বলতে মানা-২

প্রকাশ : ০৯ এপ্রিল ২০১৭, ২৩:৫৮

আমার পরিবার এবং বন্ধুদের জীবনের ঘটে যাওয়া টুকরো ঘটনা নিয়েই এই লেখা। এ লেখার পেছনের কারণ অনেক গভীর। আমি বাঙালি ‘ভাল মেয়ে’ বিশেষণের উপর বিশ্বাস হারিয়েছি বহু বছর আগে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের জীবনের ছোট ছোট ঘটনা যা আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি এবং বারবার ভেবেছি তার কিছু অংশ এই লেখার ছোট ছোট টুকরো। কারো জীবন নয় এই সমাজ এর অনমনীয়তা তুলে ধরাই আমার লেখার উদ্দেশ্য। 

আশা করি না এই লেখা পড়ে রাতারাতি সভ্য জাতিতে পরিণত হবো আমরা। তবু একজন নারীর জীবনভাবনাও যদি এই লেখার কারণে পরিবর্তন হয় তাতেও তো এ সমাজ একজন সুখি নারী পাবে। এই গল্পের সব চরিত্র এখনো বেঁচে আছেন এবং আমার বেড়ে ওঠার সময়ে এদের সান্নিধ্যে আসার কারণেই আমার জীবনধারা ব্যতিক্রম হয়েছে। যে জীবন আমার নিঃশ্বাস আটকে রাখে সে জীবন থেকে আমি নিজেকে মুক্ত করে নেই, ক্ষতি নেই যদি তা হয় স্রোতের বিপরীত।

বিঃদ্রঃ এই গল্পের চরিত্র যদি আপনার চেনা মানুষও হন আমি অনুরোধ করবো চরিত্রকে সমালোচনার বাইরে রাখুন, তার অভিজ্ঞতা এবং এর সমাধান এর ব্যাপারে অভিমত জানান। 

সময় ১৯৮৮

জয়নাবের আজ বিয়ে। বয়সটা একটু বেশি হয়ে গেছে, এই শ্রাবণে চব্বিশ হল। দাখিল পাশ করে ঘরে বসেছিল সে, প্যারালাইজড মায়ের দেখাশোনা করেছে। পড়ালেখার অনেক ইচ্ছা ছিল, বাবা আর বড় ভাইজান দিলেন না। গ্রামের মাদ্রাসায় পড়ানোর চাকরি শুরু করেছিল সে, বড় ভাইজান কার কাছে শুনতে পেয়ে রাগে আগুন হয়ে ঘরে ফিরলেন, “মেয়ে মানুষের টাকা ঘরে আসবে! আস্তাগফিরুল্লা”। 

চাকরিটা ছাড়তে হল। সেই ষোল বছর বয়েস থেকে ঘরেই থাকে সে, রাঁধে, মায়ের সেবা করে, বড় ভাইজানের ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করে। ভাইজানের বড় সংসার, ফি বছর সন্তান আসে। মেজ দুলাভাই একবার তাকে ঢাকা নিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন, একজন শিক্ষিত ভদ্রলোকের সাথে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন, বাবা মানলেন না। এখন একটু বয়স বেড়ে গেল বলে যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিতে হচ্ছে, ছেলে যদিও বাবা আর ভাইজানের অনেক পছন্দ হয়েছে। ধার্মিক মানুষ, চাপদাড়ি আছে, ব্যাংকে চাকরি করে। যৌতুকের কথায় জয়নাবের মন চুপসে গেলেও কেন জানি মেজ দুলাভাই গুণে গুণে বড় ভাইজানের হাতে টাকা দিয়ে গেলেন! মাঘ মাসের শীতের কনকনে ঠান্ডা রাতে আপার ছেলেমেয়েরা গায়ে হলুদ করে নাচল। সাদামাটা একটা বিয়ে হল, গ্রামের মেয়ের বিয়ে যেভাবে হয়। 

উপশহরে শ্বশুরবাড়ি, বাবার বাড়ি থেকে রিকশা করে এক ঘণ্টার পথ। এই পথ যে কত দূর তা সে টের পেল বিয়ের পর শাশুড়ি আর স্বামীর হাতের চেলা কাঠ যখন তার পিঠে ধুমাধুম পড়তে লাগল। বিয়ের বছর ঘুরতেই নিজের পেটে বাচ্চা, সেই সাথে তিন বছর বয়সি দেবরের দেখাশোনা, ননদ-শ্বাশুড়ি-স্বামীর সেবা, ঘরদোরের দায় দায়িত্ব সব তার উপর। পান থেকে চুন খসলেই জ্বলন্ত চেলা কাঠের বাড়ি! 

প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে জয়নাব দেখলো তার ভাইবোনেরা কেউ তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো না। এই জাহান্নামে সে রয়ে গেলো বছরের পর বছর, পাঁচ সন্তানের মা হল। বিয়ের পনের বছর পরে এই নরক থেকে সে বের হতে পারল ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার দোহাই দিয়ে। মাত্র চল্লিশ বছর বয়েসে বার্ধ্যকের ছাপ তার শরীরে। সন্তান ধারণ না করলে স্বামী আবার বিয়ে করবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন, তাই আবার সন্তানসম্ভবা তিনি! চার কন্যা সন্তানের মা তিনি, আগলে আছেন তাদের। কোন অবস্থাতেই নিজের দুর্ভাগ্যের পুনরাবৃত্তি চান না তার কন্যাদের জীবনে। তারা পড়ছে, কাজ করছে, বিদেশেও পড়তে গেছে তার মেয়ে! নিজের মেধা এবং পরিশ্রম দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে তারা।

(চলবে...)

লেখক: গবেষক

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত