কান ধরো, কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকো

প্রকাশ : ২০ মে ২০১৬, ১৫:২৯

সামিয়া রহমান

কান ধরো, কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকো। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণেই জানতে পারলাম, দেখতে পেলাম নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ হাইস্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের কান ধরে উঠবোস করছেন ওই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্ত। চারপাশে তার ছাত্ররা, উত্তেজিত জনতা।  টানা তেইশ বছর জ্ঞানের পথ দেখিয়ে আসা প্রধান শিক্ষক চরম অপমানের মুখোমুখি। অথচ চারদিকে মানুষের উল্লাস। শিক্ষকের অপমানে উল্লসিত কণ্ঠে চিৎকার— জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। শিক্ষককে ঘামে নেয়ে হতবিহ্বলভাবে উঠবোস করতে দেখেও সম্মান তো দূরের কথা, সামান্য করুণা পর্যন্ত হয়নি কারও। বেচারা একান্ন বছর বয়সী শিক্ষক শূন্য দৃষ্টিতে কান ধরে উঠবোস করেই যাচ্ছেন।

তার চারপাশের সব পরিচিত মুখ তখন অচেনা। মোবাইলে ভিডিও হচ্ছে, আনন্দ হচ্ছে। নৃশংস মানুষগুলোর সামনে উঠবোস করতে করতে একপর্যায়ে পড়ে গেলেও দয়া মেলেনি। শোরগোল ওঠে নাকে খত দেওয়ার। কী অপমান! কী লজ্জা! কিন্তু না, ছাড় মেলেনি প্রধান শিক্ষকের। তার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে পুরো ঘটনাটির নেতৃত্ব দেন ওই এলাকার নির্বাচিত সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান। তিনি মোড়ল, তিনি ক্ষমতাবান। তিনি হাত নেড়ে উঠতে বলেন, হাত নেড়ে বসতে বলেন, বৃদ্ধ এই শিক্ষককে। পুরো ঘটনাটিতে জোরালো ভূমিকা তার। তিনি মাস্টার, তিনি সরকার। তার হাতে আছে তুরুপের তাস। সব ঘটনার জায়েজিকরণ ব্যাখ্যা— ধর্মের কুৎসা ছড়ানো। হায় বাংলাদেশ! হায় জাতির মেরুদণ্ড!

সারা জীবন জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার পথে হয়তো কখনোসখনো দুষ্ট ছাত্রকে এমনটা শাস্তি দিয়েছেন। কিন্তু তাকেই যে সর্বসম্মুখে জনতার হর্ষধ্বনির সামনে কান ধরে শাস্তি মাথা পেতে নিতে হবে, দুঃস্বপ্নেও কি এমনটা ভেবেছিলেন? যে দেশে শিক্ষক আমলার পা ধরে মাফ চান, সে দেশে বৃদ্ধ শিক্ষককে কানে ধরে উঠবোস তো এলাকার ক্ষমতাবানদের কাছে নগণ্য বিষয়। তার বা তাদের রাজনীতিতে তিনি বা তারা বোধহয় এমনভাবে সমস্যার সমাধান করে আত্মতৃপ্ত হন। যে জাতি তার শিক্ষক, তার গুরুকে সম্মান করতে পারে না, সে জাতি আর যাই হোক শিক্ষিত জাতি নয়। যে দেশে রাজনীতিবিদ, আইনপ্রণেতা, সমাজের পথপ্রদর্শকরা তুড়ি মেরে গায়ের জোরে ক্ষমতার দম্ভ দেখান, সে জাতি আর যাই হোক সভ্য জাতি নয়। যে দেশের জনতা মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধুকে’ হাতিয়ার করে বৃদ্ধ শিক্ষকের অপমানে আনন্দিত হয়, স্বাধীনতা অন্তত তাদের প্রাপ্য নয়। হায় রে স্বাধীনতা!

শিক্ষক ভেঙেচুরে পড়ে যাওয়ার পরও শাস্তি শেষ হয়নি। হাত জোড় করে বিজ্ঞ জনগণের কাছে তাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়। বাধ্য করেন এলাকার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। এলাকার মোড়ল তারা। যা খুশি করার মালিকও তারা। শিক্ষকের দুর্দশায় তার কী বা আসে যায়! আদৌ কি কারও কিছু এসে যায়? গণমাধ্যমে দেখলাম আইনমন্ত্রী বলেছেন, এটি তার কাছেও নিন্দনীয়। তবে তিনি নাকি খবরের কাগজে রিপোর্ট দেখেছেন ওই শিক্ষক একজন ছাত্রকে মারধর করছিলেন। আমরা কি এই রিপোর্ট দেখেছি? তবে আশার কথা এটুকুই, তিনি জানিয়েছেন, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যায় না। তারা এটা কোনোভাবেই বরদাস্ত করবেন না। বহু ঘটনার বিচারের অপেক্ষায় আমরা থাকি। সংখ্যায় না হয় আরেকটি বাড়ল। কিন্তু তাতে কি শিক্ষকের ধুলায় লুটিয়ে ফেলা সম্মান ফিরে আসবে?

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার বলেছেন, যেহেতু ওই ঘটনায় কোনো ফৌজদারি অপরাধ ঘটেনি তাই পুলিশের কিছু করার নেই। জানতে চাই পুলিশ প্রশাসনের কাছে, আজ যদি তাদের ঘরে, তাদের পিতার সঙ্গে ঘটনাটি ঘটত তখনো কি অপরাধ বলে এটা প্রমাণিত হতো না?

গণমাধ্যমে শুনলাম শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, তিনি মর্মাহত। তার নির্দেশের পর এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

বৃদ্ধ প্রধান শিক্ষক এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পুলিশ তাকে পাহারা দিলেও পাহারায় আছে আরও কিছু মানুষ। শিক্ষকের সঙ্গে গণমাধ্যমের সব কথাবার্তা তারা মোবাইলে ধারণ করে, পর্যবেক্ষণ করে। টিভি চ্যানেল সংবাদ প্রচার শুরু করলেও ডিসের সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ার খবরও এসেছে গণমাধ্যমে।

আইনমন্ত্রী ছাত্রকে মারধরের কথা বললেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, শ্রেণিকক্ষে ‘ধর্মীয় কটূক্তির’ অভিযোগে গত শুক্রবার নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তকে জাতীয় পার্টির স্থানীয় সংসদ সদস্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে মারধর ও কান ধরে উঠবোস করিয়েছেন।

এ এক নতুন আমদানি বাংলাদেশে। কিছু হলেই ধর্ম অবমাননা। শত হাজার বছর ধরে যে ধর্ম সসম্মানে টিকে আছে, মানব জাতির বিশ্বাসের পথ, আশ্রয়ের পথ হয়ে আছে, তা কারও দু-একটি বাক্যেই ভেঙে পড়তে পারে? সত্য-মিথ্যার বালাই নেই। যাচাই নেই। আগে মারো কাটো, তারপর সত্য যাচাই করো। এ কেমন বাংলাদেশ!

প্রধান শিক্ষকের অভিযোগ, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির দ্বন্দ্বের জেরে পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। আর সংসদ সদস্যের বক্তব্য, থানার বিপুলসংখ্যক পুলিশ, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও ঘটনাস্থলে গিয়ে উত্তেজিত লোকজনকে শান্ত করতে ব্যর্থ হলে, তিনি জনতার রোষ থেকে প্রধান শিক্ষককে প্রাণে রক্ষা করেছেন। পুলিশ হেফাজতে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন।

আমার প্রশ্ন, বিপুলসংখ্যক পুলিশ যেখানে ছিল সেখানে মারধরের ঘটনা কেমন করে ঘটে? আমাদের পুলিশ বাহিনী কি এখনো বাংলা সিনেমার শেষ দৃশ্যের মতো ঘটনাস্থলে শুধু আসামি গ্রেফতারের ভূমিকা দেখায়? উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও তারা সবাই কাঠের পুতুলের মতো দণ্ডায়মান থেকে ঘটনাটি ঘটতে দিলেন? নাকি তারাও সমর্থনে হাত মিলিয়েছিলেন? জনরোষ থেকে রক্ষার জন্য কি জন-অপমানের কাণ্ড ঘটাতে হয়, নাকি সত্যিকার জনদরদি হয়ে মানুষকে রক্ষার চেষ্টা হয়?

প্রধান শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আ খ ম নুরুল আলম। তার উপস্থিতিতেই শিক্ষককে কান ধরে উঠবোস করানো হয়। আবার স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন তার নেতৃত্বেই তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

সংশয় জাগে, সুষ্ঠু তদন্ত কি হবে? নাকি আরও একটা ভানুমতির খেল দেখার অপেক্ষায় থাকব আমরা? রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি’। ক্ষমতা, দম্ভ, হিংসা, লোভে আমরা মানব সম্প্রদায় আজ ভ্রমকে রুখতে গিয়ে, সত্য ঢোকার পথই বন্ধ করে দিয়েছি। আমরা ক্রমাগত অন্ধ, পশ্চাত্মুখিতার দিকে যাচ্ছি, সর্বদা একটা ভীতির মধ্যে আছি। হায়! এই বুঝি ধর্ম বা জাত যায়। আমি আজ ন্যায়-অন্যায় জানি না, সত্য-মিথ্যা বুঝি না।  আমি না চাই তর্ক, না চাই যুক্তি। শুধু জানি, এই বাংলাদেশ আমি চাইনি।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও হেড অব কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, নিউজ টোয়েন্টিফোর।

কৃতজ্ঞতা: বাংলাদেশ প্রতিদিন

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত