ঝড়টা কোথায় বলতে পারো?

প্রকাশ : ১০ এপ্রিল ২০১৭, ০০:২৭

চায়ের কাপে ঝড় উঠেছে। ধোঁয়া ওঠা কাপে এক এক করে ভেসে উঠছে মহিন কাকার টঙ্গের দোকানের টুংটাং। তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে নিত্যানন্দ হেডমাস্টারের সাইকেল। ক্রিং ক্রিং। মধ্যপথে আব্বার সাথে তার দেখা। সাইকেল থামিয়ে বলে; বলি বিমল, তৃণ তো পড়ে না কিছুই। সারাদিন গুলতি হাতে এদিক সেদিক। খেয়াল রাখিস কিছু! মায়ের তো সারাদিন ট্যা ট্যা, মেয়ে মানুষ ক্যামনে এতো ছেলেদের মতো বাঁদরামী করে আমার তো মাথা কুলায় না বাবা। এ নিশ্চয়ই আমার গত জন্মের পাপ! দাদী এসে ঝুপ করে বটিটা উঠোনে ফেলে বলে, খবরদার বৌমা, আমার নাতিন নিয়ে তুই আর একটা কথাও বলবি না। তার মাথা ভালো, একদিন সে বিদেশ যাইবে পড়তে। বড় হইবে।

দাদীর কথাই সই। আমি আজ অনেক বড়। চায়ের জায়গায় কফি। আর দাদী তার কয়বছর পরেই হেঁটে হাসপাতাল গেলো। ফিরে এলো কফিনে করে। দাদী দেখে যেতে পারেননি তার বলে যাওয়া কথা ফলে এখন কী গাছ? সেগুন কাঠ নাকি আমড়া কাঠের ঢেঁকি!

ওহহ হঠাৎ ঢেউ যেন... হিমেল একটা বাতাস আমার গ্রীবা ছুঁয়ে গেলো। যেন কারো হাতের আলতো স্পর্শ ওতে। আমি প্রিন্সটন ইউনির্ভাসিটির ক্যাফেটেরিয়াতে বসে আছি। এই ভার্সিটির ভবনগুলো এতো প্রাচীন সৌন্দর্যে ভরপুর। তাকালেই মনে হয় সদ্য জেগে উঠেছে কোন গুহা ভেদ করে। শ্যাওলা শ্যাওলা ঘ্রাণ! যেন কান পাতলেই শুনতে পাওয়া যাবে বব ডিলান।

আমি বসে আছি, অনেকটা কাক ডাকা ভোর হতে ক্লান্ত রাখালের দিনশেষে ফেরা সন্ধ্যার মতো। কলমের নিপ কামড়ে উদ্ধার করছি, নিকষ কালো রাতের পরে আলো ঝলমলে দিন আসবার সূত্র। কবে গ্র্যাজুয়েশান! মধ্যদুপুর শিথানে। তীব্র দুপুরেরও মাঝে মধ্যে কী যেন হয়। প্রখর রোদ হঠাৎ অভিমানে নীরব কুসুম। কার ওপরে রাগ করে সে? নতুন বউয়ের মতো চোখফোলা অভিমান ক্ষণে ক্ষণে ডানা মেলছে আর বন্ধ করছে। সেই কখন থেকে অভিমানী রোদকে জড়িয়ে আছে ঘনমেঘ। মেঘ আর বৃষ্টি এরা কার কি হয় কী জানি! একজন মন ভারী করলেই আরেকজনের কান্না।

ক্যাফেটেরিয়ার স্বচ্ছ কাচ বেয়ে টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে বৃষ্টি। এর সাথে মহিন কাকার দোকানের এক বিন্দু মিলও নেই। তবু এখানে আসলেই আমার কাকার সেই দোকানের কথা মনে পড়ে। হু হু করে মনের মাঝি বায় অতীতের নৌকা। কেন ভাবনারা এমন হয়? মানুষের মনের মতো অদ্ভুত আর কী আছে। আনমনে এইসব থাকা না থাকার ভাবনা থেকে বেরোতেই দেখলাম, আমার স্থির দৃষ্টি সাইন্স ফেকাল্টির ভিক্টোরিয়ার বুকের বোতামে আটকে আছে। নয়তো কী করে দেখলাম ভিক্টোরিয়া হাতের কাছে জমিয়ে রাখা জ্যাকেটের হাতগুলো বুকের কাছে জড়িয়ে নিচ্ছে! দেখাদেখিতে কী মানুষ অবচেতন মনে নিজেও তাই করে? আমি গায়ের চাদর টেনে নিই। উত্তর দিক থেকে আসা হিমেল বাতাসে তিরতির করে কেঁপে উঠে আমার ঠোঁট। ফিলিপ বুঝে না ওতে কখনো উষ্ণতার আহবান থাকে কখনোবা বিষন্নতার বুনন। না বললে কার অনুভব গভীরে গিয়ে কে বুঝেছে, কখন?

ভাষাহীন ভাষা বুঝে নেয়ার ক্ষমতা নিয়ে কয়জন মানুষই বা আসে একটা মানুষের জীবনে? ওহহ ফিলিপ। ফিলিপের সাথে পরিচয় করিয়ে দিইনি। ভুলেই গেছি বলতে, কে সে?

ফিলিপ আমার বন্ধু। সে ধোঁয়া ওঠা কফিতে ঢাকনা দিয়ে দিলো। হ্যাই হোয়াটস আপ টৃণ! ফিলিপ তৃণ বলতে পারে না। আমার মেজাজ খারাপ হয়। কিছু মানুষ মেজাজ খারাপ দেখেও রসিকতা করার অপূর্ব ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। ফিলিপ আমাকে ইঙ্গিত করে বলে: Did you see how hard it's raining? It's amazing! Ever walked in the rain with bare feet? Let's try.. Hey young lady! you ever kissed in the rain?

আমি বিড়বিড় করে বলি; হুম... ভেজা না শুধু বৃষ্টির মধ্যে ইচ্ছা কইরা পরন ও খাইছি। শালা! এখন দূরে গিয়া মর! ফিলিপ কিছুই বুঝেনি। তবে সে এটা বুঝে গেছে মাঝেমধ্যে আমি বিড়বিড় করে কী যেন বলি। তখন সে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকায়। তাতে প্রশ্ন লেখা, হোয়াট ডিড ইউ সে?

এমন অসংখ্য 'হোয়াটে' ফিলিপ আর আমার বন্ধুত্বের উঠোন ভরে যায়। ফিলিপ বুঝেনি; আমি কিছুই কাউকে বোঝাতে পারি না। এতো কষ্ট হয়। আমার অন্তর যে ভাষায় কথা বলে মুখ তা বলতে পারে না। আমার ভাষায় আমি কথা বলতে পারি না। বুকটা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায় প্রতিনিয়ত।

হায়রে ভাষা। আমি যে ভেসে ভেসে এতো দূর এলাম। আমার পোষাক পরিচ্ছদ সব পরিবর্তন হয়েছে। এমনকি আমি নিজেও খানিকটা। কিন্তু হদয়ের গহনে যে শব্দ, যে ভাষা, যে প্রেম তা তো থেকেই গেছে। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হতো। ব্যথা আমার নিজের। ব্যথা পেলে আন্তর্জাতিক ভাষায় প্রকাশের কষ্ট আমার সহ্য হয় না আর!

ফিলিপ। ফিলিপের সাথে বন্ধুত্ব বাঁচেনি আমার। কোথাও যেন আমি ঠিক আমার মতো। যেদিন সে যায় সেদিন খুব করে বলে যায়, ইউ নেভার চেঞ্জড। আমার মুখের বোল সে বুঝতে পারে না। আমার রক্তক্ষরণ হয়। এর সাথে ৫২র ভাষা শহীদদের ব্যথার মিল আছে কীনা কি জানি।

আমি জানি, এই মানুষের অরণ্যে কোথায় যেন আমি একা, খুব একা। হাহাকার করে উঠে বুকের বিল। যেখানে অবিরাম বেজে যায় মহিম কাকার টুংটাং। নিত্যানন্দ হেড মাস্টারের ক্রিং ক্রিং। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ধাক্কা খেলাম। স্বর থেকে হঠাৎ ছিটকে পড়ে ও মাগো! মা... কেউ তা বুঝতে পারে না।

লেখক: প্রবাসী বাঙালি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত