প্রসঙ্গ নারীবাদ: হাজার বছরের শৃংখল

প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০১৬, ২৩:৩৭

যুগ যুগ ধরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী নির্যাতিত হয়ে আসছে এবং এটাকেই স্বাভাবিক ধারা বলে মনে করা হয়। নারী অত্যাচারকে শুধুমাত্র নারী অত্যাচার না ভেবে মানব অত্যাচার বলা যেতে পারে, একটা মানুষ আরেকটা মানুষ দ্বারা অত্যাচারিত হচ্ছে। ভাষা, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ষণ… ইত্যাদি নামে সমাজে নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে যত ধরণের রেসিজম আছে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনই মানব অধিকারের আন্দোলন, তার একটি অংশ পুরুষতন্ত্র যা একটি সিস্টেম যা তৈরি করেছিল এ সমাজের পুরুষ মানুষ আর এই সিস্টেম পুরুষতন্ত্রের দ্বারা নারী অত্যাচারিত হচ্ছে। নারীমুক্তি আন্দোলন মানব অধিকারেরই আন্দোলন। নারীবাদ মূলতঃ মানবতাবাদেরই একটা অংশ। ইতিহাসে লিঙ্গ বৈষম্যের নিরসনকারী প্রতিটি সামাজিক পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে নারীবাদ নামকরণ করা হয়। নারীবাদ কথাটি নারীদের অধিকার আদায়, সমতা অর্জন, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণে সংগঠিত মতবাদই নারীবাদ। নারীর অধিকার ও অংশগ্রহণ মানে নারী ভোটাধিকার, ভাষায় লিঙ্গ নিরপেক্ষতা, পক্ষপাতহীন বেতন কাঠামো অর্থাৎ সমান কাজে সমান বেতন, প্রজনন সংক্রান্ত অধিকার, ব্যবসা, শিক্ষার অধিকার, বিবাহে সমান অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, মাতৃত্বকালীন অবসর ইত্যাদির স্বীকৃতি প্রদান তথা নারীর সার্বিক ক্ষমতায়ন।

প্রাচীন সোফিস্ট ( Sophist ) দার্শনিকদের কাছে নারীবাদ একটি পূর্ণাঙ্গ মতবাদ আবার কোন দার্শনিকের মতে এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গি মাত্র। আবার অনেকের মতে, এটি নৈরাজ্যবাদী দর্শনের সমর্থক অর্থাৎ নারীবাদ বিষয়টি বর্জনীয়। প্রগতিশীল বা অগ্রসরবাদীদের মতে, যারা নারীবাদকে মতবাদ হিসেবে স্বীকার করে না তারা মূলতঃ অন্তর্নিহিত চেতনায় নারীকে ভোগের সামগ্রী বা সন্তান প্রজননের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করে। সম্ভবত ১৮৩৮সালে ফরাসী দার্শনিক ও ইউটোপীয় সমাজবাদী চার্লস ফুরিয়ে ( Charles Fourier ) সর্বপ্রথম নারীবাদ শব্দটির ব্যবহার করেছিলেন। সময়, সংস্কৃতি ও দেশভেদে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সমাজকল্যাণমূলক সংগঠন নারীর অধিকার, ক্ষমতায়ন, শিক্ষা প্রদান, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, স্বাবলম্বীকরণে নারীর অধিকার আদায়ে সচেতনকরণ, নির্যাতিত নারীর আইনি সহায়তা, সেমিনার ও কর্মশালা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মসূচী ও লক্ষ্য পূরণের মধ্য দিয়ে নারীমুক্তি আন্দোলনের কাজ এগিয়ে চলেছে। দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম।

প্রাগৈতিহাসিক যুগে নারী পুরুষের আলাদা কোন বৈষম্য ছিল না। নারী বৈষম্যের সূচনা হয় মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির কারণে, বংশগতি রক্ষার ধারা থেকে নারীর অবস্থানের পরিবর্তন হয় যা থেকে মূলতঃ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের উত্থান ঘটে। শিকারকেন্দ্রিক টোটেম সমাজ ব্যবস্থায় সবচেয়ে শক্তিশালী পুরুষটি সমাজের নেতৃস্থানীয় বা গোষ্ঠীপ্রধানের ভূমিকা পালন করত। বংশগতি রক্ষার ধারা তথা সন্তানের পিতৃপরিচয় ও গোষ্ঠীপতির সুন্দরী নারীর প্রতি আকর্ষণ থেকেই মূলত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পত্তন ঘটে। অথচ এর পূর্বে ছিল মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, টোটেম সমাজ ব্যবস্থা থেকেই প্রকৃতি পূজার প্রচলন ঘটে, পরবর্তীতে এই পূজাকেন্দ্রিক পুরোহিত শ্রেণী এবং গোষ্ঠীপ্রধান মিলে গোষ্ঠীর উপর পূর্ণ শাসন কায়েম করে এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হয়।

প্রাচীনকাল থেকে সমাজে একটি কথা প্রচলিত ছিল mother’s baby father’s may be. পৃথিবীতে পুরাতন আদি সভ্যতাগুলি ছিল মাতৃতান্ত্রিক। তখন নারী পুরুষের আলাদা কোন অধিকার ছিল না। নারী ও পুরুষ উভয়ে ছিল স্বাধীন, উভয়ই সব কাজে সমানভাবে অংশগ্রহণ করত এবং সমভাবে নারী-পুরুষ শারীরিক ও মানসিক আনন্দ লাভ করত। আজকের মানব সভ্যতার জটিলতা কুটিলতা ঐ সমাজ ব্যবস্থায় ছিল না, বর্তমানে মানব সভ্যতার ঐতিহ্য হচ্ছে নারীকে নির্যাতন করা এবং নারী নির্যাতিত হচ্ছে পুরুষতন্ত্র দ্বারা।

ইতিহাস থেকে জানা যায় আদি সমাজে মানুষ গোত্রভুক্ত হয়ে বসবাস করত, তারা সম্পদ চিনতে শিখল, নারীর দেহ ও নারীর গর্ভকে রুপান্তরিত করল সম্পদে, নারীর জীবন থেকে মুছে গেল মানবিক স্বাধীনতা, নারীর মানসিক আনন্দ পুরুষতন্ত্র নিজ হাতে তুলে নিল।, আর তখন থেকে এ পর্যন্ত বেশীরভাগ পুরুষের মাথায় চেপে আছে এই পুরুষতন্ত্র এবং তার একমাত্র অমানবিক শিকার হচ্ছে নারী। মানুষের দৈহিক ও মানসিক আনন্দের যে স্পৃহা রয়েছে তা থেকে বঞ্চিত করা হলো নারীকে। নারী যেখানে গর্ভধারণে সক্ষম সেখানে পুরুষ নারীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য একের পর এক কৌশল তৈরি করল, একের পর এক গন্ডির মধ্যে নারীকে বন্দী করা হলো। অতঃপর নারীর উপর পূর্ণ আধিপত্য বিস্তারের জন্য খুব ধূর্ততার সঙ্গে পুরোহিত শ্রেণী ও সমাজের নেতৃস্থানীয়রা কাজে লাগালো প্রথাকে, ধর্মকে, ঐতিহ্যকে, ভাষাকে, পোশাককে, সাহিত্যকে, কৃষ্টিকে, সংস্কৃতিকে, খাদ্যকে, রাষ্ট্রকে, আইনকে– এগুলো ব্যবহার করে অত্যন্ত সুকৌশলে নারীর পায়ে পরিয়ে দেয়া হলো শেকল। বিভিন্ন উপাদান ও অনুষঙ্গ পুরুষ সাজিয়েছে নারীকে নির্যাতন করার জন্য এবং সফল হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ।

পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে নারীদের অধিকার সচেতনতা আন্দোলন সহ রেনেসাঁ বিপ্লব ও শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে নারীরা তাদের অধিকার ও সমতা কিছুটা হলেও ফিরে পেতে শুরু করে। কিন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে তৃতীয় বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের অধীনে থাকায় এ বিশ্বের নারীরা তাদের অধিকার ও সমতা থেকে বঞ্চিত থেকেই যায়। তৃতীয় বিশ্বের নারীরা পশ্চিমা দেশগুলির নারীদের মতো সুযোগ-সুবিধা পায় না ও তাদের মুক্তিও ঘটে না। এক সময় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো স্বাধীন হলেও ধর্ম, অশিক্ষা, কুসংস্কার, দারিদ্র, ভঙ্গুর সমাজ ব্যবস্থা ইত্যাদি কারণে নারীদের উল্লেখ্যযোগ্য উন্নয়ন হয় না।

যে মূল্যবোধ নিয়ে মানুষ জন্মগ্রহণ করে সে মূল্যবোধের প্রকাশ থেকে বঞ্চিত থেকে যায় একমাত্র নারী। নারী ও পুরুষ আকৃতি ও প্রকৃতিগতভাবে যাই থাকুক না কেন, মানব মস্তিস্কের চিন্তার লালন পালনের দ্বারা পুরুষ ভয়ানক অত্যাচারী রূপে প্রকাশিত হয়েছে। কখনো কখনো শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করে নারীকে করে তোলে দুর্বল থেকে দুর্বলতর। আর তা থেকেই তৈরি হয় একটি অসুস্থ পরিবার, অসুস্থ পরিবার থেকে অসুস্থ সমাজ, অসুস্থ সমাজ থেকে অসুস্থ রাষ্ট্র। এই আগ্রাসী পুরুষতন্ত্রের ফলে পৃথিবীর মানব জগতের প্রায় অর্ধেক অংশ নারী দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পুরুষও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সংস্কৃতির যে রীতিনীতি প্রচলিত আছে তাতে নারী নিষ্পেষিত হচ্ছে, অবদমিত হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে, নিপীড়িত হচ্ছে, নিগৃহীত হচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে। কালের বিবর্তনে নির্যাতনের রকম সকম বদলে গেছে, কিন্তু নির্যাতন বন্ধ হয়নি তাই ১৯৪৮সালে তৈরি হয়েছিল মানব অধিকার সনদ আইন যার সকল ধারা আজো বাস্তবায়ন হয়নি। নারী ও পুরুষ একে অপরের পরিপূরক, তাই নারীকে বাদ দিয়ে বা পেছনে ফেলে দিয়ে শুধুমাত্র পুরুষের তৈরি পুরুষতন্ত্র সুন্দর পরিবার, সমাজ, দেশ গঠনে অসমর্থ। একচোখা দৃষ্টি দিয়ে দেখলে সমাজে কেবল অসভ্যতাই টিকে থাকবে। একটি সুস্থ পরিবার তৈরির স্বার্থে, একটি সুস্থ সমাজ গঠনের স্বার্থে, একটি সুন্দর দেশ গড়ার স্বার্থে নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষ জেগে উঠবে কি?

লেখক: নারীবাদী ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত