নারী অধিকার: আমাদের সমাজচিত্র

প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০১৬, ২২:৩৫

বৈশাখী রয়


মিসেস মোমেনা বেগম কিছুক্ষণ আগে বেশ প্রফুল্ল মনে বাসায় ফিরেছেন। এক ব্যস্ততম দিন কাটালো আজ তার। বাসা থেকে খুব ভোরে বেরিয়ে গেছেন কারণ সকালে বিশ্ব নারী দিবসের র‍্যালী ছিলো। তারপর তিনি একটি সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেছেন। আর দুটি সেমিনার প্রিসাইড করেছেন। প্রতিটি সেমিনারে তার বক্তৃতা পর গণ্যমান্যরা এসে তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কন্যা শিশু ও বালিকাদের নিয়ে তার সাথে অনেকেই কাজ করার আগ্রহও প্রকাশ করেছে।

সারাদিনের ক্লান্তি দূর করার জন্য বাসায় ৮ বছরের রহিমা নামের যে মেয়েটি কাজ করে তাকে গরম এক কাপ কফি দিতে বলে ফ্রেস হতে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। কিছুক্ষণ পর রান্না ঘর থেকে কিছু ভাঙ্গার আওয়াজ শুনে ছুটে গেলেন মোমেনা বেগম। দেখলেন ২ দিন আগে যে নতুন টি সেট কিনে এনেছিলেন তার একটা কাপ ভাঙ্গা অবস্থা মাটিতে গড়াছে তার পাশেই রহিমা দাঁড়িয়ে। তার হাত থেকে রক্ত ঝড়ছে। সদ্য কেনা দামী কাপের এই দশা দেখে মোমেনা বেগম নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না হাতের কাছেই পাওয়া খুন্তি দিয়েই আঘাত করতে লাগলেন রহিমাকে। কিন্তু রাগ কিছুতেই কমছে না। খুন্তিটা আগুনে গরম করে রহিমাকে পেটাতে লাগলেন। ছোট্ট রহিমা এই অত্যাচার সহ্য করতে নাপেরে এক সময় অজ্ঞান হয়ে পড়লো। হাতের খুন্তিটা ছুঁড়ে ফেলে মোমেনা বেগম ফিরে গেলেন নিজ ঘরে।

ঘন্টা ২ পরে মোমেনা বেগমের মেয়ে এসে জানালো রহিমার অবস্থা বেশ খারাপ, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। মহা বিরক্তি নিয়েই মোমেনা বেগম ডাঃ বিলকিস কে ফোন করলেন আর বললেন- “আপা আর বলবেন না সারাদিন পর বাসায় এসে দেখি আমার গ্রামের গরিব যে মেয়েটিকে আমি নিজের কাছে এনে লেখাপড়া শেখাচ্ছি সে খেলতে গিয়ে হাত কেটে ফেলেছে।

এন্টিসেপটিক দিয়ে ব্যান্ডিজ করিয়ে দিয়েছিলাম কিন্ত ব্যাথায় জ্বর এসে গেছে, এত রাতে তো হাসপাতালে নিতে পারছি না তাই আপনাকেই বিরক্ত করছি”। ডাঃ বিলকিস ঔষুধের নাম বলে ফোন রেখে দিয়ে তার স্বামীকে বললেন, “মিসেস মোমেনা বেগমের মত এত দরদী নেত্রী হয় না। মেয়েদের নিয়ে তার এত চিন্তা এত কর্মপরিকল্পনা। সবাই যদি মোমেনা বেগমের মত করে ভাবতেন তবে সমাজে কোন মেয়ে আর কষ্ট পেতোনা”।


মিসেস লীনা। একজন স্কুল শিক্ষিকা। শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন সমাজ সেবায় ব্যস্ত থাকেন। বাসার সব কাজ নিজেই করেন। স্বামী সজীব আহমেদ উচ্চ শিক্ষিত সরকারি উচ্চ পদে কর্মরত। তাদের দুই মেয়ে, দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।

প্রতিদিনের মত আজও লীনা স্কুল শেষেবাসায় ফিরে সব কাজ শেষ করলেন এমন কি স্কুলে নারী দিবসের অনুষ্ঠানের বক্তৃতা লিখেও শেষ করলেন। বেশ রাত হয়ে গেছে সজীব এখনও ফিরে আসেনি। সজীবের দেরী করে ফেরা নতুন কিছু নয় তবুও বেশ বিরক্ত লীনা। মধ্য রাতে ফিরে আসলেন সজীব। ঘরে ঢোকার পরেই লীনা দেরী হবার কারণ জানতে চাইলো। সাথে সাথে সজীবের ভেতরকার পুরুষ-সিংহ গর্জন করে উঠলো। লীনাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে মারতে লাগলেন, এক সময় চুলের মুঠিধরে মাথাটা দেয়ালে ঠুকে দিলেন। লীনার কপাল ফেটে না গেলেও ফুলে উঠলো। সজীবের এই পশুর মত ব্যবহার লীনার কাছে নতুন কিছু ছিলো না।

পরদিন ভোরে লীনা দেখলেন তার কপাল ফুলেকালো হয়ে আছে। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ একটু বেশী করে সেজেই স্কুলে গেলেন এবং বেশ হাসিখুশী ভাবেই সবার সাথে কথা বলতে লাগলেন। সবাই তার কাছে কপাল ফুলে যাবার কারণ জানতে চাইলো। লীনা উত্তর দিলেন, “আর বলবেন না গতকাল আপনাদের দুলাভাই অনেকগুলো গাছের টব আমাকে উপহার দিয়েছে। টবগুলো দেয়ালের পাশে সাজাতে গিয়ে কিভাবে যেনো কপালটা দেয়ালে ঠুকে গেলো। আপনাদের দুলাভাইতো আমাকে জোর করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলো আমিই অনেক বুঝিয়ে তাকে শান্ত করলাম। মানুষটা আমায় বড় বেশী ভালবাসে”।

কিছুক্ষণ পরেই স্কুল অনুষ্ঠানে নারীদের অধিকার নিয়ে লীনার জোড়ালো বক্তব্য সকলের প্রশংসা কুড়ালো।

দুইটি ঘটনার প্রতিটি চরিত্রই কাল্পনিক কিন্তু আমাদের চারপাশে এমন নারীর সংখ্যা কিছুমাত্র কম নয়, যারা প্রতিনিয়ত সমাজসেবীকার মুখোশ পড়ে নারী নির্যাতন করে আসছে বা মুখবুজে অত্যাচার সহ্য করছে। বিশ্ব নারী দিবসে মোমেনা বেগমের মত নারী নির্যাতনকারী ও লীনার মত নির্যাতন সহ্যকারীদের ধিক্কার জানাই। যতদিন পর্যন্ত আমরা আমাদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন না হবো, দূর্বলের প্রতি আমাদের হাত না বাড়াবো ততদিন পর্যন্ত সমাজের ভোগের ও হাতের পুতুল হয়েই থাকতে হবে।

লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট

প্রথম প্রকাশ: জাগরণীয়া ২০১৪

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত