রাষ্ট্রের দায় যৌনকর্মীরা কেন নেবেন?

প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০১৬, ০০:৪৪

সাফিয়া আরিফিন

গত কয়েক দশক ধরে দেখছি, দেদারসে চলছে যৌনপল্লী উচ্ছেদ। ‘যৌনতা তো এমনিতেই অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘটনা, তাই উচ্ছেদে কি আসে যায়’। এই ধারণা থেকেই মনে হয় সমাজের বিভিন্ন স্তরে এই উচ্ছেদ এবং নিগ্রহ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য নেই। সরকার তো চোখ বুজেই রয়েছে, বুদ্ধিজীবীরা তেমন করে কিছু বলছেনও না, মিডিয়ার চোখ নেই, বিভিন্ন ফোরামের কর্তাব্যক্তিরাও কোনমতে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। যেন কিছুই হয়নি, কিংবা হলেও অত গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। তোবা গার্মেন্টসের কর্মীরা অনশন করেছেন, তাদের পাশে ছিল বামসংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন। এরকম বিভিন্ন ধরণের অনিয়ম-অবিচারের সময় একমতের মানুষরা, মানবিক মানুষরা পাশে এসে দাঁড়ান। নানান সংকটপূর্ণ অবস্থায় বুদ্ধিজীবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কলামিস্ট, লেখকরা নানান কথা লেখেন, দিকনির্দেশনা দেন। যৌনকর্মীদের জন্য তারা কি সময় করে উঠতে পারছেন না, নাকি যৌনতা এবং যৌনকর্মীদের অসহায় জীবনযাপন সর্ম্পকে তারা অপরিচিত কিংবা এ বিষয়ে কথা বলতে লজ্জাবোধ করছেন তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।

সামাজিকভাবে এমনকি বুদ্ধিজীবী-মানবতাবাদী ব্রাত্য সমাজে অচ্ছ্যুৎ এই যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যগত এবং সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেকদিন তাদের সংস্পর্শে কেটেছে। সে কারণেই হোক কিংবা মানুষ হিসেবে তাদের মূল্য ‘কমিয়ে দিতে পারিনা’ বলেই এ বিষয়ে না লিখে পারলাম না। আমি অত গুরুত্বপূর্ণ কেউ না, তবু যৌনকর্মীদের সম্বন্ধে মানুষের তাচ্ছিল্যভাব কমবে এই প্রত্যাশায় কিছু পুরনো কথাকেই আবার নতুন করে আপনাদের জানাতে চাই।

যৌনকর্মীরা কেন এ পেশায় আসেন? শখ করে কি? স্বেচ্ছায় কেউ এই পেশায় আসেন না। নারী নির্যাতন, সামাজিক নিগ্রহ, দারিদ্রতা এসব কারণে প্রতি বছরই অসংখ্য নারী যৌনপেশায় নিয়োজিত হন। ভোগ বিলাস নয়, পেটের দায়ে, সমাজের কটুদৃষ্টি আর অমানবিক অন্যায় তাদের বাধ্য করে এ পেশায় নিয়োজিত হতে। ছোট একটা উদাহরণ দিলে টের পাবেন। খুলনায় যখন একে একে বন্ধ হচ্ছে পাটকলগুলো। তখন পথে বসা পরিবারের মেয়েরা খুলনার বিভিন্ন থানায় লাইন ধরে দাড়িয়ে যৌনপেশার রাষ্ট্রীয় লাইসেন্স নিয়েছে।

অনেকে মনে করেন, যৌন পেশা অবৈধ। এটি একটি ভুল ধারণা। সংবিধানের দ্বিতীয়ভাগে ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতি’-র ১৮ নং অনুচ্ছেদের ২ নং উপ-অনুচ্ছেদে বলা আছে ‘গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন’। যদিও রাষ্ট্র কি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে তা স্পষ্ট নয়, এমনকি এই প্রক্রিয়ায় যৌনকর্মীদের নিজ জমি থেকে উচ্ছেদ করাও পড়ে কি না তা জানাটা জরুরী। রাষ্ট্র আসলে যৌনকর্মীদের নিয়ে কি করতে চায় কিংবা কিভাবে এদের দেখতে চায় এটিও পরিষ্কার নয়। পেশা হিসেবে যৌনকর্মকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি কিন্ত আইন-ই বলছে, বাংলাদেশের যে কোন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী (আঠার বছর বয়েসর বেশী ) স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে এ পেশায় আসতে ইচ্ছুক এ কথা আদালতে বলে প্রাপ্ত বয়স্ক যে কোন নারী হলফনামার মাধ্যমে এ কাজ বেছে নিতে পারেন।’ বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে কোথাও যৌন পেশাকে সরাসরি নিষিদ্ধও করা হয়নি। এ প্রসঙ্গে মহামান্য হাইকোর্টের (রিট পিটিশন নং ২৮৭১/১৯৯৯) এক রায়েও বলা হয়েছে, ‘যৌনকর্মীরা স্বেচ্ছায় যৌনমিলনে সম্মতি প্রদান করে এবং সমাজ স্বীকৃত পেশা না হলেও আইনে কোথাও যৌনপেশাকে নিষিদ্ধ করা হয়নি।’

আমাদের সমাজ, যৌনতাকে পেশা হিসেবে মর্যাদা দিতে নারাজ। কিন্তু এর দায় গিয়ে বর্তায় অসহায় সেসব নারীদের উপর যারা অনিচ্ছায় এখানে যুক্ত হয়েছে। আর বুক ফুলিয়ে হাঁটতে পারে সেসব বীরপুঙ্গবরা যারা যৌনতাকে কিনে নিতে সেসব ‘অন্ধকার’ জায়গায় যান। সামাজিক অবমাননার এই চোখ যৌনকর্মীরাও ধারণ করেন। তারাও কেউ চান না তাদের সন্তান এই পেশায় আসুক। এজন্য তারা সন্তানদের এই পরিবেশের বাইরে ঠেলে দেন। বেশিরভাগ যৌনকর্মী তাদের সন্তানকে বাইরে রেখে পড়াশোনা করান, চেষ্টা করেন নিজেদের পরিচয় আড়ালে রাখতে। কেননা, বিচার বিবেচনা ছাড়াই এ সমাজ যৌনকর্মীর সন্তান ও পরিবারের সদস্যদেরকেও দোষী হিসেবেই বিবেচনা করে, এবং তাদের জন্যও বরাদ্দ থাকে অমানবিক আচরণ।

এবার আসি যৌনপল্লীগুলোর অবস্থা নিয়ে। এই পল্লীগুলোতে সেই সব নারীদেরই বাস যারা সত্যিকার অর্থে অসহায়। সমাজ এদের গ্রহণ করবে না, পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় যাওয়ার সুযোগও তাদের নেই। তদুপরি এই পেশায় আছে বঞ্চনা, নির্য়াতন ও অপরিসীম কষ্টের ধারাবাহিক ইতিহাস। এসব অসহায় নারীদের সাহায্য করার কেউ নেই, সবাই উল্টো ব্যস্ত কিভাবে তাদের আরো হেনস্তা করা যায়। একজন যৌনকর্মীর কাছে জানতে পারি একবার তারা তিনজন ঢাকার বেড়ীবাধে যৌনকাজ করতে গিয়েছিলেন। অথচ কাজ শেষে পারিশ্রমিক চাইতে গেলে তাদের তিনজনকেই বেদম প্রহার করা হয়। একজনকে তো ইট দিয়ে মেরে সব দাঁত ভেঙ্গেও দেয় পিশাচরা। এভাবেই প্রতিদিন তাদের নতুন নতুন নিযার্তন আলিঙ্গন করতে হয়। তবুও তাদের জীবন চলে, তবুও বেঁচে থাকতে হয়।

পল্লীর ভেতরেও অবর্ণনীয় দুর্দশায় কাটে যৌনকর্মীদের। খুন, হত্যা, ধর্ষণ সেখানকারও নিত্যদিনের ঘটনা। এসব পল্লী থেকে নিয়মিত চাঁদাবাজি করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এমনকি পুলিশরাও। তারপরও নিজেদের খাবারের চিরস্থায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি যৌনকর্মীরা। কেননা, আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে উচ্ছেদ এবং দখলের প্রবণতা।

সর্বশেষ গত ১২ জুলাই টাঙ্গাইল যৌনপল্লী উচ্ছেদ হয়। আগে থেকেই সেখানে নানান ধরণের হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। উচ্ছেদ হওয়ার আগে মুসল্লী পরিষদের লোকজন যৌনকর্মীদের চলে যেতে বলে। নতুবা হামলা করার এবং হত্যা করার হুমকি দেয়। দলিল দস্তাবেজ থাকার পরও জীবনের ভয়ে সেদিনই প্রায় ১৫০০ যৌনকর্মী নিজেদের জমিজিরাত ছেড়ে পালিয়ে যায়। এখানে বলে রাখা ভালো, ধর্মীয় ব্যানারে এই ধরণের হুমকি এবং উচ্ছেদের তৎপরতা চালানো হলেও আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে যৌনপল্লীর জমি দখল। প্রভাবশালীরা ধর্মের অজুহাতে সেখানকার জমি বিনাখরচে নিজেদের করে নেয়। টানবাজার, কান্দুপট্টি, মাদারিপুর যৌনপল্লীসহ উচ্ছেদ হওয়া অন্য পল্লীগুলোর সাম্প্রতিক অবস্থান সম্পর্কে খোজ নিলে আপনিও জানতে পারবেন জমিগুলো এখন কাদের এবং তারা সমাজে কতটুকু ক্ষমতা ধারণ করে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এসেছে এবারকার উচ্ছেদেও আখের ভরেছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের। তাহলে উচ্ছেদের আসল উদ্দেশ্য নিয়েতো বিভ্রান্তি থাকার কথা নয়।

অবশ্য উচ্ছেদ পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়েই আমার আতঙ্ক তুলনামূলক বেশি। যারা যৌণকর্মীদের উচ্ছেদের সংবাদে আনন্দিত, তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন এরা কোথায় যাবে? কিভাবে এদের জীবন চালাবে। অনেকেই বলেন, এরা কেন গার্মেন্টসে যায় না। আমরা দেখেছি, সমাজে হেয় হওয়ার ভয়ে অন্য পেশার মালিকরাও তাদের প্রতিষ্ঠানে যৌনকর্মীদের কাজ দেয় না। তাহলে কি এরা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা না খেয়ে মারা যাবে? বন্ধ হয়ে যাবে পরবর্তী প্রজš§কে নিয়ে যৌনকর্মী যে নতুন স্বপ্ন বুনেছিলেন তা? বন্ধ হয়ে যাবে যৌনকর্মীর সন্তানের স্কুলগমন? সেটা আসলে ঘটে না। যা ঘটে তা হলো, একটা পল্লী ভেঙ্গে এটিএম বুথের মতো অসংখ্য ছোট ছোট পল্লী গড়ে ওঠে। পল্লী উচ্ছেদ হলে কি হবে, চাহিদা কি কমেছে? আগে একটা পল্লীতে হয়তো কয়েকশো যৌনকর্মী বাস করতো। কিন্তু উচ্ছেদ পরবর্তী সময়ে ছোট ছোট করে গড়ে ওঠে আরো অসংখ্য যৌনপল্লী। শুধু টানবাজার ও কান্দুপট্টি উচ্ছেদের পর ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জের প্রত্যেকটি এলাকায় কতগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যৌনপল্লী হয়েছে তার খোঁজ নিলেই এ ভয়াবহ চিত্র উন্মোচিত হয়ে উঠবে।

এভাবেই বাসাবাড়ি, হোটেল এমনকি বিভিন্ন পার্কে যৌনকর্মীদের সংখ্যা বেড়ে চলছে। যার আরেকটি ক্ষতিকারক দিক হচ্ছে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক। আগে যৌনপল্লীতেই যৌনকর্মীদের যৌনরোগ ও বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা দেয়া ছিল সহজ। কিন্তু এখনকার ছোট ছোট মিনি ব্রথেলে এই সুবিধা দেওয়া অত্যন্ত কঠিন। তাই সরকারি-বেসরকারি সব ধরণের স্বাস্থ্যখাতেও চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে তারা। যার ফল হবে মারাত্মক। যৌনকর্মীদের একটি অংশ এইডস এবং এ সংক্রান্ত নানান ধরণের ভয়াবহ রোগ সম্বন্ধে সচেতন নন, যা তার নিজের জন্য এবং অন্যদের জন্যও ভয়ের কারণ। এখনকার উচ্ছেদ প্রক্রিয়ায় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হওয়া এসব যৌনকর্মীরা কি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অবহেলা-অমানবিকতায় এই ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে তুলছেন না।

অর্থনৈতিক ইদুর দৌড়ের এ বিশ্বে দুদণ্ড চিন্তা করার অবসর পাওয়া বেশ দুষ্কর। তারওপর দেশের বহুবিধ সমস্যা নিয়ে মানুষ পাগলপ্রায়। রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতা, খুন, হত্যা, লঞ্চডুবি, গার্মেন্টসসহ আরো অনেক অনেক বিষয়। সেখানে যৌনকর্মীদের উচ্ছেদের ঘটনা হয়ে দাঁড়ায় অতি ‘সামান্য’। কিন্তু সমাজ সংশ্লিষ্ট কোন সমস্যাই সামান্য হতে পারেনা। সমাজ গবেষকদের অনাদরে থাকায় ইতোমধ্যেই অনেক সময় পার হয়ে গেছে। স্বেচ্ছায় না এসেও যৌনকর্মীদেরও পোহাতে হয়েছে নিগ্রহের আগুন। কিন্তু এর প্রতিকার দরকার। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন যৌনকর্মীদের নিরাপদে বসবাস করার ও খেয়ে পরে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তেমনি রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব থাকে যৌনকর্মীসহ প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দায়িত্ব থাকে তাদের এবং অন্যান্যদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিতের।

কারও ক্ষতি না করে একজন মানুষ কি পেশা বেছে নেবে এটা তার ব্যক্তিগত ভাবনা হওয়া উচিত, যেখানে রাষ্ট্র যৌনপেশাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। পাশাপাশি যৌনকর্মীদের নিরাপত্তা প্রদান, পল্লীগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অপরাধ কার্যক্রম দমন এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারি উদ্যোগে পল্লীগুলো মনিটরিং করার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। দখল হয়ে যাওয়া পল্লীতে থাকা যৌনকর্মীদের জমি তাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। যে কোন ধরণের বেআইনী উচ্ছেদ, দখল এবং হামলা বন্ধ করতে রাষ্ট্র সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেবে কেননা, এটা নাগরিকের প্রাথমিক অধিকার। আর যদি এ পেশাকে ‘অমানবিক’ এবং ‘অনুচিত’ বিবেচনায় নিষিদ্ধ করতেই হয় তাহলে অবশ্যই যৌনকর্মীদের অন্য স্থান এবং পেশায় মর্যাদার সঙ্গে পুনর্বাসনের সুযোগ দিতে হবে। মাথাব্যথার অজুহাতে মাথা কেটে ফেলার চর্চা অত্যন্ত বিপদজনক। মনে রাখা প্রয়োজন, যৌনকর্মের দায় রাষ্ট্রের এজন্য এর প্রতিকারের দিকেও তাদেরই সর্বোচ্চ নজর দেয়া উচিত।

লেখক: নারী অধিকার কর্মী

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত