নারীর কাজের সম্মান কোথাও নেই

প্রকাশ | ২০ ডিসেম্বর ২০১৭, ২৩:৫৬ | আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৭, ০০:০১

নারীর কাজের প্রতি সাধারনের দৃষ্টিভঙ্গি কি আমাদের এই সমাজে? সেটা আমি নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছি।

একবার এক নারী বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল। আরেক বন্ধুর সফলতা নিয়ে যখন বললাম যে, সে আইনজীবী হিসেবে ভালো করছে। সাথে সাথে উনি বলে উঠলেন, আরে রাখো সে কিভাবে মামলা পায় তা জানি। বিস্ময়ে আমার চোখ চড়ক গাছ!

আরে তুমি জানো না, সে তার সিনিয়রের সাথে ডেট করে। তাছাড়া ওমুক ব্যারিস্টার তার তো....

বাকিটা আর শুনলাম না। শুধু বললাম, তুমিও তার যোগ্যতাকে মানলে না!! বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে পাশ করে যে আইনের লড়াইকে পেশা করেছে তাকেও অন্য কিছু কেনো ভাবছো? সে অবশ্য লজ্জিত হয়েছিলো। তখনই সরিও বলেছিলো।

আমি একবার এনজিওর বড় নেতাগনের সাথে চা বিরতিতে কথা বলছিলাম। কয়েক কোটি টাকার প্রোগ্রামকে বাস্তবায়নের কাজ করছে উনার সংগঠন। অনেক এসোসিয়েশনের নেতাও তিনি। কয়েকটা আলাপের পরই তিনি বললেন, বাহ আপনি তো ভালোই করছেন। শুনলাম আইসিটির প্রজেক্টটা করছেন।
জ্বি ভাই। চেষ্টা করছি। 
সাথে সাথে একটা ব্যঙ্গ হাসি দিয়ে বললেন, আর আপনারা তো পারবেনই! মেয়েদের ফান্ড হয়। একটু মেইনটেইন করলেই হয়।

আমি তার ইঙ্গিতটা ধরতে সময় লাগলো না। আমি বললাম, জ্বি ভাই। একই কাজ আপনিও পেলেন। কি যোগ্যতায়! সংগঠনের সুনাম, ভালো প্রপোজাল আর দরপত্রের পরীক্ষা পাশ করে তাই না! তো আমার বেলায় কেনো বাঁকা হাসি? আমার প্রপোজাল, বাজেট প্রিপারেশন আর সংগঠনের সুনাম কি লাগে নি?

একটু বিব্রতভাব দেখলাম, কিন্তু মুখের উপর বললাম, আপনার এতো বছরের কাজেও চেতনা ডেভেলাপ হয়নি। দুর্ভাগ্য।

একবার আমার বাসায় ছুটা এসিসটেন্ট নিলাম। ইন্টারভিউর দিন তার স্বামীও আসলো। আমি তার পরিবারের সকলের কথা জিজ্ঞেস করলাম। কাজের দরদাম হলো। দিনক্ষণ ঠিক হলো। আমার কাজও তাদের বললাম। তারা যাবার সময় বললো কাজ করবে না। আমি বললাম কেনো? স্বামীটা একটু শক্ত কথায় বললো, এনজিওর চাকরিতে তো বাইরে যাবেন। তখন খালি বাসায় তার স্ত্রী কাজ করবে না। আমি অবাক হয়ে বুঝাতে লাগলাম তার সিকিউরিটির সমস্যা হবে না। কোনো ভাবেই সে রাজি হয়নি। এবং সে সবসময় তার স্ত্রীর চাকরির জন্য ঘরের বিবিসাব চায়। চাকরিওয়ালা নয়।

কয়েকদিন আগে কিশোরগঞ্জের এক নারী কর্মকর্তার কথা নিজেরাই আলাপ করছিলাম। সাথে সাথে সেই ডিপার্টমেন্টেরই আরেক অফিসার বললো, আরে রাখেন তার ইফিসিয়েন্সির প্রশংসা। সব তো অমুক নেতার করুণা!

ইন্সটিটিউয়াল কিছু প্রোগ্রাম করি। সচেতনতার কাজ। ছেলে মেয়েকে যখন জিজ্ঞেস করি, মা কি করেন? কিছু না। কারন মায়েরা হাউজওয়াইফ। হাউজ ম্যানেজারের পোস্টের কোনো মাইনে নেই। ক্যালেন্ডার নেই। ক্যালেন্ডারে সম্মান, ছুটি কিংবা রিটায়ারের অপশনও নেই!!

কতো বিচিত্র মানুষের ধারনা!!
নারীর কাজের সম্মানটা দেবে কে!!

বন্ধুরা আমার কাজে সম্ভবত ঈর্ষা করে। হয়তো এসব ধারনাই করে। হা হা হা। করুক। কারন আমি জানি, সবসময় তোমাদের রেজাল্ট আমার চেয়ে খারাপ ছিলো, তোমাদের লেখা খারাপ ছিলো, পড়ার চেয়ে গান সিনেমা বেশি দেখতে, আড্ডা করতে। এমনকি আমার মতো অবিরাম মিছিল, শ্লোগানটা ধরতে না, কখনো প্রসিডিংসও লেখো নাই, আমার মতো ভালো সংগঠকও তুমি ছিলে না। এমনকি তোমরা ছিলে প্রচন্ড অলস। পাছে লোকে কিছু বলে! এই আশংকায় গলা ছেড়ে গানও গাইতে না।

মানুষের পরিশ্রম মানুষের জীবন বদলে দেয়। অনেকের আস্থা তৈরি হয়। অনেকের ভরসা পায়। ভালোবাসা পায়। সমাজে এমন কি জাতীয় আয়ে অবদান রাখে।

আজ হয়তো নিজের গন্ডিবদ্ধ ছোট অবস্থানের জীবন নিয়ে আফসোস করে। তাই তো বন্ধু হয়েও অনেকে হিংসে করে। আমি ঠিক আগের বন্ধুই তাদের মনে করি। তবে লজ্জা পাই এখনো চিন্তার পরিবর্তন না দেখে।

নারীর কাজের সম্মান কোথাও নেই। সেটা করতে যে মননের দরকার তা অর্জন করতে হয়। এটা সংস্কৃতির ব্যাপার। সে সংকটময় সময় আমরা পার করছি। মুক্তিযোদ্ধা সবার পরিচয় তো একই হওয়ার কথা! নারী বলে তার অবদানকেই যখন মুছে ফেলা হয়, সেখানে আমাদের জীবিকার কাজকে ছোট করবার সংস্কৃতি উন্নত হবে কোথা থেকে?

খুজিস্থা বেগম জোনাকির ফেসবুক থেকে