নারী দিবস: বিশ্ব ও বাংলাদেশ

প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০১৭, ১৫:৩৬

সুমন আহমেদ

৮ই মার্চ। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের নারী সমাজকে আমরা আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। নারীর প্রতি সব রকম বৈষম্য ও অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটিয়ে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক বিশ্ব গড়ার কাজে পুরুষের সমান অবদান রাখার প্রত্যয় নিয়ে নারীর এগিয়ে চলা আরও বেগবান হোক।

বিশ্ব নারী দিবসটি পালনের পেছনে রয়েছে এক অনন্য ইতিহাস। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে একটি সূচ কারখানার মহিলা শ্রমিকগণ কর্মক্ষেত্রে মানবেতর জীবন ও ১২ ঘন্টা কর্মদিবসের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। তাদের উপর নেমে আসে পুলিশি নির্যাতন। ১৮৬০ সালে ঐ কারাখানার নারী শ্রমিকেরা 'নারী শ্রমিক ইউনিয়ন' গঠন করেন আর সাংগঠনিক ভাবে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯০৮ সালে ১৫০০০ নারী কর্ম ঘন্টা, ভাল বেতন ও ভোট দেওয়ার অধিকার দাবি নিয়ে নিউ ইয়র্ক সিটিতে মিছিল করে। তারপর ১৯১০ সালের ৮ মার্চ কোপেনহেগেন শহরে অনুষ্ঠিত এক আর্ন্তজাতিক নারী সম্মেলনে জার্মানির মহিলা নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে 'আর্ন্তজাতিক নারী দিবস' ঘোষণা করেছিলেন। ১৯১১ সালে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ৮ মার্চ 'আর্ন্তজাতিক নারী দিবস' পালন করা হয়। ১৯৮৫ সালে ৮ মার্চকেও জাতিসংঘ আর্ন্তজাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশে প্রথমবারের মত ১৯৯১ সালে এই দিবসটি পালন করা হয়। ২০১৭ সালে নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে 'পরবর্তনের জন্য সাহসী হও’।

নারী দিবসের ইতিহাসের দিকে বিস্তারিত ভাবে যদি তাকাই তাহলে দেখব:

সারা আমেরিকায় ২৮ শে ফেব্রুয়ারি নারী দিবস পালিত হয়। ১৯১৩ সাল পর্যন্ত ফেব্রুয়ারির শেষ রবিবার নারী দিবস হিসেবে পালন করে আমেরিকানরা। 
১৯১০ সালে একটি সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয় কোপেনহেগেনে। এই সম্মেলনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস করার প্রস্তাবটি প্রথম গৃহিত হয়। প্রস্তাবটি বিপুল জনসমর্থন পায়। ১৭টি দেশের ১০০ জন নারী সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, যাদের মধ্যে ফিনল্যান্ডের তিনজন নির্বাচিত নারী প্রতিনিধির কথা উল্লেখ্য। যদিও কোন নির্দিষ্ট তারিখ চিহ্নিত করা হয়নি এই সম্মেলনে।
১৯১১ সালে ১৯ শে মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালিত হয় ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া এবং জার্মানীতে। দেশগুলোতে সব মিলিয়ে দশ লক্ষ নারী পুরুষ মিছিল করে দাবী জানায়, নারী ও পুরুষের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের ভেদাভেদ দূর করার। 

তার কিছুদিন পরেই ইতিহাস প্রত্যক্ষ করে এক ভয়াবহ দৃশ্যপট। "ট্রাইএঙ্গেল ফায়ার" নামে খ্যাত এই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিউইয়র্কে মৃত্যু বরণ করে ১৪০ জন নারী শ্রমিক। এই অগ্নিকান্ডের ঘটনা নারী দিবস তথা আন্তর্জাতিক শ্রমিক আইনের মোড় নতুন দিকে ঘুরিয়ে দেয়। 

এই সময়ের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে নারীদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে। তখন প্রথম মহাবিশ্ব যুদ্ধের সূচনা। এই যুদ্ধের বিপক্ষে এবং সার্বজনীন শান্তি কামনায় রাশিয়ার নারীরা ১৯১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ রবিবার আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করেন। ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় ৮ই মার্চ এবং তার আগের ও পরের দিনগুলোতে নানা রকম র‍্যালির আয়োজন করে নারীরা। এর উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধের বিরোধিতা করা অথবা যুদ্ধে লিপ্ত দেশগুলোর নারীদের সাথে নিজেদের সমর্থন ও সমবেদনা প্রকাশ করা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া ২০ লক্ষ লোক হারায়। এমনি অবস্থায় নারীরা আবারও ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ রবিবার অবরোধ করার ঘোষণা দেন। যেটা "Strike for Bread and Peace"-নামে খ্যাত। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এই অবরোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। কিন্তু নারীরা অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যায়। তারপরে মাত্র চার দিন পর জার বাধ্য হোন নারীদের ভোটাধিকার দিতে। রাশিয়ান গভর্মেন্ট এই অধিকার গ্রাহ্য করে। 

এই ঐতিহাসিক অবরোধের দিনটি জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ছিল ২৩শে ফেব্রুয়ারি। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার রাশিয়ানরা মেনে চলত। কিন্তু সারা বিশ্বে গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দিবসটি ছিল ৮ই মার্চ। সেই থেকে এই দিবসটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। 

১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ সনদ স্বাক্ষরিত হয়। সেটাই ছিল প্রথম কোন আন্তর্জাতিক চুক্তি যেটা জেন্ডার ইনিকুয়ালিটির বিরুদ্ধে করা হয়। জাতিসংঘ সংস্থা সেই থেকে আজ অবধি নানা কাজ করে আসছে নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক নানা অধিকার রক্ষা করার জন্য।

বাংলাদেশে নারীদের অবস্থা

সব দেশের মত বাংলাদেশও প্রতি বছর নারী দিবস পালন করে।  কিন্তু উন্নত বিশ্ব ও বাংলাদেশের নারীর অবস্থার মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে। এ দেশে নারীসমাজ আজও সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভে ২০১১’ নামে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপের তথ্য হলো, দেশের ৮৭ শতাংশ বিবাহিত নারী আপন গৃহেই নির্যাতনের শিকার। ৬৫ শতাংশ স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতন, ৩৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ৮২ শতাংশ মানসিক এবং ৫৩ শতাংশ স্বামীর মাধ্যমে অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির আওতায় দেশের ৫৫টি জেলা থেকে নারী নির্যাতনের ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে ২০১৫ সালের জুনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৪ সালে ব্র্যাকের নিরীক্ষাধীন এলাকায় ২ হাজার ৮৭৩টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এক বছর পর ২০১৫ সালে এর সংখ্যা বেড়ে ৫ হাজার ৮টিতে পৌঁছে। ব্রাকের হিসাব মতে, এক বছরে নারী নির্যাতন বেড়েছে ৭৪ শতাংশ। এখানে উল্লেখ করা হয় দরিদ্র নারীরা সচ্ছল নারীদের থেকে বেশি সহিংসতার শিকার হয়েছেন অর্থাৎ ৫৪ শতাংশ। এ নারী নির্যাতনকারীদের ৮৮ শতাংশই পুরুষ। নির্যাতনের শিকার নারীর পরিবারের সদস্য বা প্রতিবেশী। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কুমিল্লা, বগুড়া, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও রাজশাহী এলাকায় নারী নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের-২০১৫ সালের বছরজুড়ে নারী নির্যাতনের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৪২, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৮২ জনকে, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫৯, এসিড সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৩৫, অপহরণ হয়েছেন ৯২, নারী ও শিশু পাচারের শিকার হয়েছেন ৪৭, যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ১৯২ জনকে, যৌতুকের কারণে নির্যাতিত হয়েছেন ১৭৩, গৃহপরিচারিকা হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৩০টি, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৭৪, গৃহপরিচারিকা নির্যাতন হয়েছে ৩৬টি, হত্যা চেষ্টার ঘটনা ৪৬টি, নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে ৬৫৭ জনকে, রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছে ১৪৫ জনের, আত্মহত্যা করেছেন ২৯৮, উত্ত্যক্তের শিকার ৩১৯, ফতোয়ার শিকার ২৮, বাল্যবিয়ের শিকার ৮৫, পুলিশি নির্যাতনের শিকার ৩৬ এবং শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন ৯৩।

অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ পরিচালিত ‘নিরাপদ নগরী নির্ভয়ে নারী’ শীর্ষক নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা ও হয়রানি বিষয়ে এক গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। রিপোর্ট তৈরিতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও নারায়ণগঞ্জ শহরের ১ হাজার ২০০ নারী-পুরুষের ওপর এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে ৮০০ নারী ও কিশোরী, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে এবং ৪০০ পুরুষ। গবেষণায় অংশ নেয়া নারীর ৮৮ শতাংশই বলেন, তারা পথচারী, পুরুষ যাত্রী এবং ক্রেতাদের দ্বারা হয়রানির শিকার হন। শহরের ৯৭ শতাংশ নারী যৌন হয়রানিকে সহিংসতা মনে করেন। তারা মনে করেন, পুলিশের সাহায্য চাইলে সমস্যা বাড়ে। যৌন সহিংসতা এড়াতে ৬৪ ভাগ নারী রাতে ঘরের বাইরে যান না। নিরাপত্তাহীনতার কারণে ৬০ ভাগ নারী রাতে ঘরের বাইরে বের হওয়ার ক্ষেত্রে দলগতভাবে যেতে চান। নগরের ৪৭.৫ ভাগ নারী গণপরিবহন, রাস্তা কিংবা উন্মুক্ত জনবহুল এলাকায় চলাফেরা করার ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। গবেষণায় অংশ নেয়া ৮১ শতাংশ মানুষ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে সহায়তার জন্য যেতে চান না। গবেষণায় উত্তরদাতারা বলেছেন, মানুষ চলাচলের জয়াগায় ৮৫ শতাংশ নারী মর্যাদাহানিকর উক্তির শিকার হয়েছেন, ৪৬ শতাংশ নারী যৌনতাপূর্ণ অশ্লীল কথা শুনেছেন। রাস্তায় নারীরা যৌন হয়রানির শিকার বেশি হন। ৮৫ শতাংশ নারী ও ৭৭ শতাংশ পুরুষ বলেছেন, নারী হয়রানির শিকার বেশি হন রাস্তায় বা ফুটপাতে।

সামাজিক কুসংস্কার, যৌতুক প্রথা, এসিড নিক্ষেপের মত নির্মম সব ঘটনার শিকার হতে হয় নারীদের। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ এখনও আমাদের দেশে আছে। এগুলোর উচ্ছেদ ও নারীদের সঠিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা কতটা জরুরী আমরা উপলব্ধি করছি না। কোন দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাকে পঙ্গু করে দিয়ে সামনে আগানো যায় না। 

বেগম রোকেয়া আমাদের নারী জাগরণের পথিকৃত। নবাব ফয়জুন্নেসার অবদানও অনস্বীকার্য। তবু তাদের আদর্শের কিছুই আমরা ধারণ করতে পারিনি। সেই আদর্শে উজ্জীবিত হবার দিন আবার এসেছে। আমাদের সংকল্প হোক সকল নারীর অধিকার সুনিশ্চিত করা। তাদের সুশিক্ষিত করা। একটা শিক্ষিত মা-ই পারেন একটা শিক্ষিত জাতি দিতে। 

লেখক: শিক্ষার্থী, উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত