প্রতিরোধের মার্চ

১৯৭১ এর উত্তাল ১৩ মার্চ

প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০১৭, ১৩:০৫

জাগরণীয়া ডেস্ক

পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রধান লে. জেনারেল টিক্কা খান একাত্তরের ১৩ মার্চ এক সামরিক ফরমান জারি করেন। এই সামরিক ফরমানে তিনি বলেন, ‘প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে যারা বেতন উত্তোলন করেন, তারা ১৫ মার্চের মধ্যে কর্মস্থলে যোগ না দিলে সবাইকে চাকরিচ্যুত করা হবে। শুধু তাই নয়, সামরিক আইনের বিচারে এসব আইন অমান্যকারীকে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হবে।’ টিক্কা খানের এ আদেশের পরও কর্মস্থলে যোগ দেননি কোনো বাঙালি সেনা কর্মকর্তা। স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর অকুতোভয় বাঙালি পাকিস্তান সামরিক সরকারের কোনো আদেশ-নির্দেশের প্রতিই কর্ণপাত করেননি। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেনারেল টিক্কা খানের সামরিক ফরমানকে উস্কানিমূলক আখ্যায়িত করে বলেন, ‘কোনো শক্তিই বাংলার জনগণের ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারবে না। পাকিস্তানের সামরিক সরকারের হুমকি-ধমকি বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনকেও ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।’ জেনারেল টিক্কার এ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিক্ষুব্ধ সমগ্র জাতি প্রতিবাদ ও ক্ষোভে আরও ফুঁসে ওঠে। সর্বত্র অহিংস অসহযোগ আন্দোলন আরও বেগবান হতে থাকে। ধীরে ধীরে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন রূপ নিতে থাকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিকে।

স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যেসব জেলা ও থানায় তখনও গঠন হয়নি, অতি অল্প সময়ের মধ্যে সেসব স্থানে কমিটি গঠনের জন্য তাগিদ পাঠানো হয়। অসহযোগ আন্দোলন তখন এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত যে, কেউ আর পাকিস্তান সরকারের আদেশ-নির্দেশের পরোয়া করছে না। পূর্ব পাকিস্তান তথা গোটা বাংলাদেশে তখন নেতা একজনই। তিনিই দেশ, তিনিই সরকার।

এদিকে বঙ্গবন্ধু তার ৩২ নাম্বারের বাসভবনে শীর্ষস্থানীয় চার ছাত্রনেতা শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে ডেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু কলকাতার ভবানীপুরের নর্দার্ন পার্কের ২১ রাজেন্দ্র রোডের একটি বাসার ঠিকানা দিয়ে বলেন যে, প্রবাস থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য এটিই হবে মূল কেন্দ্র। 

তিনি জানান, সংসদ সদস্য ডা. আবু হেনাকে কলকাতা পাঠিয়ে তিনি এই বাসাসহ সবকিছু ঠিকঠাক করিয়ে রেখেছেন। সেখানে সংসদ সদস্য চিত্ত সুতার সবাইকে অভ্যর্থনা জানানোসহ ওই দেশের সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করবেন। পরবর্তীতে কলকাতার ওই বাসাতে গিয়েই প্রথমে উঠেছিলেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকসহ শীর্ষ পর্যায়ের সব নেতা।

দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ, তোফায়েল আহমেদ, আসম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী ও শাজাহান সিরাজ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা রাশেদ খান মেনন, বেগম মতিয়া চৌধুরী, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও নুরুল ইসলাম নাহিদসহ আরও অনেকের সঙ্গেই বৈঠক করে পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন। আন্দোলনরত নেতারা গোপনে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য শেখ ফজলুল হক মনিও তার অনুগতদের নিয়ে কৌশল নির্ধারণ করে নির্দেশ প্রদান করেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ দলের সর্বস্তরের নেতা এবং ১৭ জেলার নেতাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে প্রয়োজনীয় আদেশ-নির্দেশ দিতে থাকেন। ভেতরে ভেতরে চলতে থাকে বাঙালি সামরিক অফিসারদের তালিকা প্রণয়নের কাজ। কে কোথায় আছেন ও তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার বার্তা কীভাবে এবং কার মাধ্যমে পৌঁছানো যায় সে বিষয়টিও নির্ধারণ করেন কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতারা।

আজকের দিনে কেন্দ্রীয় নেতারা বহির্বিশ্বের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত অবস্থান তুলে ধরে বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনে তাদের সমর্থন দানের আবেদন জানান এবং পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধেরও আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা অত্যন্ত সংগোপনে বহির্বিশ্বের কাছে এ বার্তা প্রেরণ করেন। চট্টগ্রাম, রাজেন্দ্রপুর, কুমিল্লাসহ দেশের অন্যান্য সেনানিবাসে কৌশলে বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের নিরস্ত্র করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। অবস্থা টের পেয়ে বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে গোপনে ও কৌশলে আলোচনা করে প্রতিআক্রমণের প্রস্তুতিও গ্রহণ করেন। বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকরা গোপনে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সময় ও সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকেন। 

চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরই বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি শুরু করেন। আজকের দিনে তদানীন্তন ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম (সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বীরউত্তম) ষোলশহর এলাকা থেকে তার সৈন্য বাহিনীসহ বের হয়ে এসে বহু পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিককে আটক করে প্রতিরোধ আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তিনি স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতারা এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত প্রায় সব বাঙালি অফিসারের সঙ্গে অত্যন্ত গোপনে ও সুকৌশলে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে সহযোদ্ধাদের নিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। 

তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ক্যাপ্টেন রফিক এসব বিষয় নিয়ে শলাপরামর্শ করলেও শুরুতে মেজর জিয়া ছিলেন অনেকটাই নির্লিপ্ত। তিনি তখনও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। এই চট্টগ্রাম বন্দরেই করাচি থেকে এসে ভিড়েছিল অস্ত্র ও গোলাবারুদ-ভর্তি সামরিক জাহাজ ‘সোয়াত’। এ সময় চট্টগ্রামে কর্মরত বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ, ক্যাপ্টেন শমসের মবিন চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেও ইপিআরের অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রফিকই প্রথম চট্টগ্রামে প্রকাশ্যে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত