৭ বছর পেরিয়ে মিরসরাই ট্র্যাজেডি

প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০১৮, ১২:৩৫

জাগরণীয়া ডেস্ক

১১ জুলাই মিরসরাই ট্র্যাজেডির ৭ম বার্ষিকী। ২০১১ সালের এ দিনটি মিরসরাইবাসীর কাছে ছিল অত্যান্ত বেদনাদায়ক। সারা জীবন এ দিনটিকে ভুলতে পারবে না মিরসরাইবাসী। কারণ ১১ জুলাই ঘটে যায় বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা মিরসরাই ট্র্যাজেডি। শুধু মিরসরাইয়ের আলোচিত ঘটনা নয়, এটি দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বেরও একটি আলোচিত ঘটনায় পরিণত হয়।

আলোচিত ঘটনা হবেই না বা কেন? একসাথে অকালেই ঝরে যায় ৪৫ টি তাজা প্রাণ। ট্র্যাজেডি। যে শব্দটি শুনলে আঁতকে উঠে এই জনপদের মানুষসহ দেশও বিশ্ববাসী। শব্দটির সাথে যারা ওতোপোতভাবে জড়িত তারা শব্দটি শুনলে অবিরাম কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। এই জনপদের বিভীষিকাময়, বিষাদময় একটি অধ্যায়ের নাম মিরসরাই ট্র্যাজেডি। পিতার কাঁধে ছিল পুত্রের লাশ, যা একজন পিতার জন্য সবচেয়ে ভারী বস্তু। ছিল মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর গগণবিদারী আর্তনাদ।

২০১১ সালের এই দিন কেঁদেছে সবাই, কান্না ছাড়া থাকতে পারেনি কেউ। গ্রামের পর গ্রাম পরিণত হয়েছে কবরের নগরীতে। কেউ কাউকে সান্তনা দেওয়ার লোকও ছিলনা সে সময়। একটা সময় স্বজনহারাদের সান্তনা দিতে ছুটে এসেছেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রীসহ দেশ বিদেশের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। স্বজনহারা পরিবারগুলোর সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিতে দলমত, জাতি-গোত্র নির্বিশেষে ছুটে এসেছেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।

নিহতদের স্মরণে স্থাপন করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’ ও ‘অন্তিম’: 
নিহত ছাত্রদের স্মরণে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রবেশ মুখে স্থাপন করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’ আর দুর্ঘটনাস্থলে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘অন্তিম’। নিহতদের মধ্যে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র বেশি হওয়ায় তাদের স্মৃতি রক্ষায় বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ২০১২ সালে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’। সে সময়ের শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার নিজস্ব অর্থায়নে এটি নির্মাণ করা হয়। দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রদের সিংহভাগই আবুতোরাব বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের। স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’ এ নিহতদের ছবি সংবলিত বিশেষ টাইলস স্থাপন করা হয়েছে। স্থাপনা শিল্পটিও যেহেতু সেই বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নির্মাণ হবে- তাই শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং সাধারণ জনগণের অনুভূতি আর আবেগের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এর নামকরণ করা হয়েছে ‘আবেগ’।

আর স্মৃতিস্তম্ভ ‘অন্তিম’ নির্মাণ করা হয়েছে, বৃত্তাকার বেদির ওপর স্থাপিত মূল স্তম্ভটির (অষ্টভুজ) উচ্চতা ২০ ফুট, তার চূড়ায় শিখা দুই দশমিক পাঁচ ফুট, তিন ধাপ বেদি দুই দশমিক পাঁচ ফুট এবং ভূমি থেকে সর্বমোট উচ্চতা ২৫ ফুট। মূল স্তম্ভকে ঘিরে এক থেকে পর্যায়ক্রমে সাত ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট সাতটি আয়তাকার পিলার সামনে থেকে একপাশ দিয়ে চলে গেছে। সপ্তম পিলারের ওপর থেকে উপ-বৃত্তাকার উড়াল পথে ছয় ধাপের একটি সিঁড়ি মূল স্তম্ভের মাঝামাঝি গিয়ে লেগেছে। ৫ নম্বর পিলারের ওপর থেকে একটি ভাঙা প্লেট মূল স্তম্ভের গায়ে হেলে আছে। মূল স্তম্ভের পাশে একটি আয়তাকার পিলার আছে যেটিতে নিহতদের নামের তালিকা লেখা রয়েছে। এর উচ্চতা পাঁচ ফুট। বৃত্তাকার মূল বেদির তিনটি ধাপ রয়েছে। এগুলোর উচ্চতা যথাক্রমে ১১ দশমিক পাঁচ ফুট, ১৪ ফুট ও ২০ ফুট। তৃতীয় ধাপটির মাঝে বৃত্তাকার জলাধার রয়েছে। তৃতীয় বৃত্তাকার ধাপ থেকে তিন ধাপের সিঁড়ি নেমে আসে সংযোগ সড়কে। দুর্ঘটনাটি যেহেতু অপরিসর একটি জলাশয়ে সংঘটিত হয়েছে, আর পানিতে কিছু নিক্ষিপ্ত হলে বৃত্তাকার ঢেউয়ে স্পন্দিত হয়, এ কারণে স্থাপনা কাঠামোটির নান্দনিক বিচারে বৃত্তাকার আবহ তৈরি করে। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের অর্থায়নে দুর্ঘটনাস্থলে নির্মাণ করা হয় ‘অন্তিম’। স্মৃতিস্তম্ভ দুইটির নকশা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ সাইফুল কবীর।

সেদিন যা ঘটেছিল :
১১ জুলাই ২০১১, সোমবার মিরসরাই সদরের স্টেডিয়াম থেকে বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল ফাইনাল খেলা শেষে একটি মিনিট্রাকে করে বিজয়ী এবং বিজিত উভয় দলের খেলোয়াড় ও সমর্থকরা আবুতোরাব এলাকায় ফিরছিল। বড়তাকিয়া-আবুতোরাব সড়কের পশ্চিম সৈদালী এলাকায় তেতুলতলা নামক স্থানে ৬০-৭০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ডোবায় উল্টে যায় মিনি-ট্রাকটি। ডোবার জল থেকে একে একে উঠে আসে লাশ আর লাশ। পরে সে লাশের রথ গিয়ে থামে পঁয়তাল্লিশে গিয়ে। অপরদিকে ছেলের মৃত্যু হয়েছে ভেবে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেলেন এক বাবা হরনাথ। সর্বশেষ ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর রাত ৯টায় নয়নশীলের প্রয়ান পর্যন্ত ৪৫টি মৃত্যু গুনতে হয়। সব মিলিয়ে ৪৫ জনের প্রাণের বিনিময়ে রচিত হয় মিরসরাই ট্র্যাজেডি। এর মধ্যে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩৪ জন, প্রাইমারি স্কুলের ৪ জন, আবুতোরাব ফাজিল মাদ্রাসার ২ জন, প্রফেসর কামালউদ্দিন চৌধুরী কলেজের ২ জন, একজন অভিভাবক ও দুজন ফুটবলপ্রেমী মারা যায়। মুহুর্তেই পুরো এলাকা নয়, পুরো মিরসরাই নয়, সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। ঘোষণা করা হয় তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক।

৪৫ জনের মৃত্যুর ঘটনায় ৮ ডিসেম্বর চালক মো. মফিজুর রহমান ওরফে মফিজ উদ্দিনকে দুটি ধারায় মোট ৫ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। ২০১৫ সালের ২৮ জুলাই সাজা শেষে জেল থেকে ছাড়া পান চালক মফিজ।

নিহতদের স্মরণে কর্মসূচি :
নিহত শিশু–কিশোরদের স্মরণ করতে প্রতিবারের মত এবারও আবু তোরাব বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দিনব্যাপী কর্মসূচি রেখেছে। 

মিরসরাইয়ের আবুতোরাব বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মর্জিনা আক্তার জানান, শোকের সাত বছর পার করে আজ আমরা আমাদের সন্তানদের হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্ত পালনের দিনক্ষণে দাঁড়িয়ে। তবে এটি আমাদের শোক আর পরিতাপের।

দিনের কর্মসূচি সম্পর্কে তিনি জানান, ১১ জুলাই (বুধবার) (১১ জুলাই) সকাল ৮টা থেকে কোরআনখানি ও দোয়া মাহফিলের মধ্য দিয়ে দিনের কর্মসূচি শুরু হয়েছে। সকাল ৯টায় স্কুলের সকল শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা কালো ব্যাজ ধারণ করবে। সাড়ে ৯টায় শুরু হবে শোক র‌্যালি। র‌্যালি শেষে প্রথমে দুর্ঘটনাস্থলে নির্মিত স্মৃতিফলক ‘অন্তিম’ এ শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করবে। এরপর স্কুল অভিমুখে নির্মিত স্মৃতিফলক ‘আবেগ’ এ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, স্বজন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও সর্বস্তরের মানুষ। সবশেষে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হবে স্মরণসভা। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত