‘আদিবাসী’ মানে ‘আদি বাসিন্দা’ নয়

প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০১৮, ১৩:৫৪

৯ আগস্ট ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’। সারা বিশ্বের ৯০টি দেশের প্রায় ৪০ কোটি আদিবাসী জনগণের অধিকার আদায়ের উপলক্ষ্য দিন এটি।

সারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতি বছরের মতোই এবারো বাংলাদেশেও দিবসটি উদযাপন হচ্ছে। জাতীয়ভাবে ঢাকায়, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে আর সারা দেশের জেলা-উপজেলায় বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে দিবসটি উদযাপন হচ্ছে।

কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? যে দেশে কোনো আদিবাসীই নাই, সেখানে আবার আদিবাসী দিবস? রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জাতীয়ভাবে হচ্ছে নাকি? মোটেই না...। এদেশে আদিবাসীও আছে কিন্তু রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জাতীয়ভাবে উদযাপন হচ্ছে না।

এ পর্যন্ত লেখাতেই ‘আদিবাসী’ শব্দটি বেশ কয়েকবার উল্লেখ করলেও ‘ইন্ডিজিনাস’ শব্দটি একবারও উল্লেখ করিনি। ফেঁসে গেলাম নাকি সংবিধানে? মোটেই না...। বরং সংবিধানই আমার কাছে ফেঁসে গেছে। আমি কিছুতেই বুঝি না, সংবিধানে এদেশের জনগণকে জাতি হিসেবে বাঙালি বানানো হয়েছে আবার আরেক ধারায় কিছু সংখ্যক জনগণকে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী, সম্প্রদায়ও বানানো হয়েছে। বাঙালি মানেই জাতি আর সংখ্যালঘু মানেই কি উপজাতি?

আচ্ছা, আপনি ক্ষেতে দুই প্রকার আলু লাগালেন, গোল আলু আর মিষ্টি আলু। ফসল উত্তোলনের সময় মিষ্টি আলু পেলেন ৫০মণ আর গোল আলু পেলে মাত্র ১০ কেজি। এখন এই দশ কেজি গোল আলু কি উপআলু বা উপালু হয়ে যাবে? নাকি গোল আলুই বলবেন? আচ্ছা বাদ দেন এসব। মূল কথাতেই আসি..।

আদিবাসী আর আদি বাসিন্দা শব্দগুলো কিন্তু একই অর্থ বহন করে না। না-না, এটা আমি বলিনি..। চট্টগ্রাম বিশ্ব বিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের টিচার রহমান নাসির উদ্দিন একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন। তাঁর বিশ্লেষণ মতে, আদিবাসী আর আদি বাসিন্দা এক নয়। ‘আদিবাসী’ হওয়ার জন্য ‘আদি বাসিন্দা’ হতে হবে এমনটা নয়। আদিবাসী হলো একটা স্বতন্ত্র জীবনপ্রণালী বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকেই ‘আদিবাসী’ বলা হয়।

ইংরেজি Indigenous (ইনডিজেনাস) শব্দের অর্থ ‘আদিবাসী’ বা ‘দেশজ’। যা একটি বিশেষ সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক শ্রেণি (ক্যাটাগরি) পর্যায়ে। আর Earliest Migrants(আরলিয়েস্ট মাইগ্রেন্টস) অর্থ হলো ‘আদি বাসিন্দা’। যা বসতি স্থাপনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটা ডেমোগ্রাফিক শ্রেণির পর্যায়ে। 

রহমান নাসির উদ্দিনের মতে, হাজার বছরের বাঙালি নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস বলে এতদঞ্চলের আদি বাসিন্দারা কোনো কালেই বাঙালিও ছিলেন না। এমনকি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাও বাঙালি ছিলেন না। তথাপি, যদি ধরেও নিই যে, আদিবাসীদের আগমনের পূর্বেই এদেশে বাঙালিদের বস্তি ছিল অর্থাত্‍ বাঙালিরাই এতদঞ্চলের আদি বাসিন্দা। কিন্তু আদিবাসী নয়। 

আদিবাসী মানে এই নয় যে, সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী সংশ্লিষ্ট ভৌগলিক অবস্থানে কত বছর ধরে বা অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর আগমনের পূর্বে বসবাস করে কিনা। আদিবাসী মানে হলো, তাঁদের সংস্কৃতি রাষ্ট্রের জাতীয় সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন বা স্বতন্ত্র। আদিবাসী বলতে এসব জনগোষ্ঠীকে বোঝায়, যারা যুগ যুগ ধরে স্বতন্ত্রভাবে নিজস্ব সমৃদ্ধ সমাজ, সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মীয় আচার-ব্যবস্থা, শাসনতান্ত্রিক লালন করে আসছে। এমনকি তাঁদের দৈহিক গঠন, মানসিক কাঠামো, খাদ্যভ্যাস, পোষাক-পরিচ্ছদ, নাচ-গান, শিল্পকলা, প্রথাগত পেশাও স্বতন্ত্র।

বাংলাদেশে এরকম জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা কমপক্ষে ৫৪টি রয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণাপত্র মারফত আমরা জানতে পারি। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র তাঁদেরকে আদিবাসী বলতে রাজি নয়। বরঞ্চ, সরকার বাহাদুর কর্তৃক তাঁদেরকে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ আখ্যায়িত করে সংবিধানে বলপূর্বক অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা সংবিধানে প্রয়োগকৃত অন্যান্য (উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়) বিশেষণসমূহের কোনো যৌক্তিক অর্থ ও ব্যাখ্যা এখনো পরিষ্কার করে দিতে পারেনি রাষ্ট্র। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৩(ক)-এ উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় শব্দসমূহ উল্লেখ থাকলেও রাষ্ট্র উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে দেশের সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে কেবল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বিশেষণে পরিচিত হতে বাধ্য করেছে। যেমন- ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট আইন ২০১০ প্রণয়নের মাধ্যমে এ জাতিগোষ্ঠীসমূহকে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ ও ‘আদিবাসী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। অথচ ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ বলে সংশোধিত(পঞ্চদশ) সংবিধানেও কোনো শব্দগুচ্ছ উল্লেখ নেই।

অপরদিকে, রাষ্ট্র বহু ভাষার, বহু জাতির, বহু সংস্কৃতির দেশ বাংলাদেশকে একক বাঙালি জাতি রাষ্ট্রে পরিণত করার মাধ্যমে দেশের সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীকে বিলুপ্ত ঘোষণাও করে।

মূলত ‘আদিবাসী’ ও ‘আদি বাসিন্দা’ শব্দ দুটোর অর্থ ও তফাত্‍ পুরোপুরি অনুধাবন করতে না পারায় রাষ্ট্র বরাবরই আশংকা করছে যে, এই ভূখণ্ডের বাসিন্দা হিসেবে কারা প্রথম ছিল। এই অঞ্চলে প্রথম আগমন কি বাঙালির নাকি সংস্কৃতি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীসমূহের। শংকা ও সন্দেহ দূর করতে হলে প্রথমে আদিবাসী ও আদি বাসিন্দা শব্দ ও শব্দগুচ্ছের অর্থ ও তফাত্‍ নিয়ে রাজনৈতিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক গুরুতর আলোচনা, যুক্তিতর্ক, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা দরকার। কেবল এ ধরণের আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্র এবং আদিবাসী দাবিদার জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের আলো দেখা পাওয়া সম্ভব।

নতুবা ধরে নিতে হবে, রাষ্ট্র শব্দ দুটির অর্থ ও পার্থক্য অনুধাবন করতে পেরেও জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত অধিকারসমূহ প্রদানে কার্পন্য করেই ঘোষণাপত্রের উপর ভোট দেয়নি এবং ‘দেশে কোনো আদিবাসী নেই’ বলে ঘোষণা বা অপপ্রচার করেছে এবং করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক ও হেডম্যান নেতা শক্তিপদ ত্রিপুরা আদিবাসী ও উপজাতি শব্দগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘ইংরেজি ট্রাইব শব্দ থেকে বাংলা উপজাতি শব্দটি এসেছে। ট্রাইব ও ট্রাইবাল শব্দগুলো প্রথম ব্যবহৃত হয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও বিদেশী নৃতত্ত্ববিদদের রচনায়। এটি একটি ঔপনিবেশিক ধারণা। তখন থেকেই এ শব্দগুলো বাংলায় মিশে গেছে। উপজাতি বলতে হীন, আদিম, অসভ্য, কম উন্নত, সরল, বিচ্ছিন্ন, অনুন্নত, পশ্চাদপদ ইত্যাদি বোঝাতে ব্যবহার করা হতো। এই শব্দটি বর্ণ-উপবর্ণ নির্দেশ করতেও ব্যবহৃত হয়। ব্রিটিশ ভারতে সময়ে উপজাতি শব্দটি অর্থ হিন্দুত্ব অর্থেও ব্যবহৃত হতো। (দেখুন, সংহতি, ২০০৬)।

শক্তিপদ ত্রিপুরা বলেছেন, ‘সাধারণত আদিবাসী বলতে তাদের বোঝায়, যারা আদি অধিবাসী কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন দিক দিয়ে প্রান্তিক অবস্থানে বসবাস করছে এবং তাদের নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং নিজস্ব সামাজিক কাঠামো ও ব্যবস্থাপনা রয়েছে এবং বর্তমানে এই জনগোষ্ঠী শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বিভিন্নভাবে নিষ্পেষিত’। তবে, অধ্যাপক রহমান নাসির উদ্দিন এ বৈশিষ্ট্যসমূহ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি আরো সহজভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, ‘একটি রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে বসবাসকারী একদল জনগোষ্ঠী যারা সাংস্কৃতিকভাবে সংখ্যা, যাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে যা জনতাত্ত্বিক সংখ্যাগুরুদের সংস্কৃতি থেকে স্বতন্ত্র এবং যাঁদের একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার আছে এবং যারা রাষ্ট্রের কাঠামোর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক তারা আদিবাসী হিসেবে বিবেচিত হওয়া দাবি রাখে। এদেশের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, হাজং, মুণ্ডাসহ প্রায় ৫৪টি সংস্কৃতি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীও আদিবাসী হওয়ার দাবি রাখে।’

এছাড়াও জাতিসংঘের স্পেশাল রিপোর্টেয়ার মি. মার্টিনেজ কবো আদিবাসী সংজ্ঞায়িত করেছেন এইভাবে- "Indigenous communities, peoples and nations are those which, having a historical continuty with pre-invasion and pre-colonial societies that developed on their territories, consider themselves distinct from other sactions of the societies now prevailing in those territories or part of them. They from at present nondominat sectors of society and are determined to preserve, develop and transmit to future generations their ancestral territories, and their ethnic identity as the basis of their continued existence as people, in accordance with their own cultural patterns, social institutions and legal system. In short, indigenous people are the descendants of the original in habitants of a territory overcome by conquest or settlement by aliens."

বাংলাদেশ সরকার দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকার করেছে বলে মার্টিনেজ উল্লেখ করেছেন। তিনি তার গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন- In Bangladesh, the government states that the members of Tribal of semi-tribal populations are regarded an indigenous on account of their descent from the populations which are settled in specified geo-graphical areas of the country.

বাংলাদেশ সরকারের কোনো কোনো আইনে কোনো সরকারি কাগজপত্রে দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী‘ হিসেবে স্বীকার করা হলেও বিশেষত বিদেশের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক সভা-সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকার এসব ক্ষুদ্র জাতিদের ‘আদিবাসী‘ হিসেবে স্বীকার করে না। অথচ আমরা দেখতে পাই যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির ৪, ৬, ৩৪, ৪৫, ৫০ প্রভৃতি ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে Indigenous Hillman হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

The Indian Income Tax Act of 1922-এ বলা হয়েছে- The Indian Income Tax Act of 1922 shall apply to all person in the Chittagong Hill Tracts except the indigenous hillman.

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন-১ শাখা কর্তৃক স্মারক নং সংস্থাপন(এডি-২)-৩৯/৯১-১৪৩, তারিখ-১০/০২/১৯৯১এর পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী ও উপজাতির জন্য চাকরির বয়স সীমা স্বাভাবিক বয়স সীমার তুলনায় ১০ বত্‍সর এবং শ্রমসাধ্য কর্মের ক্ষেত্রে ৫ বত্‍সর পর্যন্ত শিথিল করা হয়েছে।’

বাংলাদেশের আদিবাসী দাবিদার সংস্কৃতি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীসমূহ ‘আদিবাসী‘ কি-না আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কনভেনশন ১০৭ এর অনুচ্ছেদ ১ থেকে জেনে নেয়া যেতে পারে। এতে বলা আছে-

১ (ক) স্বাধীন দেশসমূহের আদিবাসী এবং ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর সদস্যদের বেলায়, যাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা জাতীয় জনসমষ্টির অন্যান্য অংশের চেয়ে কম অগ্রসর এবং যাদের মর্যাদা সম্পূর্ণ কিংবা আংশিকভাবে তাদের নিজস্ব প্রথা কিংবা রীতি-নীতি অথবা বিশেষ বা প্রবিধা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়;
১ (খ) স্বাধীন দেশসমূহের আদিবাসী এবং ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ক্ষেত্রে রাজ্য বিজয় কিংবা উপনিবেশ স্থাপনের কালে এই দেশে কিংবা যে ভৌগলিক ভূখণ্ডে দেশটি অবস্থিত সেখানে বসবাসকারী অধিবাসীদের উত্তরাধিকারী হওয়ার প্রেক্ষিতে আদিবাসী বলে পরিগণিত এবং যারা, তাদের আইনসংগত মর্যাদা নির্বিশেষে নিজেদের জাতীয় আচার ও কৃষ্টির পরিবর্তে ঐ সময়কার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আচার ব্যবহারের সাথে সামঞ্জ্যপূর্ণ জীবন যাপন করে।’

উল্লেখ্য যে, দেশের আদিবাসী ও ট্রাইবাল জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ২২ জুন আইএলও কনভেনশন ১০৭ অনুস্বাক্ষর করে।

এই কনভেনশনটিকে বাংলাদেশের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়ন আনয়নে একটি কাঠামো এবং আলোচনার ক্ষেত্র তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ধরেই নিলাম যে, আদিবাসীদের আগমনের পূর্বে এ অঞ্চলে বাঙালিদের বসতি ছিল। তাই আমরা সবাই মিলে স্বীকার করলাম যে, বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের বাঙালিরা এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা। কিন্তু বৈশিষ্ট্যে ‘আদিবাসী’ নয়। আইএলও কনভেশনে প্রদত্ত বৈশিষ্ট্যসমূহকে বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, সাধারণত কোনো একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বা এলাকায় বা অঞ্চলে অনুপ্রবেশকারী জনগোষ্ঠীর আগমনের পূর্বে যাঁরা বসতি স্থাপন করে অদ্যাবধি বসবাস করে আসছেন এবং যাঁদের নিজস্ব ও আলাদা সংস্কৃতি, রীতিনীতি, বিশ্বাস মূল্যবোধ, সামাজিক প্রথা-পদ্ধতি, খাদ্যাভ্যাস স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং যাঁরা নিজেদের আলাদা সামষ্টিক সমাজ সংস্কৃতির অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে নিজস্ব সামাজিক আইন-প্রথায় আত্মনিয়ন্ত্রণে অভ্যস্ত এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যাঁরা রাষ্ট্রে সাংস্কৃতিকভাবে সংখ্যালঘু হিসেবে পরিগণিত তাঁরাই আদিবাসী। যদিও বাংলাদেশের আইনের ক্ষেত্রে এটি সমর্থন করে না। এ হিসেবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা আরো বেশি আদিবাসী হবার দাবি রাখে। কেন না, আইএলও এটাও বলছে যে, ‘একটি রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে বসবাসকারী একদল জনগোষ্ঠী যাঁরা সংস্কৃতিভাবে সংখ্যালঘু, জনতাত্ত্বিক সংখ্যাগুরুদের সংস্কৃতি থেকে স্বতন্ত্র এবং যাঁদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক রয়েছে এবং যাঁরা রাষ্ট্রের কাঠামোয় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে অনগ্রসর বা প্রান্তিক’ তাঁরাই আদিবাসী হিসেবে চিহ্নিত হবার অধিকার রাখে। এই সকল বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশে বসবাসরত সংস্কৃতি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীসমূহের রয়েছে। এখানকার চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মান্দি, হাজং, খুমি, লুসাই, সাঁওতাল, মণিপুরী, ম্রো, বমসহ প্রায় ৫৪টি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর আলাদা আলাদা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। প্রথা-পদ্ধতি রয়েছে। সামাজিক আইন-শৃঙ্খলা রয়েছে। এসব জনগোষ্ঠী সামাজিকভাবে, শিক্ষায়, অর্থনৈতিকভাবে জনতাত্ত্বিক সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর থেকে অনেক অনেক পিছিয়ে। এঁদের প্রত্যেকের স্বতন্ত্র ভাষা, পোষাক, নাচ, গান, খাদ্যাভ্যাস, রুচি ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এমনকি তাঁদের দৈহিক গড়ন ও মানসিক গঠনও আলাদা। এমনকি অনেক জনগোষ্ঠী আছে, যাঁদের নিজস্ব বর্ণমালাও রয়েছে। সুতরাং এসব জনগোষ্ঠী অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠীর শাখা, প্রশাখা বা উপশাখা নয় যে, তাঁদেরকে উপজাতি বলা যাবে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীরা প্রত্যেকটি একেকটা জাতি।

এই ভূ-খণ্ডের ভৌগলিক ও শাসন ক্ষমতার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়-
...১৫৫০ সালে Joa De Barros নামের এক পর্তুগিজ তাঁর আঁকা বঙ্গের প্রথম প্রকাশিত মানচিত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। মানচিত্রে CHACOMA বা চাকমা রাজ্যের সীমানা দেখানো হয়েছে উত্তরে ফেনী নদী, দক্ষিণে নাম্রে বা নাফ নদী, পূর্বে লুসাই হিলস (মিজোরাম) এবং পশ্চিমে সমুদ্র।

অবশ্য এর আগে (৯৫১-৯৫৭ খ্রিঃ) আরাকানের এক রাজা সুলা চন্দ্র বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম জেলা দখল করেন। ১২৪০ সালে এই অঞ্চলটি পুনরায় ত্রিপুরার রাজার অধীনে চলে যায়। কয়েকবার মুসলিম শাসক এবং আরাকানের রাজার কাছে হাতবদলের পর এই অঞ্চলটি পুনরায় ১৫১৫ সালের দিকে ত্রিপুরার রাজা ধন্যমাণিক্যের অধীনে চলে যায়। ১৫১৮ সালে আবার এই অঞ্চলটি আরাকানের রাজা মিনজা’র অধিকারে চলে যায়।

পরে বিজয় মাণিক্যের(১৫৪০-৭০) এই অঞ্চলটি অধিকার করে নিলেও রাজা অমর মাণিক্যের(১৫৭৭-৮৬) সময় ১৫৭৫ সালের মধ্যে ত্রিপুরা রাজাদের কাছ থেকে আরাকানের রাজা সিকান্দার শাহ পুনরায় দখল করে নেন। প্রকৃতপক্ষে পার্বত্য ত্রিপুরা রাজা ও আরাকানের শাসকগণের মধ্যে এই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি একটি বিবাদের বস্তু ছিল।

মোগলরা ১৬৬৬ সালে আরাকানিদের কাছ থেকে এই অঞ্চলটি দখল করে নেয়। মোগলরা ১৬৬৬ থেকে ১৭৬০ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করে। ১৭৬০ সালের ১৫ অক্টোবর বাংলার নবাব মীর কাশিম বঙ্গ, বিহার এবং উড়িষ্যার শাসন ক্ষমতা পরোক্ষে ও প্রত্যক্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা ইংরেজদের হাতে তুলে দেন।

১৭৬৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চট্টগ্রাম কাউন্সিলের প্রথম প্রধান কর্মকর্তা Mr. Henry Verelst চাকমা রাজার শাসনাধীন রাজ্যের সীমানা সম্পর্কে সরকারিভাবে প্রদত্ত ঘোষণায় এই অঞ্চল সম্পর্কে বর্ণিত হয় যে, "The local Jurisdiction of Chakma Raja Shermust Khan is to be all the hills from Pheni river to the Sangu and from Nizaampur road to the hills of Kuki Raja."

এ হিসেবে এই ভূখণ্ডের সংস্কৃতি সংখ্যালঘুরা কেবল আদিবাসী নয়, এরা আদি বাসিন্দাও দাবিদার। যদিও এই আদিবাসী দাবিদাররা আদি বাসিন্দা দাবি করছে না বা আদিবাসী আর আদি বাসিন্দা অর্থের এক নয়।

‘আদিবাসী দিবস’ জিনিসটা কী?
বিশ্বের আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষার ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে জাতিসংঘ ইতোমধ্যে ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’ প্রণয়ণ করে সদস্যরাষ্ট্রসমূহকে নিজ নিজ দেশে বাস্তবায়নের জন্য আহবান জানিয়েছে। জাতিসংঘ এটাও স্বীকার করেছে যে, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক যুগ থেকে ৭০টি দেশে বসবাসকারী প্রায় ৪০ কোটি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ওপর শতাব্দিকালব্যাপী বৈষম্য ও জাতিগত আগ্রাসন চলমান রয়েছে। 

আর তাই, ১৯৭০সালে জাতিসংঘের সংখ্যালঘু রক্ষা ও বৈষম্য প্রতিরোধ সংক্রান্ত সাব-কমিশন(Sub-Commossion on the Prenvention of Discriminatio and protection of Minorities) গঠনের মাধ্যমে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা সংক্রান্ত পরিস্থিতির উপর এক সামগ্রিক পর্যালোচনা করে অবশেষে ১৯৯৩ সালে ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রণয়ণ, আদিবাসী বর্ষ, আদিবাসী দিবস ও আদিবাসী দশক ঘোষণা করে জাতিসংঘ।

জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র ও আদিবাসী প্রতিনিধিদের মধ্যে ১৯৮৫ হতে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত আলোচনা-পর্যালোচনার পর উক্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ কর্তৃক ৪৬টি অনুচ্ছেদ সম্বলিত ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’-এর একটি খসড়া প্রণয়ন করা হয় এবং তা ১৯৯৪ সালে মানবাধিকার সাব-কমিশনে পেশ করা হয়। সাব-কমিশন উক্ত খসড়া ঘোষণাপত্র অনুমোদন পূর্বক মানবাধিকার কমিশনে প্রেরণ করে। জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে, যার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘আদিবাসী জনগণ: একটি নতুন অংশীদার’। এবং ৯ আগস্টকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৩ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৯৫-২০০৪সাল সময়কালকে প্রথম ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক’ পালনের ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষার আন্দোলন। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের তৃতীয় দশক চলছে। কিন্তু বাংলাদেশসহ কোনো কোনো রাষ্ট্র এখনো আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষায় ইতিবাচক সাড়া দেয় নাই। এমনকি তাঁদের দেশে আদিবাসী রয়েছে বলেও স্বীকার করছে না। যদিও বাংলাদেশ তাঁর দেশের সংস্কৃতি সংখ্যালঘুদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকার না করার স্বপক্ষে যথার্থ কোনো যুক্তি দাঁড় করাতে পারেনি এখনো। কিন্তু আমরা ধারণা করতে পারি যে, বাংলাদেশ মূলত জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয় ঘোষণাপত্র’-এ সম্বলিত অধিকার সমূহ প্রদানে কার্পন্যতায় সংস্কৃতি সংখ্যালঘুদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। আমরা দেখতে পাই, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রে সম্বলিত অধিকারসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও মৌলিক বিষয়গুলো হলো, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার; ভূমি ও ভূখণ্ডের উপর অধিকার; আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ভূমি ও ভূখণ্ডেরর উপর সামরিক কার্যক্রম বন্ধের অধিকার; মানবিক ও বংশগত(জেনেটিক) সম্পদসহ সাংস্কৃতিক অভিপ্রকাশের উপর নিয়ন্ত্রণের অধিকার; আদিবাসীদের ভূমি ও ভূখণ্ডের উপর থেকে তাদেরকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ থেকে রেহাই পাওয়ার অধিকার; সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও প্রথা চর্চা ও পুনরুজ্জীবিতকরণের অধিকার; মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার; নিজস্ব ভাষায় নিজস্ব সংবাদ মাধ্যম প্রতিষ্ঠার অধিকার; উন্নয়নের অধিকার প্রয়োগ করার জন্য অগ্রাধিকার তালিকা ও কর্মকৌশল নির্ধারণ ও গ্রহণের অধিকার; নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী ঔষধি ও স্বাস্থ্যসেবা সংরক্ষণের অধিকার; স্বাধীন ও পূর্বাবহিত পূর্বক সম্মতি ব্যতীত ছিনিয়ে নেয়া ভূমি, ভূখণ্ড ও সম্পদের পুনরুদ্ধার ও ফেরত পাওয়ার অধিকার ও নিজেদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করার অধিকার ইত্যাদি।

তবুও আমরা আশাবাদী যে, অদূর ভবিষ্যতে হলেও বাংলাদেশ ‘আদিবাসী’ আর ‘আদি বাসিন্দা’ এর তফাত্‍ বুঝতে সক্ষম হবে এবং জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র মেনে নিয়ে দেশের সংস্কৃতি সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় এগিয়ে আসবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এই শুভ বুদ্ধি যেন অবিলম্বে উদয় ঘটে এই আশাবাদ ব্যক্ত করি।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত