখে সে জীবন থেকে আমি নিজেকে মুক্ত করে নেই, ক্ষতি নেই যদি তা হয় স্রোতের বিপরীত।

বিঃ দ্রঃ এই গল্পের চরিত্র যদি আপনার চেনা মানুষও হন আমি অনুরোধ করবো চরিত্রকে সমালোচনার বাইরে রাখুন, তার অভিজ্ঞতা এবং এর সমাধান এর ব্যাপারে অভিমত জানান। 

সময় ২০০৫

শাপলা আজকাল কেমন যেন হয়ে গেছে, হঠাত করেই মোটা কাপড়ের সুতি ফুল হাতা জামা, চওড়া ওড়না মাথায় ভাল করে পেঁচিয়ে ক্লাসে আসে। কারো সাথে কথা বলে না, পড়ালেখায় অনেক বেশি মনোযোগ। সকাল পাঁচটায় অ্যালার্ম সেট করে রেখে ঘুমাতে যায়। আটটার ক্লাসে যাবার আগেই দু'ঘন্টা পড়া হয়ে যায় তার। গত চার বছরে সে ক্লাসের সবচেয়ে রাগী মেয়ে হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, রেজাল্ট সাধারণ তাই তার রাগ হজম করার তেমন কোন আগ্রহ কারো ছিল না। আড়ালে শাপলার রূঢ় ব্যবহার নিয়ে হাসি ঠাট্টা এবং টিটকারি নিত্য দিনের বিনোদনের অংশ। বন্ধু বলতে তার এখন আর কেউ নেই। নামায, পড়া, রান্না এবং একমাত্র বান্ধবির সাথে হলের ভেতর হাঁটাহাঁটি এই তার জীবন এখন। অনেক ফিসফাস তাকে নিয়ে, সে জানে, কিন্তু কান পাতে না। লোকের আগ্রহ তো বিন্দুমাত্র কমে না, ঘটনার আড়ালে কি জানা গেল না এখনো।

এই সেদিনও শাপলা ইউনিভার্সিটিতে আসত হালকা রঙের শিফনের কামিজ পরে, কালো গায়ের রঙ যেন আরো চকচক করে উঠত। লম্বা সুন্দর গায়ের গড়ন হলেও সুন্দরী বলে সে কখনো গণ্য হয়নি, গায়ের রঙ কাল এবং চুল কোঁকড়া বলে!

এই নিয়ে তার খুব আফসোস, পার্লারে গিয়ে চুল সোজা করে আসে সে, মুখে হলুদ দেয় ফর্সা হবার আশায়। তাতেও কি আর লোকের চোখে সুন্দর হয় সে! সবাই তো জানে এ ন্যাচারাল 'স্ট্র্যাইট' চুল নয়!

তার বদলে যাবার কারণ সে কাউকে বলে না। গায়ের রঙ বা চুলের 'কার্ল' নয়, তার মন ভেঙেছে অন্য কিছু। গত সাত বছর ধরে পাগলের মত ভালবেসেছে সে মাহবুবকে। মাহবুব তাকে বোঝে, তার 'বদমেজাজ' এর পেছনের সরলতা টের পায়। শাপলা জানে না কি করে ‘ভাল’ ভান করতে হয়, তার মনে যা থাকে সে তাই বলে দেয়। মাহবুব তা জানে, সে রেগে গেলে তাকে শান্ত করে, তার সব কথা ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে শোনে। শাপলার মেয়ে বন্ধুরা তাকে ভালবাসে না, সবাই দূরে সরে গেছে তার মেজাজ সহ্য হয় না বলে, তাদের এত ধৈর্য নেই। শাপলা একা, মাহবুব না থাকলে তার অন্য ছেলে বন্ধুরা তাকে সঙ্গ দিতে ভালবাসে, সরল বন্ধুতা আবার মাহবুব মানতে পারে না। তারা সবাই কলেজে একসাথে পড়েছে, ইউনিভার্সিটিতে এসে একেক জন একেক ডিপার্টমেন্টে। মাহবুব রাগ করবে এমন কিছু সে করতে স্বস্তি পায় না, তাই যখন মাহবুব সিলেটে মেডিক্যাল এ ফিরে যায় তখন শাপলা একাই থাকে, মাহবুব অবশ্য প্রতিদিন ফোন করে, প্রতিমাসে একবার আসে দেখা করতে, সারাদিন থাকে। মাঝে মাঝে দু’তিন দিনও থাকে। এ নিয়ে শাপলার কোন অনুযোগ নেই। একটু একাবোধ করে কিন্তু মেনেও নেয়।

কয়েক মাস আগে শাপলার মা, নিলুফার, একটা ফোন পায় আতাহার সাহেবের কাছ থেকে, আতাহার সাহেব মাহবুবের বাবা। নিলুফার মাহবুবকে ছেলের মত ভালবাসে। তার তিন মেয়ে, অনেক চেষ্টা করেও মেডিকেলে শাপলা পড়তে পারেনি। মাহবুব মেডিকেলে পড়ে, নিলুফারের বুক ভরে যায় ভাবলে যে তার পরিবারে একজন ডাক্তার থাকবে, যে তার নিজের সন্তানের মত। ছেলে না থাকার অপূর্ণতা মাহবুবের চেয়ে ভাল কে পুরণ করতে পারবে? তিনি নিয়মিত খোঁজ রাখেন মাহবুবের খাওয়া হয় কিনা, পড়া কেমন হচ্ছে, এটা ওটা রান্না করেও রাখেন সে বেড়াতে গেলে খাওয়াবে বলে। আতাহার সাহেবের ফোন পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে যায় নিলুফার, নিজের কানকেও বিশ্বাস হয় না, কি শুনছেন এসব! ওপাশে কথার বজ্রবান চলছে, “কালো মেয়ে বিয়ে দিতে পারবেন না বলে আমার ছেলের পিছে লেলিয়ে দিয়েছেন। বাপও তো শুনি মরে গেছে বিশ বছর আগে! জন্মের পরিচয় নাই, গায়ের রঙ নাই, ধনদৌলতও নাই! মেয়ে যে পার করতে পারবেন না জেনে বুঝে আমার ছেলের অল্প বয়সের ফায়দা নিচ্ছেন মা-মেয়ে মিলে"। নিলুফার জানে না আর কি কি বলে গেল সেই লোক, তার হাত পা থরথর করে কাঁপছে। আটাশ বছর বয়সে বিধবা হয়েছে সে। তিন মেয়ে আর তাকে রেখে গেলেন তার স্বামী; বড় মেয়ের বয়স চৌদ্দ, মেজ মেয়ের দশ, ছোট মেয়ে পাঁচ। বড় মেয়ে অনেক সুন্দরী, নিলুফার নিজেও দেখতে ডানাকাটা পরীর মত। বাবার বাড়ি বিত্তশালী, স্বামীও ভাল বেতনের চাকরি করতেন, ক্যামিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। সুন্দর গোছানো সংসার ছিল তার। স্বামীর অকাল মৃত্যু তাকে নতুন বাস্তবের মুখোমুখি করে দিল। ভাইয়েরা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে দিল, স্বামীর সম্পত্তিও পেলেন না ছেলে নেই বলে। সবাই পরামর্শ দিল বড় মেয়ের বিয়ে দিয়ে দাও, ছোট মেয়েদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাও। ভিটে মাটি আছে, মেজ মেয়ে এই তো পনের হবে তাকেও বিয়ে দিতে পারবে। ছোটটাকে মেয়ের জামাইরা দেখবে না হয় কিছুদিন। নিলুফার পাথরের মত শক্ত হয়ে গেল, মেয়েদের নিয়ে ছোট একটা বাসা নিল শহরের এক ছোট গলিতে। সরকারী প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক পরীক্ষা দিল, চাকরি হল শহর থেকে এক ঘন্টার বাস দূরত্বের এক গ্রামে। রোজ দূরপাল্লার বাসে করে একা যায় সে, কত টিটকারি, বাসে লোকজন চুপচাপ গায়ে হাত দিয়ে বসে, ধীরে ধীরে নিলুফার হয়ে উঠে বাঘিনীর মত। তার মেজাজ, তার চাহনি মেয়েদের সাথে তার সম্পর্ক সব উত্তপ্ত। মেয়েদেরও হয়ে গেল মায়ের মত মেজাজ। মা শিখিয়েছেন দুনিয়া খারাপ জায়গা, সবসময় নিজের ভাল খেয়াল রাখতে হবে, কখনো কাউকে কোন দুর্বলতা দেখানো যাবে না। মেয়েরাও তাই হয়েছে ‘বদমেজাজি’। মাহবুবের প্রতি স্নেহ নিলুফারের দুর্বলতা ছিল, বিশ বছরে এই প্রথম তিনি মেয়েদের কোন আবেগকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। কি অপমান করে গেলেন আতাহার সাহেব তাকে সেই 'একবারের' দুর্বলতার জন্য!

শাপলা মাহবুবকে জানায় এই ফোন ‘বজ্রপাতের’ কথা। মাহবুব মানতে রাজি নয় তার বাবা এই ফোন করেছেন। এই নিয়ে প্রথমে অল্প, ধীরে ধীরে অনেক কঠিন ঝগড়াঝাটি হতে লাগল। শাপলার আত্মসম্মানবোধ অনেক তীক্ষ্ণ। যদি মাহবুবের বাবা মনে করে থাকেন বিধবা মায়ের মেয়ের পিতৃপরিচয় নেই মাহবুবের সাথে তার সম্পর্কের এখানেই ইতি টানতে চায় সে। মাহবুব তার বাবাকে জিজ্ঞাসাও করে দেখে না এ কথার সত্যতা কতটুকু। এরকম ফোন আসে কয়েকবার, কখনো আতাহার সাহেব কখনো তার কাছের আত্মীয় মহিলারা। একই বাক্যবাণ, মেয়ে ‘লেলিয়ে’ দিয়ে সোনার টুকরা ছেলে যাদু করেছেন। শাপলা মন ঠিক করে ফেলেছে, সে এই সম্পর্ক আর সামনে নিতে চায় না। মাহবুব হয়ে ওঠে ক্ষেপা কুকুরের মত। সে শাপলার ক্লাসে যায়, তার ক্লাসের সবাইকে বলে শাপলা অন্য ছেলের সাথে রাত্রিবাস করে মাহবুব তাকে হাতেনাতে ধরেছে। রসালো গল্প ডালপালা ছড়াতে থাকে। শাপলার আড়ালে আবডালে ফিসফাস।

একদিন সকাল ছয়টায় কলিংবেল বাজে নিলুফারের দরজায়, আতংকিত নিলুফার দরজা খুলে দেখেন নির্ঘুম চোখ, এলোমেলো চুল, ময়লা শার্ট পরে মাহবুব দাঁড়িয়ে। হতবিহ্বল হয়ে জিজ্ঞেস করেন কি হয়েছে? মাহবুব সোফায় বসে এক গ্লাস পানি খেতে চায়। পানি খেয়ে সে নিলুফারকে শাপলার ‘গোপন প্রেমিক’ এর সাথে ‘গোপন আভিসার’ এর কথা নির্দ্বিধায় বলে যায়। এই বানোয়াট গল্প নিলুফার বিশ্বাস করে বসেন এবং শাপলার মাথার উপর থেকে ছাদ সরে যায়। নিজের বাড়িতে সে আর ফিরতে পারবে না, মায়ের সিদ্ধান্ত। এই ‘নির্লজ্জ’ মেয়ের মুখ তিনি দেখতে চান না!

মাহবুবকে তিনি স্নেহ করেন, মেডিকেলে পড়া ছেলে মিথ্যা নিশ্চই বলছে না। কেনইবা বলবে, সে তো শাপলাকে চায়। শাপলা এই সম্পর্কের ইতি টেনেছে, মাহবুব তো ভালবাসে তাকে!!

এই গল্পের কোন ব্যাখ্যা শাপলা কাউকে দিতে যায়নি, খুব কাছের দুজন বান্ধবি ছাড়া কেউ এর বিশদ জানতে পারেনি। সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, চার বছর পরে ভালবেসে বিয়ে করেছে হাফিজকে। তার বিয়েতে মা কিংবা পরিবারের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। মায়ের প্রতি শাপলার যা কর্তব্য ছিল সবই সে করেছে, মায়ের গৃহে তার প্রবেশের অনুমতি মিলে মায়ের ক্যান্সার ধরা পরার পর।

এই ঘটনার কোন রেশ মাহবুবের জীবনে পড়েনি। শাপলার সাথে সম্পর্ক ভেঙে যাবার এক মাস পরে পরিবারের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করেছে সে যার পিতা মেয়ের বিয়ের সময় ‘জীবিত’ ছিলেন। পিতৃ পরিচয় এর প্রমাণ পেয়েছেন আতাহার সাহেব, পরের বছর পেয়েছেন নাতনি। সুখেই আছে মাহবুব, স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলে বলে ভাগ্যিস বাবা আমাক ‘চরিত্রহীন’ মেয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছেন!

(চলবে...)

লেখক: গবেষক