বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে একটি ক্ষুদ্র উদ্যোগ

প্রকাশ : ১৫ এপ্রিল ২০১৭, ২১:৪৭

গত ১৩ এপ্রিল আমার ফেসবুক বন্ধুর স্ট্যাটাসে দেখি যে মেরাদিয়ায় একজন সপ্তম শ্রেনীর ছাত্রীর বিয়ে, ইতালি প্রবাসীর সাথে। দেখেই সিদ্ধান্ত নেই যেভাবেই হোক রুখে দেবো।

প্রথমেই থানায় যাই, ওসিকে পাইনি। ফোন দেয়ার পর কর অঞ্চল চার এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সহযোগিতা নিতে বলেন। কর অঞ্চল অফিসের এই নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে আাগে কখনো দেখা হয়নি। তিনিও অফিসে নেই। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম, যাই একবার। বিয়ের ঘটনাটা আামাকে নাড়া দিচ্ছিল। আমার কন্যাসম একটা মেয়ের বিয়ে হচ্ছে, মাত্র সেভেনে পড়ে সেটা কি করে সম্ভব?? তখন প্রায় সন্ধ্যা। 

মেরাদিয়ার প্রায় শেষ মাথায়। আমি যখন সে বাসায় পৌছলাম, তখন সে বাসায় কেউ নেই। সোফায় বসে একটা মেয়ে মোবাইলে গেমস খেলছে।

প্রাচী কেমন আাছো?? 
জ্বি ভালো। আাসুন। খুব স্বাভাবিকভাবে বসতে বলল আার জানলা দিয়ে উদাস হয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলো। 
তোমার মা কোথায়? কথা বলবো।
মা বাসায় নেই। 
বাবা? 
বাবাও অফিসে। 
পাশে বসে বললাম, শুনলাম তোমার বিয়ে? এতো ছোট বয়সে?? 
আান্টি কি করবো, আমি তো চাইনি। নানা নানু জোড় করে দিয়েছে।
দিয়েছে মানে? 
২৯ মার্চ আামার বিয়ে হয়েছে।

আামার মাথা কাজ করছিলো না। শুনলাম বিয়ে হবে, এসে শুনি হয়ে গেছে??
তোমার পড়াশুনা হলো না, সংসার করবে এটা কি ভালো হবে?? তুমি না করতে পারতে!! 
আান্টি আমি প্রতিবছর এসে পরীক্ষা দিবো। তারা বলছে, পড়াবে।
আরো জানতে পারলাম গত ২ এপ্রিল তার পাসপোর্টও করা হয়েছে। এগারো তারিখ তারা পাসপোর্ট পেয়েছে। 
আমি দেখতে চেয়েছিলাম, সেটা তার মায়ের কাছে থাকায় দেখতে পারিনি।

চলে আসার ঠিক আগ এ মুহুর্তে প্রাচীর খালা জোড় করে বিয়ের মিষ্টি দিলো, এমন সময় স্থানীয় দুজন ঢুকেই আমার দিকে তেড়ে আসলো। কোথায়, কেন বিয়ে দেবো আপনার এতো লাগছে কেন? আমিও দেশের আইন, তার বয়স ইত্যাদি বুঝাতে ব্যস্ত হলাম। কিন্তু তারা প্রায় গায়ে পড়ে চিৎকার করেই যাচ্ছে। ভয়ও পেয়েছিলাম। যাক পাঁচ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনারের দ্রুত স্পটে আসায় আমি রক্ষা পাই। কিন্তু সিদ্ধান্ত আরো দৃঢ় করি। যেভাবেই হোক প্রাচীকে বাঁচাবো।

ব্যক্তিগতভাবে বারবার ম্যাজিস্ট্রেট, ওসি আর কমিশনারকে ফোন করে চাপ দিতে থাকি। চৌদ্দ তারিখ পহেলা বৈশাখ। বাঙালির উৎসবের দিন। সবাই আনন্দ করছে। আমার দুচোখে প্রাচীর চোখ, মুখ ভেসে আসছে। কিছু করতে পারছি না। নিজের মেয়েকে দেখছি আর অসহায়বোধ বাড়ছিলো। এরমধ্যে ফেসবুকের বন্ধুরা সাহস দিচ্ছিল, যে করেই হোক বন্ধ করার উৎসাহ দিচ্ছিল। মারজিয়া প্রভা, আর আমি ফোনে পরামর্শ শেয়ার করেছি। সুপ্রীতি ধর, মাহমুদা শেলী আর প্রথম আলো মানছুরা আপার দেখানো সাহসে আজ আবারো মেরাদিয়ায় গেলাম। ওসি, ম্যাজিস্ট্রেট আর কমিশনারের সাথে আবারো সেই চাপাচাপি। সাথে ছিলেন যমুনা টিভির সাংবাদিক বন্ধু শান্ত।

আজ দুই পরিবার অঙ্গিকার করেছে তিনশ টাকার স্ট্যাম্পে আঠারো বছর না হলে প্রাচী বিবাহিত জীবন শুরু করতে পারবে না। প্রাচীর বয়স আঠারো হলে তাদের দুই পরিবার তাদের পছন্দের আত্মীয়তা করবে।

এই অঙ্গিকার আপাত আমার প্রতিবাদের বিজয় ভাবলেও কিছু প্রশ্ন রয়েই গেলো।

সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী প্রাচীর নিজের স্বীকারোক্তি বিয়ে হয়েছে। পরে তার পরিবার তা অস্বীকার করেছে।
বিয়ের নিমন্ত্রণ কার্ড দেখেছি, আজ তাদের শুভ বিবাহের দিন ছিলো। যার অনুষ্ঠানিকতা হয়নি।
বিয়ের আলোকসজ্জা ছিলো। তা নিভিয়ে ফেলা হলো।
কাজী অফিসের গত মাসের বিবাহের সবকটি পাতি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি, প্রাচীর বিয়ের খোঁজে। হয়নি। কাজীকেও বলে এসেছি। সাবধান থাকতে।

আজ একজন প্রাচীকে বাল্যবিবাহের হাত থেকে বাঁচানোর এ ক্ষুদ্র উদ্যাোগ আমার। এখনই সফল তা বলাও যাবে না। কারণ প্রাচীর ভুল জন্মনিবন্ধনের সন্ধান আর পাসপোর্টে স্বামীর নাম ব্যবহার হয়েছে কিনা তার অনুসন্ধান চলবে।

প্রাচীর বিয়ের আলো নিভাতে পেরেছি। জীবনের আলো জ্বালাবার জন্য। যারা পাশে ছিলেন সকলকে ধন্যবাদ।

খুজিস্থা বেগম জোনাকীর ফেসবুক থেকে

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত