প্রথম বিদ্যালয় ‘মা’

প্রকাশ : ০৯ এপ্রিল ২০১৭, ১৯:২৭

নাসরীন মুস্তাফা

ইন্সট্যান্ট নুডলস এ যুগের মায়েদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে। ঝটপট বানিয়ে ফেলা যায়। মসলাও রেডিমেড, প্যাকেটের ভেতরেই আছে। শুধু খোল আর ছাড়। ইন্সট্যান্ট নুডলস যুগে বাবা-মায়েরা ‘ঝটপট’ সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। আর তাই প্রি-স্কুল বাচ্চাদের জন্যও ইন্সট্যান্ট শিক্ষাদানের কোচিং থেরাপি চালু হয়ে গেছে। বাবা-মায়েরা 'ঝটপট' পদ্ধতিতে বাচ্চাকে স্কুলের জন্য প্রস্তুত পেয়ে যাচ্ছেন। নামিদামি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে পারছেন। সমাজে হাততালি জুটছে। নিজেদেরও সময় বেঁচে যাচ্ছে।

শিশু নাকি মায়ের পেটে থাকার সময় থেকেই শিখতে শুরু করে। পৃথিবীতে আসার পর এই শেখার সাথী পেয়ে যায়। প্রথম সাথী হচ্ছে মা। এরপর বাবা। এরপর ভাইবোন। এরপর পরিবারের বাকিরা। এরপর সমাজের অন্যরা। শিশু কেবল কোনো একটি পরিবারের নয়। প্রতিটি শিশু সমাজের উপহার। রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ। এত যে গুরুত্বপূর্ণ সদস্যটি, তাকে 'ঝটপট' গড়ে-পিটে তোলা কি সত্যিই সম্ভব? সত্যিই কি শিশুকে গড়ে তুলতে চাইছি আমরা? 

শিশুর সত্যিকারের শিক্ষা শুরু হয় পরিবার থেকে। পরিবারের সদস্যরা তাকে যা শেখাতে পারবে, তা কোনো কোচিং ক্লাস বা প্রি-স্কুল শেখাতে পারবে না। লিখতে শেখা ও পড়তে শেখার যে ‘কঠিন’ বিদ্যা, তা শেখার জন্য মায়ের কোল, বাবার হাত, ভাইবোনের খুনসুটি, দাদির মুখের গল্প যথেষ্ট। পরিবার নামক আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী 'স্কুল' এখন কেন কার্যকর হতে পারবে না? পারবে। ভালোবাসার চেয়ে বড় শিক্ষক কোথাও নেই, এই বিশ্বাসটাই কেবল দমের সঙ্গে নিতে হবে বুকের ভেতর। পরিবারের ভালোবাসা কী করতে পারবে? প্রি-স্কুল শিশুটিকে বর্ণমালা আর সংখ্যার সঙ্গে পরিচিত করে তুলতে নানা রকমের মজাদার খেলার আয়োজন করতে পারবে। সারা দিনে ব্যস্ত পরিবার রাতে শিশুর ঘুমানোর সময়টায় টেলিভিশনের মতো ভয়াবহ যন্ত্রের সামনে আত্মসমর্পণ না করে শিশুকে গল্পের বই পড়ে শোনাতে পারে। শিশুরা যা শোনে, তার চেয়ে যা দেখে তা থেকে বেশি শিক্ষা নেয়। বই পড়ূয়া বাবা যে শিক্ষা শিশুকে দেবেন, সে শিক্ষা ‘বাবা সোনা, তুমি বই পড়’ বলে শিশুকে অনুনয়-বিনয় করলেও কাজ হবে না। মায়ের কোলে শিশুকে বসিয়ে মায়ের আঙুল শিশুর ছোট্ট আঙুলকে সঙ্গে নিয়ে ছুঁয়ে যাক- প্রতিটি বর্ণমালা বা সংখ্যা বা গল্পের অক্ষর। মায়ের কণ্ঠে ঝরে পড়ূক গল্পের চরিত্রগুলো। মা হাসুক হা-হা করে। শিশুও হাসুক মায়ের হাসিতে তাল মিলিয়ে। ঝরাপাতার দুঃখে মায়ের কণ্ঠে কান্না জমুক, সে কান্না শিশুকে ভালোবাসার পাঠ দিক। প্রিয় লেখক জাফর ইকবালের একটা লেখায় পড়েছিলাম, প্রি-স্কুল শিশু কীভাবে বাবা-মায়ের সঙ্গে গল্পের বই ‘ছুঁয়ে’ দেখতে দেখতে আর শুনতে শুনতে পড়তে শিখে গেছে। আমার নিজের গল্পটা এইবার বলি। বিদেশে পোস্টিং শেষে দেশে ফিরব। আমার ছোট মেয়ে তখন প্রথম শ্রেণি শেষ করেছে। ইংরেজির পণ্ডিত বটে, বাংলাও চমৎকার বলতে শিখিয়েছি, কিন্তু পড়তে আর লিখতে পারে না। ব্যস্ততার জীবনে সময় হয়ে ওঠেনি হাতে-কলমে শেখানোর। তবে দেশে ফেরার আগে আগে বসলাম ওকে নিয়ে। কোলের ওপর বসিয়ে মেলে ধরা বাংলা গল্পের বইয়ে আমার হাতে ওর হাত রেখে ছুঁয়ে দেওয়ার খেলা খেললাম। এক সপ্তাহ পরে ও একাই পড়তে শুরু করল। হরলিক্স মা শিশুর দুরন্তপনার সঙ্গে পাল্লা দিতে ছুটছেন আর শিশুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন হরলিক্স নিয়ে। ওর জন্য তৈরি হতে হবে, এই বোধ তৈরি করুক সব মাকে, সব বাবাকে, সব পরিবারকে। তবে কি-না পানিতে চার চামচ হরলিক্স ছেড়ে দিয়ে গুলিয়ে দিলেই কিন্তু সব হয়ে যাবে না। এর সঙ্গে ভালোবাসাটুকুও থাকতে হবে। না হলে ইন্সট্যান্ট 'ফাঁকি' ধরে ফেলবে শিশু। আর কে না জানে, শিশুদের বড় বুদ্ধি। সব কিছু বুঝে ফেলে।

সূত্র: সমকাল, ০৯ এপ্রিল ২০১৭

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত