প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফর ও তিস্তা চুক্তি

প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০১৭, ১৬:০২

বাংলাদেশ নৌবাহিনী তার ভাণ্ডারে দু’টি সাবমেরিন যুক্ত করেছে। এগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে গণচীনের কাছ থেকে। প্রশ্ন উঠেছে যে—এতো খরচ করে ডুবোজাহাজ কেনাটি বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন ছিল কি? আরো প্রশ্ন উঠেছে—গণচীন থেকে তা কেনার ফলে বাংলাদেশকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের মধ্যকার দ্বন্দ্বের স্ট্র্যাটেজিক সমীকরণের বিপজ্জনক খেলায় জড়িয়ে ফেলা হলো কি? এসব প্রশ্ন নিয়ে বিতর্কমূলক নানা অভিমত রয়েছে। দেশে ও দেশের বাইরে, বিশেষত ভারতের গণমাধ্যমে, এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ও আলোচনার ঝড় উঠেছে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরকে কেন্দ্র করে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন সম্পর্কে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি নতুন করে আবার সামনে এসেছে। প্রথম বিষয়টির সঙ্গে জড়িত ‘সাগর’ এবং দ্বিতীয়টির সঙ্গে জড়িত ‘নদী’। এই সাগর ও নদী হলো বাংলাদেশের জীয়নশক্তির অন্যতম উৎস। সে কারণে দেশবাসীর মাঝে সাবমেরিন ও তিস্তা চুক্তি নিয়ে একই সঙ্গে আগ্রহ ও উদ্বেগের কোনো শেষ নেই।

একথা আমরা অনেক সময় ভুলে যাই যে আমরা সাগরপাড়ের দেশের মানুষ। বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণদিক জুড়ে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এই উপসাগর যুক্ত হয়েছে ভারত মহাসাগরে। ‘বঙ্গ’ নামের ভূখণ্ডের প্রধান অংশ নিয়েই এখনকার বাংলাদেশ। সেই ‘বঙ্গ’ ভূখণ্ডের নামে যে সাগরের নামকরণ, সেটিই হলো বঙ্গোপসাগর। ইংরেজরা নাম দিয়েছিল Bay of Bengal। সেই বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত ও মিয়ানমারের বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে। এটি আনন্দের খবর। কিন্তু এক্ষেত্রে এখন যে প্রশ্ন নিয়ে দেশবাসীর উদ্বেগ তা হলো, সাগর এলাকা ও তার সম্পদ-ভাণ্ডার কিভাবে ও কার স্বার্থে ব্যবহার হবে তা নিয়ে। বঙ্গোপসাগর হলো অনুত্তোলিত বিপুল সম্পদ-ভাণ্ডারের উত্স। এ সম্পদের অতি অল্পই আমাদের দেশ বর্তমানে কাজে লাগাতে সক্ষম হচ্ছে। সাগরের লোনা পানিতে রয়েছে বিপুল মত্স্য ও প্রাণীজ সম্পদ। রয়েছে নানা উদ্ভিজ্জ সম্পদ। প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে সেই লোনা পানি থেকে শুধু লবণই নয়, পাওয়া যেতে পারে বহু মূল্যবান খনিজ ও রাসায়নিক সম্পদও। তাছাড়া, সাগরের তলদেশে রয়েছে অনেক অমূল্য সম্পদ। সেখানে রয়েছে অনাবিষ্কৃত বিপুল গ্যাস ও তেলের ভাণ্ডার। এসব সম্পদ ছাড়াও সমুদ্র যোগাযোগের ক্ষেত্রে, এবং তার চেয়ে বেশি ভূ-সামরিক ক্ষেত্রে, বঙ্গোপসাগরের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। বাংলাদেশ তার সংগ্রহকৃত ডুবোজাহাজ দু’টিকে কাজে লাগাবে প্রধানত বঙ্গোপসাগরে। এর ফলে সমগ্র অঞ্চলে একটি বহুমাত্রিক ভূ-সামরিক অভিঘাত সৃষ্টি হবে। তার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, প্রধানত সে কথা ভেবেই ডুবোজাহাজ নিয়ে এতো আলোচনা। এ বিষয় নিয়ে আজ বিস্তৃত আলোচনায় গেলাম না। আজ মূলত নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবো।

নদীর পানি বণ্টনের প্রসঙ্গ নিয়ে আগেও লিখেছি। আজ আবার লিখছি। পান করার জন্য, চাষাবাদ করার জন্য এবং আরো একশো-একটা কাজের জন্য মিঠাপানির কোনো বিকল্প নেই। মিঠাপানির জন্য মানুষকে নির্ভর করতে হয় প্রধানত ডাঙার নদী, খাল, বিল, জলাশয় ইত্যাদির ওপর। তাছাড়া নির্ভর করতে হয় ভূপৃষ্ঠের নীচে জমে থাকা মিঠাপানির স্তর ও ‘পানির খনির’ ওপর। এসবের বাইরে, বৃষ্টির পানিও মিঠাপানির একটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উৎস। সাগরের পানি বাষ্পায়িত হওয়ার পর মেঘ হয়ে বৃষ্টির আকারে মাটিতে আসার পর তা মিঠাপানির ভাণ্ডারকে পুষ্ট করতে সক্ষম হয়। এসব বহুবিধ উৎস সত্ত্বেও মানুষের জন্য মিঠাপানির প্রধান উৎস হলো ডাঙার ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীর পানি। এ কথাটি নদীমাতৃক বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য।

পৃথিবীতে জনসংখ্যা বাড়ছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে মিঠাপানির চাহিদা। কিন্তু মিঠাপানির সরবরাহ সীমাবদ্ধ। ফলে মিঠাপানির প্রাপ্তি নিয়ে দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে, মানুষে-মানুষে টানাটানি বাড়ছে। এই টানাটানি ভয়ানক সব দ্বন্দ্ব-বিরোধের রূপ নিতে শুরু করেছে। মিঠাপানি নিয়ে পরিস্থিতি আরো সংঘাতময় হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। মিঠাপানির প্রধান উত্স যেহেতু ডাঙায় প্রবাহিত নদীসমূহ, তাই ভবিষ্যতে নদী ও তার পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ সংঘাতের প্রধান উপলক্ষ হয়ে উঠতে পারে। যেহেতু বাংলাদেশ মানেই হলো ‘নদীর দেশ’ এবং অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় সে তার ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীর উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল, তাই সেসব নদ-নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিরোধ তার অস্তিত্বের প্রশ্নের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। নদী এদেশের জন্য ‘আশীর্বাদ’। কিন্তু নদী নিয়ে বিরোধ তার জন্য ‘অভিশাপ’ও হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের জন্য তিস্তা চুক্তির গুরুত্ব সেই আলোকেই বিচার করতে হবে।

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের এ পরিচয় অনেক বেশি সত্য। স্বদেশ হলো আমাদের মাতার মতো, তাই আমরা বলি ‘দেশমাতৃকা’। কিন্তু যা কিনা সেই দেশমাতৃকার ‘মাতার মতো’ তা হলো নদী। সে কারণেই আমরা আমাদের দেশকে একইসঙ্গে বলি নদীমাতৃক দেশ। সে কারণে  বলা যায় যে, আমাদের ‘মাতার মাতা’ হলো বাংলাদেশের নদ-নদী।

কথাটি আক্ষরিক অর্থেই সত্য। মাতার গর্ভ থেকে যেমন সন্তানের জন্ম হয়, বাংলাদেশের জন্ম তেমনি হয়েছে নদ-নদীর গর্ভ থেকে। যুগ-যুগ ধরে তিন তিনটি বড়-বড় নদীপ্রবাহ পদ্মা-যমুনা-মেঘনা তাদের বিপুল পরিমাণ পলিমাটি বহন করে দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে বঙ্গোপসাগরে এসে মিশেছে। মোহনার মুখে এসে তাদের বক্ষে বহন করা পলি তারা সাগরের মুখে ঢেলে দিয়েছে। যুগ-যুগ ধরে চলেছে এই পলি আনয়নের প্রক্রিয়া। ক্রমান্বয়ে জেগে উঠেছে চর। কালক্রমে সে চর উঁচু হয়েছে। সাগরের উপকূল ধরে এভাবে পলিমাটি পড়ে বিস্তৃত হয়েছে ডাঙার সমতলভূমি। সৃষ্টি হয়েছে ‘বঙ্গের’ ক্রমপ্রসারমাণ ভূখণ্ড। বাংলাদেশ শুধু পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্ ব-দ্বীপই নয়, এটি হলো পৃথিবীর বৃহত্তম ‘সক্রিয় ব-দ্বীপ’। নদী দিয়ে পলি আসা বন্ধ হলে, অথবা তা ক্ষীয়মাণ হয়ে উঠলে, সেটি হবে যুগ-যুগ ধরে চলে আসা ভূখণ্ডের ক্রমসম্প্রসারণ প্রক্রিয়াকে গলা টিপে হত্যা করার মতো একটি ঘটনা। তা হবে মাতৃগর্ভে সন্তানের জীয়নশক্তি হরণের মতো ঘটনা।

মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশবাসীর স্লোগান ছিল—‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’। এই স্লোগানের মধ্য দিয়ে তারা জাতীয় আত্মপরিচয়ের নিশানা খুঁজে পেত। এ থেকেই স্পষ্ট হয় যে বাংলাদেশ এমন একটি সত্তা যার পরিচয়ের মর্মস্থলে বিরাজ করে তার নদ-নদী বিধৌত প্রকৃতি ও তাকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠা অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সমাজ চেতনা ও ঐতিহাসিক বিবর্তন। নদীর নামে জাতির আত্মপরিচয় পৃথিবীর আর কোন দেশে এমন দেখতে পাওয়া যাবে! এমন একটি দেশে তিস্তার পানি প্রবাহের বিষয়টি জনগণের কাছে যে বিশাল উদ্বেগের একটি বিষয় হবে, সেটি খুবই স্বাভাবিক।

মহাকালের যাত্রাপথে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার গতিপ্রবাহ অনেকবার দিক পরিবর্তন করেছে। কিন্তু এই নদীসমূহের বঙ্গোপসাগর অভিমুখী প্রবাহের স্বাভাবিক ধারা কখনো বাধাগ্রস্ত কিংবা রুদ্ধ হয়নি। প্রকৃতির আপন নিয়মে ও নিয়ন্ত্রণে নদীর পানি প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু মহাকালের সেই স্বাভাবিক গতিতে এখন হস্তক্ষেপ হতে শুরু হয়েছে। মানুষের হাত দিয়ে প্রকৃতির গতিপ্রবাহকে বদলে দেয়ার প্রয়াস শুরু হয়েছে। ‘মনুষ্য-ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর এ প্রয়াসগুলো প্রকৃতির নিয়মের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করার বদলে তার মৌলিক প্রক্রিয়াকে বদলে দেয়ার ‘খেলায়’ মেতে উঠেছে। অন্যদিকে প্রকৃতির মহাকালীয় প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক গতি ‘রাজনৈতিক ভূগোলের’ বাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। প্রকৃতির ইচ্ছার চেয়ে ‘রাষ্ট্রের স্বার্থ’ প্রধান হয়ে উঠছে। প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাষ্ট্রীয় সীমানা স্থির না হওয়ায় ‘রাষ্ট্রীয় স্বার্থের’ বিবেচনা প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। প্রকৃতির স্বাভাবিক ভারসাম্য বিনষ্ট করার এই ‘মরণ খেলা’ ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনছে। এরকম একটি পটভূমি ও প্রেক্ষাপটে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত সমস্যাটি যে এদেশে ব্যাপক আলোচনা ও ক্রমবর্ধমান উত্কণ্ঠার বিষয় হবে তা খুবই স্বাভাবিক। ভারতের সঙ্গে সাগর-সীমা নিয়ে বিরোধের নিষ্পত্তি হলেও তিস্তা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি হচ্ছে না। সাগরের অর্জন আনন্দ বয়ে আনলেও ভারত কর্তৃক তিস্তার পানি প্রত্যাহারের কারণে জমে ওঠা ক্ষোভ তাকে ছাপিয়ে আছে। দু’দেশের বন্ধুত্বের স্বার্থেই এই বিরোধের দ্রুত ও শান্তিপূর্ণ মীমাংসা হওয়া একান্ত অপরিহার্য। সেই মীমাংসার ফর্মুলার ক্ষেত্রে কোনো নীতিগত ভিত্তি অনুসরণ করা উচিত, তা নিয়ে কিছু কথা বলে নেয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশের জন্য তিস্তা কোনো বিচ্ছিন্ন একক ইস্যু নয়। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর মধ্যে অধিকাংশ হলো একাধিক রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদী। এ ধরনের অভিন্ন নদীর সংখ্যা হলো ৫৭টি, যার মধ্যে ৫৪টি ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই ৫৪টির মধ্যে কয়েকটি আবার ভারতে প্রবেশ করার আগে চীন, নেপাল, ভূটান প্রভৃতি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভারতে ও পরে বাংলাদেশে এসেছে। নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টি তাই এই অঞ্চলের প্রতিটি দেশের সামগ্রিক নদী ব্যবস্থাপনা নীতির যোগফলের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

কী হওয়া উচিত এসব দেশের নদী ব্যবস্থাপনা নীতির প্রধান চরিত্র? প্রথমত, প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের সঙ্গে মৌলিকভাবে অসঙ্গতিপূর্ণ বা বৈরি কোনো কিছু করা থেকে বিরত থাকা সেই নীতির প্রধান ভিত্তি হওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, নদ-নদীর ক্ষেত্রে প্রথমেই যে নীতি মেনে চলা অত্যাবশ্যক তা হলো ‘নদীকে বাঁচতে দাও’-এর নীতি। এসব অভিন্ন নদীগুলোকে যেভাবে উজানে গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে তা বন্ধ করতে হবে। ‘মনুষ্য ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের’ মাধ্যমে এই হনন কাজ চালানো হচ্ছে। তাই নদ-নদীর স্বাভাবিক যাত্রাপথ, স্রোত, বহনকৃত পলি ও জলজ-জীবের স্বাভাবিক চারণ ও প্রজনন ক্ষেত্র ইত্যাদি এভাবে ক্ষুণ্ন করার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। নদীকে ‘হত্যা’ করার বদলে তাকে নিজের মতো করে বাঁচতে দিতে হবে।

নদীগুলোকে এভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়াটি অপর একটি আত্মঘাতী নীতির অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। তা হলো নদ-নদীর প্রতি ‘বাণিজ্যিক’ মনোভাব অনুসরণ। লেবু বা আখ চিপে রস বের করার মতো, নদ-নদীকে নানাভাবে ‘হাত মোচড়’ দিয়ে নগদ বৈষয়িক লাভ নিংড়ে নেয়ার নীতি অনুসরণ করার ফলে নদী আর নদী থাকছে না। তা হয়ে উঠছে মুনাফা বানানোর আর দশটি উেসর মতো একটি লোভনীয় উপকরণ। এ ধরনের নীতি ও মনোভাবের উদ্ভব ঘটেছে অর্থনৈতিক-সামাজিক দর্শনের ক্ষেত্রে যৌথ স্বার্থের বিবেচনাকে প্রাধান্য দেয়ার বদলে ব্যক্তিগত স্বার্থচিন্তাকে প্রাধান্য দেয়ার দর্শন অনুসরণ করার ফলে। আলো-বাতাসের মতো নদ-নদী, সাগর, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি হলো মানুষের ‘যৌথ সম্পত্তি’। কিন্তু পুঁজিবাদ সবকিছুর পণ্যায়ন (commodification), বাণিজ্যিকীকরণ (commercialisation), অ-যৌথায়ন (de-collectivisation) তথা ব্যক্তিগতকরণ (privatisation) ঘটায়। পুঁজিবাদের এই সর্বগ্রাসী প্রবণতার হাত থেকে কোনো কিছুরই নিস্তার নেই। নদ-নদীরও নিস্তার নেই। যৌথ সম্পত্তি কিভাবে ব্যক্তিগত মালিকানার মাধ্যমে লুণ্ঠনের উেস পরিণত হয় তার একটি চরম দৃষ্টান্ত হলো ভূমি-দস্যু ও নদী-দস্যুদের নদ-নদী-খাল-বিল দখলের অসংখ্য ঘটনা।

নদী ব্যবস্থাপনা নীতির ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী বাণিজ্যিকীকরণের কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় অভিন্ন নদীর ক্ষেত্রে উজানের ও ভাটির দেশের মধ্যে পানির হিস্যা নিয়ে বিরোধ তীব্র হয়ে উঠেছে। ‘নদীকে তার নিজ ধারায় স্বাধীনভাবে প্রবাহিত হতে দাও’ এবং ‘নদ-নদী হলো মানব সমাজের যৌথ সম্পদ ও সম্পত্তি’— অন্তত এ দু’টি মৌলিক নীতি অনুসরণ করেই উজানের ও ভাটির দেশের মধ্যে পানির হিস্যা নিয়ে বিরোধের মীমাংসা করা উচিত। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে আগে যা করা দরকার, তা হলো—নদীর স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রেখে তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যে পরিমাণ পানি প্রবাহ প্রয়োজন, তার বরাদ্দ আগে-ভাগেই নির্ধারণ ও নিশ্চিত করা। তারপরে, অবশিষ্ট পানি প্রবাহের পরিমাণকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জন্য সমতা ও সমঝোতার নীতির ভিত্তিতে বরাদ্দ করা। সেইসঙ্গে প্রয়োজন উজান বা ভাটির দেশ কর্তৃক একে অপরের ক্ষতি সাধন হতে পারে, নদীতে এমন কোনো স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ করা। পাশাপাশি নদী ব্যবস্থাপনায় পরস্পরের মধ্যে এবং একই সঙ্গে আঞ্চলিক ভিত্তিতে সহযোগিতার পথ অনুসরণ করা। এভাবে প্রতিটি নদী-প্রণালীকে (river system) কেন্দ্র করে বহুপাক্ষিক সহযোগিতা এবং অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনার স্থায়ী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরকালে আলোচিত নীতিমালা অনুসরণ করে দু’দেশের মধ্যে বহুপ্রতীক্ষিত তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে, এটি দেশবাসীর আন্তরিক কামনা। দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের স্বার্থে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়া এখন একটি অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ভারতের প্রায় সব প্রত্যাশা পূরণ করেছে। এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় তাদের নেই। এখন ভারতের প্রতিদান দেয়ার পালা। তা সে দেয় কিনা এবং দিলে কতোটা দেয়, সেটি দেখার জন্য দেশবাসী অপেক্ষা করে থাকবে।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
প্রথম প্রকাশ: ইত্তেফাক, ১৯ মার্চ, ২০১৭

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত