আমাদের তাসকিন ও অজস্র আগাছা

প্রকাশ | ০১ নভেম্বর ২০১৭, ২৩:৪৯ | আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৮, ২২:০২

তিন বান্ধবী, পাশাপাশি বসে আছি। একজন কৃষ্ণাঙ্গ, অন্য দুজন বাংলাদেশী। সবাই থাকি আমেরিকাতে। কৃষ্ণাঙ্গ বান্ধবীর বাচ্চার বয়স এক। তার সাথে ছবি তুলে বাংলাদেশী বান্ধবীটি তার ফেসবুকে দিলো, বাচ্চার মাকে সেই ছবিতে ট্যাগও দিলো। আমিও পাশে বসা, তাই আমিও ট্যাগ খেলাম।

দুই মিনিটও পার হয়নি। আমার সেই বাংলাদেশী বান্ধবীর এক বাংলাদেশী বন্ধু সেই ছবিতে কমেন্ট করলো, নির্ভুল ইংরেজিতে, "এটা কার সাথে ছবি তুলেছো? এমন জঘন্য দেখতে হয় কোন বাচ্চা আমি জীবনেও দেখি নাই, - ছিঃ!!" আমরা তিনজনই পাশাপাশি বসে আছি, যার ছবি, সে তো কমেন্ট পড়লোই, আমরা দুজন যারা ট্যাগ খাওয়া ছিলাম, আমাদেরও ফোনে নোটিফিকেশন চলে আসলো। হুঁ, ঐ বাচ্চার মা, সে সেই নির্ভুল ইংরেজিটা স্পষ্ট বুঝে ফেললো - তার আদরের ছোট্ট মেয়েটাকে বাংলাদেশের কেউ বলছে পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত দেখতে এক বাচ্চা।

আপনারা এক মুহূর্ত একটু ভেবে দেখুন তো, সেদিন সে মায়ের কেমন লেগেছিলো? ঐ বাচ্চা আমার খুবই আদরের ধন বাচ্চা, কিন্তু আমি তো মা নই, - আমিই সেদিন ভীষণ এক বেদনা আর ক্রোধের মিশ্র অনুভূতি বোধ করেছিলাম, তাহলে চিন্তা করুন তো একবার, সেই মা'টির কথা! আমার সেই বাংলাদেশী বান্ধবীটি প্রচন্ড বিব্রতবোধ তো করেছিলোই, - গালিগালাজ দিয়ে সেই বন্ধুকে তার ফেসবুক থেকে বিদায়ও করেছিলো তৎক্ষণাৎ, কিন্তু 'ক্ষতি' যা হওয়ার ততক্ষণে তো হয়েই গেছে! সেই মা'টি কষ্ট পেয়ে গেছে, সম্পূর্ণ অচেনা একজন তার প্রিয়মুখকে এমন একটা কদর্য কথা শুনিয়ে গেছে!

কিছু আগে বাংলাদেশের প্রিয়মুখ ক্রিকেটার তাসকিনের বিয়ের ছবি দেখলাম। আমার মা বরাবর তাসকিনের মাঝে তার আদরের সন্তান, আমার ছোট ভাইকে খুঁজে পান। আম্মুর কাছে মনে হয় তাসকিনের চেহারা নাকি আমার ছোট ভাইয়ের সাথে মেলে, - তাই যতবার তাসকিন মাঠে নামে, আম্মু আলাদা উৎসাহের সাথে তাসকিনের খেলা দেখে। আমরাও তাই ঘরে আম্মুকে কম ক্ষেপাই না; - কিন্তু সে কারণেও হয়তো, আমাদের বাসায় তাসকিন একটু বেশিই আপন আমাদের কাছে। তার বিয়ের ছবি দেখে আমি খুশিই হয়েছিলাম, দেখে মনে হচ্ছিলো, আহা, ঘরেরই মানুষের বিয়ে - কী খুশির খবর! কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে একটি বিশেষ প্রাণী বাস করে, তাদের দেখতে মানুষের মতো লাগে ঠিকই, কিন্তু কিবোর্ডের ফাঁক দিয়ে যে বিষবাষ্প বার হয় তাদের আঙ্গুল গলে, তাতে করে তাদের আর 'মানুষ' বলে ভাবতে ইচ্ছে করে না।

এই কদর্য প্রাণীগুলো একের পর এক জঘন্য থেকে জঘন্যতর কমেন্ট রেখে যাচ্ছে তার বিয়ের ছবিতে; তার এতো মিষ্টি বধূকে যা তা গালি দিয়ে যাচ্ছে। এটি তাসকিনের অফিশিয়াল পেইজ; আপনারা কি মনে করেন না, তাসকিন বা তার বধূর ইচ্ছে হবে না কখনো তাদের ছবির কমেন্টগুলো পড়তে!? আর তাদের এই 'ফ্যান'গুলোর কমেন্ট পড়ে তাদের বুকে কি কোন ধাক্কা লাগবে না? সেই মিষ্টি বধূটির কি এক ঝলকের জন্যেও মনে হবে না, "সত্যিই কি আমি দেখতে সুন্দর নই? সত্যিই কি আমি অপয়া? আমার কারণে আমার স্বামী অসুখী হবে না তো?" একজন নববধূর জন্য এই ভাবনা কতখানি কষ্টদায়ক একবার কি কল্পনা করে দেখতে পারেন!?

বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের বেলায় এমনটা অহরহ হয়ে আসে, - সাধারণ পেইজগুলোর কথা বাদই দিলাম, এগুলো তো অফিশিয়াল পেইজের কমেন্ট। এই সব জঘন্য প্রাণীদের কদর্য কথার ভার পুরোটাই তাদের; সেই সঙ্গে সময় কি আসেনি এতদিনেও অফিশিয়াল পেইজগুলোতে কমেন্ট মনিটরিং-এর? এই অফিশিয়াল পেইজগুলোর এডমিনদের দায়িত্ব আছে বলে মনে করি, এই কমেন্টগুলোকে ডিলিট করে দেয়া, এবং কমেন্টকারীদের ব্যান করে দেয়া। খেলা নিয়ে সমালোচনা হোক; কিন্তু খেলোয়াড়দের কোন আত্মীয়দের প্রতি যখন এমন অশ্লীল সব মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়া হচ্ছে, এবং সেগুলোকে রাখা হচ্ছে, একজনের কমেন্ট থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আরেকজন আরো বিব্রতকর একেকটি কমেন্ট লিখে যাচ্ছে; - কমেন্ট বাক্স শূন্য পড়ে থাক, তবুও তো দরকার নেই এই সব আগাছাদের লালন করার!!

আমার সেই বান্ধবীর সন্তানের প্রতি ছুঁড়ে দেয়া কদর্য কথাতে আমি তার বান্ধবী হিসেবে যেমন কষ্ট পেয়েছিলাম, সেই বাচ্চা মেয়েটাকে ভালোবাসি বলে কষ্ট পেয়েছিলাম; - তেমনই আমার মাথা হেঁট হয়েছিলো একজন বাংলাদেশী হিসেবে। বাংলাদেশের একজন ছেলে এই ধরণের কথা বলছে, আমি তাকে চিনি না ঠিকই, কিন্তু সে তো আমার দেশেরই মানুষ। আমার বিদেশিনী বান্ধবীর চোখে ঐ মুহূর্তে সেই ছেলেটাই তো 'বাংলাদেশ'; - সেই একই ছেলে হয়তো বাংলাদেশের ক্রিকেট টিম জিতে গেলে দেশের আনন্দে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়, অথচ তার কথার কদর্যতায় দেশমাতার সম্মান ধূলিতে মিশিয়ে দিতে তার এটুকু বাঁধে না! - বাঁধবে কেন? সেই বোধটাই তো তার নেই! সেই কমন সেন্স বা বেসিক ডিসেন্সি বা মানুষের প্রতি সম্মানবোধ, - এইসব অনুভূতিগুলোই তো তার নেই!

নইলে এক বছরের একটি বাচ্চাকে নিয়ে এমন কুৎসিত কথা কোন বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বুঝি বলতে পারে!?

প্রিয় খেলোয়াড়ের নববধূকে অপদস্থ করতে কেবল হৃদয়হীনেরাই পারে; মাঝখান থেকে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে আমাদের মতো হতবাক কারো কারো।

রনিয়া রহিম এর ফেসবুক থেকে