বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০১৮, ১৬:২৫

তুরিন আফরোজ

বঙ্গবন্ধুর সমস্ত আন্দোলনের একটিই উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা।বাঙালি জাতি সত্ত্বার উপর যখনই আঘাত এসেছে তখনই বঙ্গবন্ধু প্রতিবাদ মুখর হয়ে সেই আঘাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, আইয়ুবের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন,১৯৭০ এর নির্বাচন যখনই বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সামনে এসেছে তিনি পাকিস্তানী সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বজ্র কঠোর অবস্থান নিয়েছেন।এমনকি আমরা দেখেছি তৎকালীন তথাকথিত গণতন্ত্রকামী নেতার পলিসি যখন ছিল “ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব পলিসি” অথবা যখন ঠুনকো অজুহাতে বাঙালির ভোটের দাবি অর্জনের লড়াইয়ে সামিল হলেন না, সেই সময়েও বঙ্গবন্ধু ছিলেন হিমালয়ের মত অবিচল। ১৯৭০ এর নির্বাচনে জয় লাভের পর যখন পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরে টাল বাহানা শুরু করে তখন তিনি তার ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণেও জাতীয়তাবাদকে খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলেন। 

তিনি বলেন “আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়। নির্বাচনে আপনারা সম্পূর্ণভাবে আমাকে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে। কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস, বাংলার মানুষের মুমূর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতিহাস। নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস।”

অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের আলোকে উদ্ভাসিত।

৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হল। বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলায়। বঙ্গবন্ধুর বহু দিনের লালিত স্বপ্ন বাঙালি জাতি তার শাসনতন্ত্র রচনা করবে। তার সেই স্বপ্ন পূরণ হল। তার প্রানের বাঙালি জাতি নিজেরদের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করলেন। যেদিন গণ পরিষদে সেই শাসনতন্ত্র গৃহীত হয় সেই দিন বঙ্গবন্ধু দৃঢ় চিত্তে গণপরিষদে দাড়িয়ে বলেন, “জনাব স্পীকার সাহেব, আজ প্রথম সাড়ে সাত কোটি বাঙালি তাদের শাসনতন্ত্র পেতে যাচ্ছে। বাংলার ইতিহাসে বোধ হয় এই প্রথম নজির যে, বাঙালিরা তাদের নিজেদের শাসনতন্ত্র প্রদান করছে। বোধ হয় নয়, সত্যিই প্রথম-বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিরা জনগণের ভোটের মারফতে গণপরিষদে এসে তাদের দেশের শাসনতন্ত্র প্রদান করছেন।” (গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রদত্ত ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বরের ভাষণ) 

রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু তাঁর দেশের মাটিতে আরও জোরালো ভাবে দিলেন জাতীয়তাবাদের ঘোষণা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ব্যাখা দিতে গিয়ে তিনি বললেন, “জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অসম মরণ সংগ্রামে। জাতীয়তাবাদ না হলে কোন জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। এই মূলনীতির উপর ভিত্তি করে আমরা এগিয়ে গিয়েছি। … এই যে জাতীয়তাবাদ, সে সম্পর্কে আমি একটা কথা বলতে চাই। ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন, সকলের সাথে একটা জিনিষ রয়েছে, সেটা হলো অনুভূতি। … অনেক দেশ আছে একই ভাষা, একই ধর্ম, একই সবকিছু, কিন্তু সেখানে বিভিন্ন জাতি গড়ে উঠেছে, তারা একটি জাতিতে পরিণত হতে পারে নাই। জাতীয়তাবাদ নির্ভর করে অনুভূতির উপর। আজ বাঙালি জাতি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, এই সংগ্রাম হয়েছিল যার উপর ভিত্তি করে সেই অনুভূতি আছে বলেই আজকে আমি বাঙালি, আমার বাঙালি জাতীয়তাবাদ।” (গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রদত্ত ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বরের ভাষণ)

অতি সাধারণ ভাষায় তিনি জাতীয়তাবাদের যে গভীর ব্যাখা দিয়েছেন তা সত্যিই অনন্য। তিনি প্রথমেই বলেছেন, জাতীয়তাবাদ না হলে একটি জাতি এগোতে পারে না এবং জাতি হিসেবে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার মূলনীতি হবে জাতীয়তাবাদ।

বঙ্গবন্ধু গণপরিষদের দাঁড়িয়েও গেয়েছেন তার প্রাণের বাঙালি জাতির গৌরব গাথা।তিনি বলেন “জনাব স্পীকার সাহেব, আমি গত নির্বাচনের পূর্বে ও পরে বলেছিলাম, যে জাতি রক্ত দিতে শিখেছে, সেই জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারে না। সেই জাতিকে কখনও কেউ পদানত করতে পারে না। সে কথা অক্ষরে অক্ষরে আজ প্রমাণ হয়ে গেছে।”(গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রদত্ত ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বরের ভাষণ)

কাজেই আমরা দেখতে পাই রাজনৈতিক নেতা থেকে বঙ্গবন্ধু পরবর্তীকালে জাতির জনক- তার পুরো জীবনটি কেটেছে বাঙালি জাতিকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে প্রতিষ্ঠা করার লড়াইয়ে।

তিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে ভাষণের এক পর্যায়ে বলেন ‘আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু এসে থাকে যদি আমি হাসতে হাসতে যাব। আমার বাঙালি জাতকে অপমান করে যাব না। তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব না এবং যাবার সময় বলে যাব, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।’

তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি দাড়িয়েও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে ছিলেন অবিচল। মৃত্যুভয় ও তাকে তার বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে তার অবস্থান থেকে এক বিন্দু নড়াতে পারেনি। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, তিনিই ছিলেন জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা এবং জাতীয়তাবাদের আলোকে উদ্ভাসিত একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক।

সূত্র: চ্যানেল আই

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত