খুঁজে ফিরি আলোক কণা-২

প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২১:২৮

মলি জেনান

“রুক্ষ দিনের দুঃখ পাই তো পাবো,
চাই না শান্তি, সান্ত্বনা নাহি চাবো। 
পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্ন পালের কাছি
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব -তুমি আছ, আমি আছি।” 

হ্যাঁ, রবিঠাকুরের কবিতার এই লাইনগুলোই আমার বারবার মনে পড়ছিল আর প্রার্থনার মত বারবার বলছিলাম, শেষে সুমনকে ইনবক্স করলাম; আমি প্রি-অপারেটিভ রুমের ভেতরে, ও বাইরে বারান্দায়। মনে হচ্ছিল এই শেষ রাত, আমাদের আর কোন যুগল রাত আর আসবে না, সেই ছন্দময় ব্যথা নিয়েই ঘুমে-জাগরণে রাত পার হয়ে গেল।

২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩ খ্রিঃ ভোর থেকেই ব্লিডিং হচ্ছে কিন্তু সেই তুলনায় ব্যথাটা তীব্র নয়। ডাক্তার আসলেন সাড়ে নয়টার দিকে। সব শুনে ভেতরের রুমে নিয়ে গেলেন তিনি। দীর্ঘ সময় নিয়ে বাচ্চার নাড়াচাড়া ও হার্টবিট পরীক্ষা করলেন, উনাকে ঠিক সন্তুষ্ট মনে হলো না। সুমনকে ডেকে বললেন যে নরমাল ডেলিভারির কথাই চিন্তা করেছিলাম, সব ঠিক ছিল কিন্তু একটু সমস্যা মনে হচ্ছে। ঘন্টাখানেক পর আবার বাচ্চার বিটটা পরীক্ষা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে; আপনারা সিজারের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারেন, প্রয়োজন হলে সিজার করতে হতে পারে। সুমন বলল আপনার ঠিক যা ভালো মনে হয় তাই করুন। ভয় আর শঙ্কায় আমি অস্থির হয়ে উঠছি, প্রার্থনা করছি আমার যা হয় হোক যেন আমার বাচ্চা ভালো থাকে। আবার সাড়ে এগারোটার দিকে বাচ্চার নাড়াচাড়া ও হার্টবিট পরীক্ষা করতে নেয়া হলো। দীর্ঘ সময় নিয়ে পরীক্ষা করা শেষ হলে ডাক্তার নার্সকে বললেন উনার সিজারের প্রস্তুতি নেন, লাঞ্চের পর ওটি’তে যাবে। আমি হতবিহ্বল!! 

-ম্যাম কোন সমস্যা?
-তেমন কিছু না হার্টবিটে একটু ঝামেলা মনে হচ্ছে তাই আমরা কোন রিস্ক নিতে চাইছি না।

ভয়ে-শঙ্কায় আমার সুমনকে “দেখার তৃষ্ণা” পায়; আমার গলা, বুক শুকিয়ে আসে, আমি অস্থির হয়ে উঠি। মা ওকে ডেকে আনলো আমি তৃষ্ণার্তের মত ওর হাত ধরে ভাঙ্গা গলায় বললাম
-সিজার করতে হবে। 
আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে সে বলল-
-ডাক্তার যা ভালো মনে হয় করবে এতে দু:শ্চিন্তা করার কিছু নাই’। এই যে আমিতো এখানেই আছি।
-ওর শিশুর সারল্য মাখা হাসি মুখ দেখে আমার দু:শ্চিন্তা কমে, ভয় নয়।

সে আমাকে রেখে ডাক্তারের সাথে কথা বলে, আমাকে রুমের ভেতরে রেখে বাইরে যায়। আম্মা আমার সাথে বসে থাকেন, কিছুক্ষণ পরে মা (শাশুড়ি) আসেন। 

ছন্দময় ব্যাথাটা তার স্ট্রাটেজি পরিবর্তন করছে ধীরে ধীরে, ব্যাথাটা বাড়ছে, তীব্র হচ্ছে, আবার থেমে যাচ্ছে। এভাবে আরো সময় পার হয়ে গেল। দুইটার দিকে নার্সেরা আমাকে তৈরী করবার নির্দেশ পেলেন। ওটিতে একটা অপারেশন চলছে এরপর আমার পালা।

সাড়ে তিনটার দিকে আমাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হলো। ওটিতে নেওয়ার সময় আমি স্ট্রেচারে শুয়ে কাকে, কাকে দেখেছিলাম মনে নেই শুধু মনে আছে আম্মা ও শাশুড়ির স্নেহার্দ্র ও উৎকন্ঠিত মুখ আর সুমনের ব্যাকুল দৃষ্টি ঠিক যেমনটি দেখেছিলাম ছয় বছর আগে আমাকে ওর থেকে আলাদা করার জন্য যখন রাঙামাটি নিয়ে যাওয়া হয় তখন; শুধু ওর এই ব্যাকুলতার জন্য আমি আরো হাজারবার জন্ম নিয়ে হাজার যন্ত্রণা সইতে পারি।

সেখানে আমাকে একটা বেডে রাখা হলো, বলা হলো অ্যানেস্থেসিয়া যে ডাক্তার দেবেন তিনি এখনো এসে পৌঁছাননি, তিনি আসলেই অপারেশন শুরু হবে। মনে হচ্ছে আমার সমস্ত আপনজনদের কাছ থেকে আলাদা করে আমাকে ভিন্ন একটা পৃথিবীতে এনে ফেলা হয়েছে, এখানে আমার পরিচিত কেউ নেই। ব্যাথাটা ভয়ানক তীব্র হয়ে ফিরে ফিরে আসছে! যিনি আমার অপারেশান করবেন তিনি পাশেই ইন্টার্নির স্টুডেন্টদের ক্লাস নিচ্ছেন। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না, জান্তব ব্যাথাটা আমার সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙ্গে দিচ্ছে, নির্দিষ্ট সময় পরপর তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ফিরে আসছে; একসময় লক্ষ্য করলাম আমি চিৎকার করছি প্রাণপন চিৎকার করছি, ব্যাথাটাকে আটকে রাখবার চেষ্টা করছি। আমার বাচ্চার পৃথিবীতে প্রবেশ পথে একটা ক্যাথেডার লাগানো, এতো ভয়নক যন্ত্রণার মধ্যেও ভাবছি আমার বাচ্চার কোন ক্ষতি হবেনা তো? যন্ত্রণায় একসময় আমার মাথা শূণ্য বোধ হতে লাগল, মনে হচ্ছে আমি কোথাও তলিয়ে যাচ্ছি যেখানে অন্ধকার; প্রাণপন চেষ্টা করেও নিজেকে অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া রুখতে পারলাম না। সমস্ত আলো নিভে যাবার আগে মাথায় একজনের স্পর্শ পেলাম, মুখটা দেখবার চেষ্টা করতে করতেই তলিয়ে গেলাম। সেদিন আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম না জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম জানি না।
 
আজ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একটা কথা বারবার মনে হচ্ছে- নিজে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছি বলেই আমি বুঝতে পারি প্রকৃতিতে মানব প্রাণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মত এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে একজন নারীকে কতটা মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, কতখানি শ্রম দিতে হয়। এতটা শ্রম দিতে গিয়ে একজন নারীকে শারীরিকভাবে তো অবশ্যই মানসিক ভাবে কতটা শক্তি অর্জন করতে হয় তা যদি তাবৎ পুরুষকূল অনুধাবন করতে পারতো তাহলে নারীর প্রতি বৈষম্য ও নারীমুক্তির জন্য কোন আন্দোলনের প্রয়োজন হতো না। পিরিয়ড, মাতৃত্বকালীন সময় ও প্রসবকালীন সময় এই তিনটি ধাপে পুরুষের শারীরিকভাবে সক্রিয় কোন অংশগ্রহণ নেই, না এটা শারীরিক কোন অক্ষমতা নয় এটা প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা। এই সীমাবদ্ধতা যত দিন মানসিক ভাবে অতিক্রম করে পুরুষ নারীর কাছাকাছি আসতে না পারবে ততদিন তাদের অক্ষমতা ঘোচবে না, আর এই অক্ষমতার দায় মেটাতে দেশে-দেশে, যুগে-যুগে নারী সম্পর্কে রটানো হবে অশুচি, অস্পৃশ্যা, অপবিত্র, পাপী, কখনো ডাইনি বা শয়তানি।

যাক, ঠিক যেভাবে চিৎকার করতে করতে ঘুমিয়ে/জ্ঞান হারিয়েছিলাম ঠিক সেভাবে চিৎকার করতে করতে আমি পৃথিবীতে ফিরলাম! ভয়ানক চিৎকার করছি, এর মধ্যে কতটা সময় পার হয়েছে আমি জানি না। আমার চিৎকারে ক্লাস ফেলে দুই-তিন ইন্টার্নির স্টুডেন্ট ছুটে আসলেন। তাদের কথায় বুঝতে পারলাম শাহবাগে রাস্তা বন্ধ তাই অ্যানেস্থেসিয়া দেয়ার লোক এখনো এসে পৌঁছাননি। একজন ডাক্তারকে ডেকে বললেন “ম্যাম-এটা মোটেও ঠিক নয়, উনার যদি সিজার-ই হবে তাহলে লেবার পেইনের এই কষ্টটা তাকে কেন পেতে দিচ্ছি? আর বাচ্চারও তো ক্ষতি হতে পারে?” অন্য একজন এসে বললেন “আমি আমার দায়িত্বে অ্যানেস্থেসিয়া পুশ করব আপনি অনুমতি দেন প্লিজ”। সেই লোকটা কে ছিল আমি জানি না।

অবশেষে আমাকে অপারেশন টেবিলে নেওয়া হলো- যন্ত্রণায় আমি কুঁকড়ে উঠছি, ইনজেকশন পুশ করতে পারছে না সেই লোক। আমি বললাম ব্যাথাটা একটু থামতে দেন প্লিজ! অপারেশন শুরু হলো। আমি মনে মনে বাবা আর সুমনের সাথে কথা বলছি। দীর্ঘ চাপ চাপ যন্ত্রণার পর আমার বাচ্চা এলো এ পৃথিবীতে, এসেই ডাক্তারের কাচিঁ, ফরসেফ খামচে ধরল; ডাক্তার বললেন দেখুন আপনার মেয়ে সার্জন হবে। ওর কান্না শুনতে পেলাম কয়েক মিনিট পর।

অবশেষে আমর সমস্ত স্বপ্ন ধারণ করে পৃথিবীতে এলো আমাদের ‘আগুন ঝরা ফাগুন’ আর ছোম্মার (ছোটমা) প্রাপ্তি।

আমার/আমাদের আলোক কণা…..।

(চলবে)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত