প্রিয়তির খোলাচিঠি

প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০১৬, ০৩:২৬

জাগরণীয়া ডেস্ক

শব্দ দূষণ। বাংলাদেশে যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই শব্দ দূষণ। আইন করে হাইড্রোলিক হর্ণ নিষিদ্ধ করা হলেও বস্তুত তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সরকার সহ সবাই নির্লিপ্তভাবে মেনে নিচ্ছেন এই অপূরণীয় ক্ষতি। কিন্তু এবার শব্দ দূষণ নিয়ে নিজের নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মিস আর্থ ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার বিজয়ী অভিনেত্রী মাকসুদা আক্তার প্রিয়তি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। চিঠিটি জাগরণীয়ার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

বাংলাদেশে রাস্তায় উচ্চ শব্দের হর্ণ ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করা উচিত। আইনে হয়তো নিষিদ্ধ আছে। কিন্তু তাহলে কেউ সেটা মানছে না কেন? এটা কি দেখার কেউ নেই? অথচ বিকট শব্দের হর্ণের কারণে শব্দ দূষণ হয়। এতে স্কুলগামী শিশু-কিশোর, রোগীসহ পথচারীদের নানা রকম সমস্যা হয়। এতো বিকট আর ভয়ানক শব্দ/ আওয়াজের মধ্যে একজন মানুষের মন আর মাথা ঠিক থাকে কিভাবে? কিভাবে ব্রেন ঠিকমতো কাজ করবে। মেজাজ তো অটোমেটিক ভাবে খিটখিটে হয়ে যাওয়ার কথা। মানসিক ভাবে অজান্তেই অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কথা।

সাধারণভাবে ৪০-৪৫ ডেসিবল মাত্রার শব্দ ভালো শুনতে পায় মানুষ। এর চেয়ে বেশি মাত্রার শব্দ মানুষের শ্রবণশক্তিসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে। অথচ দেশের ৮০ শতাংশ যানবাহনে এখনো ব্যবহার হচ্ছে হাইড্রোলিক হর্ণ, যা ১০০ ডেসিবলেরও বেশি মাত্রার শব্দ সৃষ্টি করে থাকে।

প্রধান শহরগুলোতে এতই জ্যাম থাকে যে, রাস্তায় গাড়ি ঘণ্টায় ২০/৩০ কি. মি. এর বেশি যাওয়াও স্বপ্নের ব্যাপার। রাজধানীতে গাড়ি চলার গড় গতি ২৫ কিলোমিটারেরও কম। ভাবা যায়! এর মধ্যে যানজটে পড়ে যদি হাইড্রোলিক হর্ণের বিকট শব্দ কানে আসতে থাকে তাহলে সেটি হয় ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’য়ের মত ব্যাপার। 

খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ১৯৮৩ সালের মোটর ভেহিকল অর্ডিন্যান্সে নিষিদ্ধ হর্ণ ব্যবহার করলে জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আর ১৯৪০ সালের দ্য মোটর ভেহিকল বিধিমালায়ও হাইড্রোলিক হর্ণকে নিষিদ্ধ। অর্ডিন্যান্সের ১৩৯ ধারায় নিষিদ্ধ হর্ণ ব্যবহারে ১০০ টাকা জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আর মোটরযান বিধিমালার ১১৪ ধারায় হর্ণ ব্যবহার-বিষয়ক ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, প্রতিটি যানে অবশ্যই বাল্ব (ইলেকট্রিক) হর্ণ ব্যবহার করতে হবে। এ ধারার মাধ্যমে উচ্চ ও বিকট শব্দ সৃষ্টিকারী এয়ার প্রেসার হর্ণ (হাইড্রোলিক) সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একাধিক শব্দের একটি সাকসেশন তৈরি করে, এমন বহুস্বরের হর্ণ ব্যবহার করা যাবে না বলেও এতে উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে, এমন হর্ণ ব্যবহার করা যাবে না, যার শব্দ কর্কশ, উগ্র ও উচ্চ। তবে অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশের গাড়ি ও কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমোদনপ্রাপ্ত পরিবহন এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে না। তাহলে রাস্তায় বিকট শব্দের হর্ণ বাজিয়ে গাড়িগুলো চলছে কিভাবে? এভাবে আর কতোদিন চলবে? মানুষের শ্রবণ শক্তি শেষ করে দিয়ে তারপর বন্ধ হবে?

অনেকেই বলবেন, হর্ণ ছাড়া কিভাবে চলবে, কেউ তো চোখেই দেখবে না, দুর্ঘটনা আরও বাড়বে। হাইড্রোলিক হর্ণ সমস্যা। মৃদু শব্দের হর্ণ থাকতে পারে। তবে তা কারণে অকারণে বাজানো যাবে না। স্কুল-কলেজ, হাসপাতালের সামনে তো নয়ই। তাছাড়া আমার কাছে মনে হয়, হর্ণ না থাকলে মানুষ আরও সতর্ক হবে, ডানে বামে আরও বেশি তাকাবে, সতর্ক ভাবে গাড়িও চালাবে। বেশি জরুরি হলে হেড লাইট ফ্ল্যাশ করতে পারে। এমনটি করতে করতে একদিন অভ্যস্তও হয়ে যাবে। পরিবর্তন তো এভাবেই হয়, শুধু পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে জানতে হয়।

আমি বাংলাদেশে রাস্তায় আছেন এমন কাউকে ফোন দিতেও ভয় পাই। কারণ দুই মিনিট ফোনে কথা বলে তিন ঘণ্টার জন্য মাথা ধরিয়েছি শুধু ফোনের মাধ্যমে হর্ণ এর শব্দ পেয়ে, রিকশা এর ক্রিং ক্রিং শব্দ তো মাথায় সারাদিন ক্রিং ক্রিং করতে থাকে, যায়ই না। আমার যদি ফোনে মাত্র দুই মিনিটে শব্দে এমন অবস্থা হতে পারে তাহলে যারা বাংলাদেশে থাকেন তাদের কথা ভাবলে মন আঁতকে উঠে। সত্যি মায়া হয় যে, আপনারা সব কিছু কত সহজেই মেনে নিয়েছেন।

আসলে, মেনে নিতে হয়েছে। কারও যেমন কিছু করার নাই, সেই ক্ষমতা ই নাই, ফেসবুক এ স্ট্যাটাস দেয়া ছাড়া। সরি টু সে, যাদের ক্ষমতা আছে তা যেন শুধু অবৈধ কাজের জন্য বরাদ্দ করা একমাত্র গণমাধ্যম পারে এই ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে, সচেতনতার মাধ্যমে জনমত সৃষ্টি করে দাবি জানিয়ে আইনের মাধ্যমে হর্ণ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। এতে দেশে শান্তির একটা পরিবেশ তৈরি হবে।

যদিও জানি, আমার কথা ঐ পর্যন্ত কারও গায়ে লাগবে না। কারণ আমি দেখেছি, আমাদের সনামধন্য এবং বিশিষ্ট লেখক জনাব আনিসুল হকসহ অনেকেই এই ইস্যুটি নিয়ে অনেকবার কথা বলেছেন, লেখালেখি করেছেন কিন্তু পরবর্তীতে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

অনেক বড় বড় ইস্যু এর মাঝে হর্ণ নামক ইস্যু টি আসলেই বাংলাদেশের জন্য ছোট শুনায়, কিন্তু মানুষের মন আর মানসিক অবস্থা সুস্থ থাকাও জরুরি একটা দেশের উন্নতির জন্য। মানুষ সুস্থ থাকলে, দেশ ও সুস্থ থাকবে আর তার জন্য সুস্থ পরিবেশও লাগবে। একটা সুস্থ পরিবেশ, একটা সুন্দর পৃথিবী সবারই কাম্য। এক সাথে সব পরিবর্তন হয়তো হবে না, একটা একটা করে হতে হবে, করিয়ে নিতে হবে, ইচ্ছাশক্তি থাকতে হবে।

লেখক: মাকসুদা আকতার প্রিয়তি, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মিস আর্থ ইন্টারন্যাশনাল (২০১৬), মিজ আয়ারল্যান্ড (২০১৪), মডেল ও চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। পেশাগত জীবনে বৈমানিক।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত