বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্ব ঐতিহাসিক স্মারক

প্রকাশ | ২৫ নভেম্বর ২০১৭, ১৩:১৩

আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী

বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘বিশ্ব ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল’ (ওয়ার্ল্ড’স ডকুমেন্টারি হেরিটেজ) হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। যে কারণে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ৭৭টি ঐতিহাসিক উল্লেখযোগ্য ঘটনাকে পিছনে ফেলে বিশ্ব ঐতিহ্যের  স্বারকে পরিণত হয়েছে। গোটা বাঙ্গালি জাতির জন্য এই অর্জন অত্যন্ত বিরল ও সম্মানের। ৪৬ বছর আগে ঢাকার সোহরাওয়াদী উদ্যানে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতাগামী বাঙালিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবার আহবান জানিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ১৮ মিনিটের এ ঐতিহাসিক বক্তব্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হবার আহবান জানান। 

আমি খুবই সৌভাগ্যবতী। আমার ছেলেবেলায় প্রিয় মাতুভূমি বাংলাদেশের জন্মকথা, তার ইতিহাস-বীরত্বের অর্জনের কথা জানার সুযোগ হয় আমার জন্মদাতা পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরীর কাছ থেকে। মুক্তিযুদ্ধ-বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশ এই সত্যপাঠের শিক্ষা, তার তাৎপর্য ছোট-ছোট বাক্য গঠনে আমার মস্তিষ্কে সন্নিবেশিত হতে থাকে গভীর বিশ্বাসে। সুনিপুন কথা মালায় আমার অন্তর জগতে তা প্রবেশ করেছে। প্রকৃত ইতিহাসের কাছে পৌছে দিয়ে আমার অভিভাবক পরম যতনে, সচেতনভাবে জানার সুযোগ করে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

আমি জেনেছি, বঙ্গবন্ধু মানেই একটি আদর্শ, একটি চেতনা। সকল সময়ে সকল বিষয়ে সমাধানের পথ দেখানো এক আলোকবর্তিকা। ৭ মার্চ মানেই সত্যের সামনে মাথা উচু করে দাড়াঁনো ভয়-ডরহীন আদর্শিক অস্থিত্ব যা সর্ব সময়ের। সর্বকালের প্রসঙ্গিকতায়  বাঙ্গালিকে আন্দোলনিত করে একটি উচ্চারণে-

‘এবারে সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

১৯৭১ সালের ৭মার্চের বঙ্গবন্ধুর ওই ঐতিহাসিক ভাষণ পৃথিবীর বুক ছিড়ে সব মুক্তিগামী মানুষকে নিয়ে একটি দেশ জন্ম দেবার ইতিহাস গড়ল। এই ভাষণ শুনার পূর্বে কেউ হয়তো জানতনা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের  ১৮ মিনিটের ভাষণের প্রতি শব্দ, প্রতিটি বাক্যেও মধ্যে ৭ কোটি বাঙালির স্বপ্নের বীজ লুকায়িত ছিল। একটি দেশকে জন্ম দেবার অস্তিত্বকে অনুভব করেছিল দেশ মাতৃকার পবিত্র মাটি। ৭ই মার্চের ১৮ মিনিটের ওই ভাষণে মহান মক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশনা ছিল। গণমানুষের রাজনীতির অভিজ্ঞতার নির্যাসে বঙ্গবন্ধু তার  অন্তরের গভীরে যা বিশ্বাস করতেন, বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার লক্ষে পৌঁছাবার মহেন্দ্রক্ষণে তিনি তাই ব্যক্ত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার সংগ্রামের সহযাত্রী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুনন্নেছা মুজিব বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসকে আরো শক্তিশালী করতে সে দিন বলেছিলেন- ‘তুমি যা বিশ্বাস কর, তাই বলবে’। বঙ্গবন্ধু তাই বলেছিলেন- ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব, এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্।’

বাংলার রাজপথ দেশমাতার সন্তানদের রক্তে রঞ্জিত, সেদিন তা বিশ্ব জেনেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এই ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে। বাঙালির ২৩ বছরের ত্যাগের ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতিহাস, সকল সময়ের সকল প্রাসঙ্গিকতায় পৃথিবীর সকল নির্যার্র্তিত মানুষের অধিকারের কথা তুলে ধরবার শক্তি যোগায়। 

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এই ভাষণের মধ্যে দিয়ে বিশ্ব ইতিহাসের পাতায়-পাতায় রক্ষিত রয়েছে রক্তাক্ত একাত্তরে ও পূর্ববর্তি সময়ে নিরস্ত্র বাঙালির উপর কীভাবে চেপে বসেছিলো পৈশাচিক পাকিস্তানী বাহিনী। বাঙালির পয়সায় কেনা অস্ত্র, যা কী না বাঙালিকে রক্ষা করবে বহিঃশত্রুর হাত থেকে, তা না করে, কীভাবে দুঃখী বাঙালির উপর ব্যবহৃত হয়েছিলো, তা জানা যায় এই ভাষণের মধ্য দিয়ে।

সেই ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্ববিবেককে কাপিয়ে তুলেছিল মানবতায়। বিশ্ববাসী বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে অকাতরে হাত বাড়িয়েছিল। ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ১৮ মিনিটের এই ভাষণ বিশ্ব মানচিত্রে মাথা তুলবার শক্তি যুগিয়েছিল বলে, এই ভাষণ প্রতিটি বাঙালির হয়য়ে দেশপ্রেমে জাগরিত করে। ৭ই মার্চের ভাষণ সকল সময়ের জন্য প্রাসংঙ্গিক। যতবার এই ভাষণ শুনা যায়, ততবারই গভীর প্রত্যয়ে এগিয়ে যাবার সাহস যোগায়। সকল দেশের, সকল মানুষের কাছে অন্যায়ে রুখে দাড়াবার নিদের্শনা পাওয়া যায় এই ভাষণে প্রতিটি লাইনে। শৃংঙ্খলাবোধ দিয়ে যেকোন আন্দোলনে জয় নিয়ে আসা যায়, এই ভবিষৎবাণী এই ভাষণে সুস্পষ্ট। 

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সত্যের পথে জীবণ উৎসর্গ করার কথা বলে, সকল সময়ে, সকল সমাজে অনাচারের বিরুদ্ধে মাথা উচুঁ করে দাড়াঁবার সাহস যোগায়। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়- 

‘এই মাঠে ছুটে এসেছিলো কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,/ লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক,/ পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক।/ হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলো মধ্যবিত্ত,/ নিম্নবিত্ত করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘু্রে,/ আর তোমাদের মতো শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে।’

সকল মানুষের অধিকার আদায়ের চিত্র ফুঠে উঠে এই ভাষণে। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ আজ সার্বজনীন বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারকের সম্মান অর্জন করেছে। অনাগত শিশুর আগামী দিনের স্বপ্ন পূরণে, আজকের তারুণ্য তাদের স্বপ্ন জয়ের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের তাৎপর্য শক্তি যোগাবে এগিয়ে যাবার লক্ষে।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক: সংসদ সদস্য ও সমাজকর্মী