হোক প্রতিবাদ

প্রকাশ : ১৫ এপ্রিল ২০১৭, ২১:৩৪

মল্লিকা তালুকদার শান্তা

বরাবরই ঘরের বাহির আমাকে বেশি টানে। বাসা থেকে বাইরে বেরুনোর আগে সবসময়-ই একটা উত্তেজনা কাজ করে যে এখন রাস্তায় কতো মানুষ দেখবো, প্রিয় কারো সাথে দেখা হবে কিংবা ভালো কোনো মুহুর্তের সাক্ষী হবো! 

রোজকার মতোই গত ১২ এপ্রিল বেরিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য টিউশনে যাওয়া। যেতে যেতে আগ্রহী চোখে অনেক কিছুই পড়ছিলো। তখনও ভাবিনি একটু পরেই অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু নজরে পড়বে। হঠাৎ করেই রাস্তার পাশে এক দোকানের পাশে বসা দুই জনের দিকে চোখ পড়লো। চোখ পড়তেই এক কাপুরুষের যৌন লালসার দৃশ্য। 

জানোয়ারটা মাস্টারবেশন করার মতো ভঙ্গি করতে শুরু করলো, চোখে গিলে খেয়ে ফেলার মতো অভিব্যক্তি। কয়েক সেকেন্ডের দৃশ্য যা আমাকে কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ করে দিয়েছিলো। পাশে বসা সঙ্গীও যোগ দিয়েছিলো সমস্ত পুরুষ জাতিকে ছোট করার কাজে।

আমি প্রতিবাদ করতে পারিনি। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকানো ছাড়া আর কিছু করতে পারিনি। আশেপাশে কেউ না থাকায় সাহস হচ্ছিলো না কিছু বলার বা করার। চোখে ক্রোধ আর মনে ঘৃণা নিয়ে বাকিটা রাস্তা অতিক্রম করেছিলাম। গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে বাকিটা পথে কারো দিকের তাকাই নি। যদি আবার এমন কিছু দেখতে হয়!

ফেরার পথে আরো কিছু অপেক্ষা করছিলো ভাবিনি। রাত ৮ টার দিকে ফিরছিলাম। পাড়ার গলিতে এক জায়গায় একটা মোটর সাইকেল দাঁড়ানো ছিলো। আমি কাছাকাছি আসতেই শরীর নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য। বিশেষ অঙ্গ স্পর্শ করার ইঙ্গিত। আমাকে প্রতিবাদ করার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত গতিতে মোটর সাইকেলে টান।

ঘটনাগুলো প্রতিদিনকার সাধারন ঘটনা আমাদের দেশে।কোনো না কোনো নারী প্রতিদিন,প্রতি মুহুর্তে এই রকম জঘন্য অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছে। আমার জীবনেও নতুন নয়। কিছু সময় মাথায় ঘুরছিলো ঘটনা দু’টো। বারবার মনে হচ্ছিলো আমি প্রতিবাদ কেনো করতে পারি নি।আমি তো ভীতু নই! 

কিছুদিন আগেও ভিড়ের মাঝে এক লম্পটের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছিলাম। হাত টেনে ধরে নিচে ফেলে দিয়েছিলাম। সেদিন কয়েক জোড়া পা এগিয়ে এসেছিলো আমাকে সাহায্য করতে। দৌড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলো কাপুরুষটা। তাহলে আজ কেন পারিনি প্রতিবাদ করতে? প্রতিবাদ করার মতো সাহস থাকা সত্ত্বেও পারিনি। পরিস্থিতি অনূকুলে ছিল না? নাকি সাহসটা কমে গেছে আমার? 

নিজের কাছে লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম প্রতিবাদ করতে পারি নি বলে। তখনই প্রতিজ্ঞা করেছি আমি প্রতিবাদ করবো। যেকোনো পরিস্থিতিতে প্রতিবাদ করবো। এই যৌনলালসাগ্রস্থ পুরুষদের ‘পুরুষ’ বললে পুরুষ শব্দটাকে অপমান করা হবে, সব পুরুষদের অপমান করা হবে। এরা কাপুরুষ, বাকিরা পুরুষ। প্রতিদিন দিনের আলোয় কিংবা রাতের অন্ধকারে, প্রকাশ্যে কিংবা আড়ালে এই ধরনের ঘৃণ্য ঘটনা ঘটছে যা আমাদের সমাজের অন্ধকার দিককে তুলে ধরছে। কেন ঘটছে এমন ঘটনাগুলো? আমি, আপনি কেন প্রতিবাদ করতে পারছি না? সমস্যাটা হয়তো আমাদের সামাজিকীকরণে। ছেলেবেলা থেকেই সমাজ আমাদের নানাভাবে বুঝিয়ে দেয় আমরা নারী। 'নারী' শব্দটাকে দুর্বলভাবে উপস্থাপন করা হয়। আমাদের নারী পরিচয়টাই মুখ্য, মানুষ পরিচয়টা গৌণ। আর যেহেতু আমি নারী সেহেতু আমাকে অনেককিছু সহ্য করতে হবে; হোক না তা অন্যায়। যেহেতু লজ্জা আমার ভূষণ তাই আমি লজ্জায় মুখ বুজে থাকবো।

দুঃখজনক হলেও এটিই সত্য যে, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে যেখানে সমগ্র পৃথিবীজুড়ে নারী নিজেদের পরিচয়কে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে, নিজেদের অবস্থানের উন্নতির জন্য কাজ করছে। সেখানে কিছু অসুস্থ মস্তিষ্কের প্রাণী আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয় আমরা নারী। আর আমরা প্রতিবাদ করি না বলেই জানোয়ারগুলো সুযোগ পাচ্ছে এই ধরনের অসুস্থ মানসিকতার চর্চা করার। অন্যায় প্রতিরোধ করার জন্য প্রতিবাদের বিকল্প নেই। একবার আওয়াজ তুলে দেখুন। দেখবেন আপনার কন্ঠের সাথে অনেক কন্ঠ মিলে বজ্রকন্ঠের হুংকার উঠছে যা রুখে দিতে পারে সেইসব পশুদের নোংরামিকে।

বিশ্বাস করুন, সমাজে কাপুরুষ যেমন আছে, পুরুষও আছে। অমানুষের থেকে মানুষই বেশি আছে। আর এইজন্যই এখনো টিকে আছে সমাজ। নারী উন্নয়নে পুরুষদের অবদান কম নয়। তবে প্রধান ভূমিকাটা আমাদেরই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের নির্লিপ্ততা আমাদের এগুতে দিচ্ছে না। আমার, আপনার সাথে ঘটে যাওয়া যৌন নিপীড়ন আমার আপনার লজ্জা নয়, বরং প্রতিবাদ না করে মুখ লুকিয়ে থাকাটা আমাদের লজ্জা। তাই আমি প্রতিবাদ করবো। আপনিও করুন। নারী বলে কেনো পিছিয়ে থাকতে হবে? ভয়ে, লজ্জায় কুঁকড়ে থাকতে হবে? আমরা নারী আর আমরা গর্বিত আমাদের পরিচয়ে। আমাদের দশভুজা রূপের এক রূপ হউক প্রতিবাদী রূপ।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত