অন্যায়ের প্রতিবাদ হওয়া সুস্থ সমাজের লক্ষণ

প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০১৮, ২৩:৫৪

বাংলাদেশের স্কুলছাত্ররা দেশ বদলে ফেলবে, এমন অসম্ভব কল্পনা আমি করিনি। এই অদ্ভুত কল্পনাও আমার আশেপাশে আসেনি যে, স্কুলের ছাত্রদের অনুরোধে বা আদেশে বাংলাদেশের কোনও গাড়িচালকই আর লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালাবেন না, মোটরসাইকেল চালকরা হেলমেট পরবেন, সবাই ট্রাফিক আইন পালন করবেন। দু’তিন দিনের মধ্যে ছাত্ররা যে পরিবর্তন এনেছিল ঢাকার রাস্তায়, তা শুধু আমাকে নয়, অনেককেই মুগ্ধ করেছে। কিন্তু যে কোনও সফল আন্দোলনের মধ্যে যেমন মন্দ লোকেরা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ আদায় করতে ঢুকে যায়, নিরাপদ সড়কের এই আন্দোলনেও তেমন ঢুকে গেছে। ছাত্রদের হয়তো তার আগেই ঘরে ফিরে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সড়ক ছাড়ার অনুরোধ করা সত্ত্বেও সড়ক ছাড়েনি বলে পুলিশ আর ক্যাডার বাহিনীর কি উচিত হয়েছে রাস্তার নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া? সময় বদলেছে, এখন খুব সহজেই ক্যামেরায় ধরে রাখা যায় কে বা কারা কবে কখন কী ঘটিয়েছে। অপরাধীদের নিরপরাধ সাজার সুযোগ এখন আগের চেয়ে অনেক কম। ফটোসাংবাদিক রাহাত করিমকে কীভাবে লাঠিসোঁটা আর রামদা হাতে আক্রমণ করা হয়েছে, কারা আক্রমণ করেছে, তার সব প্রমাণ ইন্টারনেটেই, মাত্র এক ক্লিক দূরত্বে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার বই নিষিদ্ধ করেছেন, তিনি আমাকে আমার নিজের দেশে প্রবেশ করতে বাধা দেন, আমাকে এমনকি বাধা দিয়েছেন দেশে গিয়ে আমার বাবার মৃত্যুশয্যার পাশে একবার শেষবারের মতো দাঁড়াতে। দূতাবাসগুলোও শেখ হাসিনার আদেশে আমার পাসপোর্টের নবীকরণ করে না, আমার জরুরি কোনও দলিলও সত্যায়িত করে না। তারপরও আমি শেখ হাসিনাকে সমর্থন করি। সমর্থন করি কারণ আমার জন্য তিনি মন্দ হলেও দেশের জন্য ভালো। এই ভালোটা কিন্তু তাঁর বিচক্ষণতা, বলিষ্ঠতা, বিবেকবোধ বিচার করে নয়। এই ভালোটা বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীর সঙ্গে তাঁর তুলনা করে বলা। এখনও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল আর জামায়াতে ইসলামী দলকে পাশে দাঁড় করালে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকেই নম্বর বেশি দিই। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো কোনও রাজনৈতিক দল, বা শেখ হাসিনার চেয়েও ভালো কোনও নেতা বা নেত্রী আজও তৈরি করতে পারেনি। শেখ হাসিনা এবং তাঁর দল, সত্যি বলতে কী, মন্দের ভালো। তিনি কোনও আদর্শ নেত্রী নন, তাঁর দল কোনও আদর্শ দল নয়। কিন্তু বিরোধী দলগুলো এতটাই দুর্নীতিবাজ, এতটাই দেশদ্রোহী, এতটাই সর্বনাশা জিহাদি যে শেখ হাসিনার পক্ষ নিতে বাধ্য হই। এটা জেনেও পক্ষ নিই, যে, তিনি একের পর এক ভুল করে যাচ্ছেন, একের পর এক অন্যায় করে যাচ্ছেন। চাই তিনি ভুল করা বন্ধ করুন, সমর্থন করি বলেই চাই, তিনি ছাড়া দেশের হাল ধরার আপাতত আর কেউ নেই বলেই চাই। মাঝে মাঝেই লক্ষ্য করি, গণতন্ত্রে, মানবাধিকারে, বাক স্বাধীনতায়, মত প্রকাশের অধিকারে কিছুতে আর তিনি যেন বিশ্বাস করতে চান না। প্রচণ্ড ব্যথিত হই, চিৎকার করি। আমার চিৎকার শোনার কেউ নেই। আমি রাজনীতিক নই, তাত্ত্বিক নই, প্রভাবশালী নই; সবার পিছে, সবার নিচে, সব হারাদের মাঝে আমি এক অনাথ লেখক মাত্র। এ কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে বিশ্বের শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের যে আস্থা এবং শ্রদ্ধা ছিল শেখ হাসিনার ওপর, সেটি নষ্ট হচ্ছে। তাঁর সুনামে চিড় ধরছে। এ কারণেই তাঁকে প্রমাণ করতে হবে, তিনি ভুল শুধরে নিতে পারেন। প্রমাণ করতে হবে তিনি শুধু তাঁর পার্টির নেত্রী নন, তিনি জনমানুষের নেত্রী, তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তিনি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চান না, তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন না, তিনি হিংস্র, প্রতিশোধপরায়ণ নারী নন, তিনি সংবেদনশীল মানুষ, তিনি যোগ্য নেত্রী। তাঁকে প্রমাণ করতে হবে তিনি রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য জনতার ন্যায্য দাবি, যৌক্তিক প্রতিবাদ আর আন্দোলন নস্যাৎ করার উদ্দেশে সশস্ত্র ক্যাডার লেলিয়ে দেন না। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল করে শেখ হাসিনাকে প্রমাণ করতে হবে গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত বাকস্বাধীনতায় তিনি বিশ্বাস করেন। তা না হলে প্রগতিশীল মানুষ আজ না হোক কাল তাঁর পাশ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হবেন। প্রগতিতে, আধুনিকতায়, নারী স্বাধীনতায়, ধর্মনিরপেক্ষতায় যারা বিশ্বাস করে না, তাদের সঙ্গই যদি প্রধান হয়, তবে প্রতিপক্ষের সঙ্গে তাঁর আর ফারাক কী রইলো?

যে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন, সেই প্রতিপক্ষের মতো তিনি আচরণ করুন, তা তাঁর সভ্য শুভানুধ্যায়ীরা চান না। এর মধ্যেই রিপোর্টার্স সান ফ্রন্টিয়ার্স নামে যে সংগঠন সাংবাদিকদের অধিকারের জন্য বিশ্বব্যাপী লড়ছে, জানিয়েছে, বাংলাদেশে নিরাপদ সড়ক চেয়ে ছাত্ররা যে আন্দোলন করেছে, সেই আন্দোলনের খবর করতে গিয়ে ২৩ জন সাংবাদিক আক্রমণের শিকার হয়েছেন। হিউমেন রাইটস ওয়াচও ৫৭ ধারার তীব্র নিন্দে করেছে। বলেছে, এই আইনটি তৈরিই করা হয়েছে শাসক দলের বা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। বিশ্বে খবর ছড়িয়ে পড়েছে যে, বাংলাদেশের বিখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে, তাঁকে গ্রেফতার করে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক অত্যাচার করা হয়েছে। তাঁর অপরাধ, তিনি ছাত্রদের যে আন্দোলন হচ্ছে তার ফটো তুলতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তা আল-জাজিরা টিভিতে বলেছেন। শহিদুল আলম ছাত্রদের পক্ষে বলেছেন এবং সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন। না তিনি কাউকে খুন করেননি, কারও মাথায় চাপাতির কোপ দেননি, লাঠিসোঁটা বা হাতুড়ির আঘাতে কারও হাড় ভাঙেননি, শুধু নিজের ঘরে বসে একটি প্রচার মাধ্যমে নিজের মত প্রকাশ করেছেন। সেই মত সরকারবিরোধী হলে তাঁকে কেন হেনস্তা হতে হবে? ধরে নিচ্ছি শহিদুল আলম মিথ্যে বলেছেন, কিন্তু সে কারণে তাঁর মুখ বন্ধ করার জন্য সরকারকে মরিয়া হয়ে উঠতে হবে কেন? সরকার তার সত্যটা নির্ভয়ে প্রকাশ করুক। শহিদুল মিথ্যে বলেছেন, তা প্রমাণ করতে সরকারের অসুবিধে কোথায়? নিজের সত্য প্রকাশ করে প্রমাণ করতে হবে শহিদুল মিথ্যে। ভাবছি নিজের ওপর আস্থা কতটুকু হারালে সরকারকে এমন অসহায় অবস্থায় পড়তে হয়, ইস্কুলের ছাত্রদের ভয় পেতে হয়, সাধারণ মানুষের দাবি-দাওয়াকে ভয় পেতে হয়, সাংবাদিকদের ভয় পেতে হয়, ফটোগ্রাফারের ক্যামেরাকে ভয় পেতে হয়, ভিন্নমতকে ভয় পেতে হয়! আজ বিরোধী দলগুলোর অযোগ্য অপদার্থ নেতারা ক্ষমতায় থাকলে যা দেখে ভয় পেতো, তা দেখে ভয় পাওয়া বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে, সত্যি বলছি, মানায় না। ভয় না পেলে কেউ ভয় দেখায় না।

সমালোচনা সহ্য করার শক্তি থাকতেই হয় মহান ব্যক্তিদের। মহান ব্যক্তি না হলে মহান রাজনীতিক হওয়া যায় না। সভ্য দেশের রাজনীতিকদের সামান্য ভুলত্রুটিতেই পদত্যাগ করতে দেখি। তৃতীয় বিশ্বেই শুধু ছলে বলে কৌশলে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা। গণতন্ত্রের নিয়মে ধর্মান্ধ, স্বার্থান্ধ, মূর্খ, বর্বর লোকেরাও দেশ শাসন করার সুযোগ পায়। দেশের উন্নতি আমি ভালো করতে পারি বলে আমি ছাড়া অন্য কাউকে দেশের শাসক হওয়ার সুযোগ দেব না, এমন ভাবনা বড় ক্ষতিকর। এমন ভাবনার শেকড়ে জল ঢালার জন্য পোড়া দেশে চাটুকারদের অভাব নেই। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, স্বৈরতন্ত্র কোনও সমস্যার সমাধান নয়। গণতন্ত্রের সিঁড়ি ব্যবহার করে গণতন্ত্রবিরোধী ধর্মশাসন যারা আনতে চায়, তাদের বিরোধিতা যেমন করতে হয়, তেমনি গণতন্ত্রের লেবেল এঁটে স্বৈরতন্ত্রের নিয়মে যারা দেশ চালাতে চায়, তাদের বিপক্ষেও দাঁড়াতে হয়।

জাতি স্তব্ধ হয়ে গেলে সর্বনাশ। যে কোনও অন্যায় আর বৈষম্যের প্রতিবাদ চাই। ক্ষত সারাতে হলে ক্ষতকে আগে চিহ্নিত করতে হবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ হওয়া সুস্থ সমাজের লক্ষণ। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রতিবাদীদের নির্যাতন করা অসুস্থতা আর অসভ্যতার লক্ষণ। বিএনপি ক্ষমতায় আসা মানে তারেক রহমানের মতো মূর্খ আর দুর্নীতিবাজের হাতে দেশের সর্বনাশ হওয়া, জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় এলে দেশকে আস্ত একটা আফগানিস্তান বানিয়ে ছাড়বে, হাসিনা আর খালেদাকে ‘মাইনাস’ করে যাঁরা দল পাকাচ্ছেন ক্ষমতায় আসার জন্য, তাঁদের ওপর আদৌ ভরসা করা যায় কিনা জানি না। সবচেয়ে ভালো হয়, হাসিনাই যদি নিজের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে দেশের সেবা করে যান। তিনি নিশ্চয়ই আগামী নির্বাচনে জিতবেন। কিন্তু দেশজুড়ে ধর্মান্ধতার শেকড় গাড়লে, মূর্খতা জনপ্রিয় বলে মূর্খতা ছড়াতে মূর্খদের সহযোগিতা করলে, মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসীদের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করলে, ভিন্নমতকে নিশ্চিহ্ন করতে চাইলে সে জেতায় কোনও লাভ নেই। নিজের এবং নিজের পার্টির লাভ হলেও দেশের লাভ একেবারেই নেই।

যোগ্য দলের স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে অযোগ্য দলের গণতন্ত্র ভালো। বাকশাল ছাড়া আর কোনও দলের অস্তিত্ব থাকবে না, এমন আইন করে বঙ্গবন্ধু ভুল করেছিলেন, আশা করি শেখ হাসিনা তেমন কোনও ভুল করবেন না। রক্ষী বাহিনী তৈরি করে যে ভুল বঙ্গবন্ধু করেছিলেন, আওয়ামী সমর্থকদের বা ছাত্রলীগের ছেলেপিলেদের সন্ত্রাস করার অনুমতি দিয়ে শেখ হাসিনা, আশা করছি, সেই ভুল করবেন না।

লেখক: নির্বাসিত লেখিকা
প্রথম প্রকাশ: বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৯ আগস্ট, ২০১৮

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত