হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতা

প্রকাশ | ১৩ মে ২০১৮, ০১:১১

মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী

১৯২২-২৩ সাল নাগাদ ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদ স্যার জন মার্শালের ভারতীয় সহকারী রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অধুনা পাকিস্তানের সিন্ধুপ্রদেশের লারকানা জেলার মহেঞ্জোদাড়ো এলাকায় বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতাটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। তার কিছুদিন আগেই মহেঞ্জোদাড়োর কয়েকশো মাইল উত্তরে অধুনা পাকিস্তানেরই পাঞ্জাব প্রদেশের মন্টগোমারি জেলার হরপ্পায় একটি প্রাচীন শহরের চার-পাঁচটি স্তরবিশিষ্ট ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছিল।

এরপর অধুনা ভারতের রাজস্থানের কালিবঙ্গান, চণ্ডীগড়ের কাছে রুপার, গুজরাতের আমেদাবাদের কাছে লোথাল, গুজরাতেরই কচ্ছ জেলার ধোলাবীরা, হরিয়ানার হিসার জেলার বনোয়ালিতে এবং অধুনা পাকিস্তানের সিন্ধুপ্রদেশের কোট দিজি ও চানহুদাড়ো এবং পাকিস্তান-ইরান সীমান্তের কাছে বালুচিস্তান প্রদেশের সুতকাজেন-ডোরেও অনুরূপ শহরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্ত্বিকরা মনে করেন, এই সব শহর একটি স্বতন্ত্র সভ্যতার অন্তর্গত ছিল।

এই সভ্যতাই সিন্ধু সভ্যতা, মেসোপটেমিয়ান সাহিত্যে সম্ভবত যার নাম মেলুহা। ঐতিহাসিকেরা একে সিন্ধু-ঘগ্গর-হাকরা সভ্যতা বা সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতাও বলে থাকেন। এই সভ্যতা ছিল তাম্র-ব্রোঞ্জ (ক্যালকোলিথিক) যুগের সভ্যতা; কারণ, লোহার ব্যবহার এই অঞ্চলের অধিবাসীদের অজ্ঞাতই ছিল। এই সভ্যতার সামগ্রিক সময়কাল ধরা হয় ৫৫০০-১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।

ঠিক কোন সময় এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তা জানা যায় না। ১৯৬৮ সালে স্যার মর্টিমার হুইলার বলেছিলেন, সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা মেসোপটেমিয়া অঞ্চল থেকে এখানে এসেছিলেন। এখানকার স্থানীয়দের সভ্যতার সঙ্গে তাদের সভ্যতার কোনো মিল ছিল না। যদিও পরবর্তীকালের গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে এখানকার স্থানীয় সভ্যতাই বিবর্তনের মাধ্যমে সিন্ধু সভ্যতায় পরিণত হয়।

বোলান গিরিপথের কাছে অধুনা মেহেরগড় নামে এক অঞ্চল থেকে কৃষিজীবী সম্প্রদায় প্রথম সিন্ধু উপত্যকায় এসে বসতি স্থাপন করে। সিন্ধু উপত্যকা ছিল উর্বর সমভূমি। তাই চাষাবাদও হল ভাল। ধীরে ধীরে তারা শিখে নিল বন্যা-নিয়ন্ত্রণের কৌশলও। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম সহস্রাব্দেই এখানকার মানুষ গম ও যব চাষ এবং ভেড়া ও ছাগল প্রতিপালন শুরু করে দিয়েছিল। তারপর জনসংখ্যা যত বাড়ল, তত গড়ে উঠতে লাগল নতুন নতুন লোকবসতি। কোয়েটা উপত্যকায় ডাম্ব-সদাল প্রত্নক্ষেত্রে ইঁটের দেওয়াল-বিশিষ্ট একটি স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। এটির নির্মাণকাল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের সূচনালগ্ন।

এখানে যেসব ছবি-আঁকা মাটির হাঁড়ি পাওয়া গেছে, তেমন হাঁড়ি পাওয়া গিয়েছে সমসাময়িককালে আফগানিস্তানে গড়ে ওঠা বসতিগুলির ধ্বংসাবশেষেও। তাছাড়া ডাম্ব-সদালের মাটির সিলমোহর ও তামার জিনিসপত্রও ব্যবহার করত। পশ্চিম সিন্ধু সমভূমিতে রেহমান ধেরি নামে এক জায়গায় সিন্ধু সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে গড়ে ওঠা একটি শহরের ধ্বংসস্তুপ পাওয়া গেছে। এই সব প্রত্নক্ষেত্রগুলিই প্রমাণ যে, সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে পারস্য উপসাগরীয় শহরগুলির এবং মধ্য এশিয়ার যোগাযোগ ছিল।

প্রাক্-হরপ্পা থেকে পূর্ণ-হরপ্পা (mature Harappan) সভ্যতায় রূপান্তরণের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন আমরি। দক্ষিণ-পূর্ব বালুচিস্তানের এই জায়গায় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের সূচনাকালে একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র গড়ে উঠেছিল। এখানকার অধিবাসীরা পাথর বা কাদামাটি দিয়ে তৈরি ইটের বাড়িতে বাস করত। এক ধরনের শস্যাগারও গড়ে তুলেছিল তারা। এখানকার পাতলা মাটির পাত্রে কুঁজওয়ালা ষাঁড়ের ছবি দেখতে পাওয়া যায়। বেশ কয়েক ধাপ বিবর্তনের পর এই সভ্যতাই শেষে যাকে আমরা হরপ্পা সভ্যতা বলে থাকি, সেই সভ্যতা গড়ে তোলে।

ভৌগোলিক বিস্তারের দিক থেকে বিচার করলে সিন্ধু সভ্যতা ছিল প্রাচীন পৃথিবীর বৃহত্তম সভ্যতা। এখন একথা প্রমাণিত যে, সিন্ধু সভ্যতা কেবল সিন্ধু উপত্যকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ঐতিহাসিকেরা যদিও হরপ্পা-ঘগ্গর-কালিবঙ্গান-মহেঞ্জোদাড়ো অঞ্চলটিকেই এই সভ্যতার কেন্দ্রস্থল মনে করেন; কারণ, হরপ্পার প্রধান বসতিগুলি এই অঞ্চলেই পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু সভ্যতার সামগ্রিক বিস্তার ছিল গোটা সিন্ধুপ্রদেশ, বালুচিস্তান, প্রায় সমগ্র পাঞ্জাব অঞ্চল, উত্তর রাজস্থান, জম্মু ও কাশ্মীর এবং গুজরাতের কাঠিয়াওয়াড় ও সৌরাষ্ট্র অঞ্চল জুড়ে। মনে রাখা দরকার, সেই সময় সিন্ধুপ্রদেশ ও রাজস্থানে আজকের মতো মরুভূমি ছিল না; উত্তর-পশ্চিম ভারতের আবহাওয়াও ছিল যথেষ্ট আর্দ্র।

এই সুবিস্তীর্ণ অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছে প্রায় ১৪০০টি বসতির হদিস। উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ১৪০০ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ এই সভ্যতার পশ্চিম সীমা ছিল বালুচিস্তানের সুতকাজেন-ডোর, পূর্ব সীমা ছিল উত্তরপ্রদেশের মিরাট জেলার আলমগীরপুর, দক্ষিণ সীমা ছিল মহারাষ্ট্রের আহমদনগর জেলার দাইমাবাদ এবং উত্তর সীমা ছিল জম্মু ও কাশ্মীরের আখনুর জেলার মান্দা পর্যন্ত।

সিন্ধু ও সরস্বতী নদীর উপত্যকায় সিন্ধু সভ্যতার বসতি অঞ্চলগুলি প্রায় ১২,৫০,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে। অর্থাৎ, প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার থেকে ভৌগোলিক আয়তনের বিচারে এই সভ্যতা ছিল ২০ গুণ এবং প্রাচীন মিশর ও মেসোপটেমিয়া সভ্যতার মিলিত এলাকার তুলনায় ছিল ১২ গুণ বড়ো।

হরপ্পা সভ্যতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এর নগর পরিকল্পনা। হরপ্পার বসতি অঞ্চল গঠিত ছিল ছোটো ছোটো শহর নিয়ে। হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়ো, লোথাল ও সুতকাজেন-ডোর শহরগুলি ছিল একই পরিকল্পনাধীনে নির্মিত। নগর পরিকল্পনা ও নির্মাণে যথেষ্ট আধুনিক ছিল হরপ্পার মানুষ। শহরগুলি ছিল আয়তাকার। প্রতিটি শহরের পশ্চিমভাগে একটি উঁচু এলাকায় ছিল দুর্গ। এটি সম্ভবত ছিল সমাজের উচ্চশ্রেণীর মানুষের আবাসস্থল। প্রাচীরঘেরা এই সব দুর্গের মধ্যেই থাকত প্রশাসনিক ও ধর্মীয় ভবনগুলি। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োর দুর্গ ছিল ইঁটের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। কালিবঙ্গানে দুর্গ ও শহর দুটিই ছিল পাঁচিলঘেরা। দুর্গের নিচে ছিল শহরের মূল এলাকা। এটি ছিল সাধারণ মানুষের আবাসস্থল। এই অংশ দাবার বোর্ডের মতো ওয়ার্ডে বিভক্ত ছিল।

প্রতিটি শহরেই শহরের মূল রাস্তাটি উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত দেখা যায়। অন্যান্য রাস্তাগুলি প্রধান রাস্তার সঙ্গে সমকোণে প্রসারিত। বাড়িগুলি রাস্তার দুই ধারে অবস্থিত ছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োয় দেখা যায় আগুনে পোড়ানো ইটের বাড়ি। লোথাল ও কালিবঙ্গানে দেখা যায় রোদে পোড়ানো ইটের বাড়ি। প্রতিটি বাড়িতে রান্নাঘর ও স্নানাগার ছাড়াও চার থেকে ছয়টি কক্ষ থাকত।

বড় বড় বাড়িতে তিরিশটি কামরাও দেখা গিয়েছে। বড় বাড়িতে কামরাগুলি থাকত একটি বর্গাকার উঠোনের চার পাশে। এই সব বাড়িতে সিঁড়ির উপস্থিতি দেখে মনে হয়, এগুলি দুই থেকে তিন তলা পর্যন্ত উঁচু হত। অনেক বাড়িতেই আলাদা কুয়ো ও নিকাশি নালা থাকত। নালার মাধ্যমে বর্জ্য বড় রাস্তার নর্দমায় গিয়ে পড়ত। কুয়ো-যুক্ত গণস্নানাগারও পাওয়া গিয়েছে। বড় রাস্তার নর্দমাগুলি মাটির তৈরি সকপিট ও ম্যানহোল দিয়ে ঢাকা থাকত। রাস্তায় আলোর ব্যবস্থাও থাকত।

সমাধিক্ষেত্রগুলি সাধারণত শহরের বাইরে অবস্থান করত। হরপ্পা সভ্যতার উন্নত নগর পরিকল্পনা দেখে মনে করা হয় পুরসভা-জাতীয় কোনো সংস্থা নাগরিক পরিষেবা প্রদানের কাজে নিযুক্ত ছিল। নগরের আকার ছিল সামন্তরিক (প্যারালেলোগ্রামিক)। প্রামাণ্য আকারের পোড়া ও কাঁচা ইটের সহাবস্থান থেকে বোঝা যায় ইট শিল্প এখানকার একটি বড় শিল্প ছিল।

মহেঞ্জোদাড়োর দুর্গ এলাকায় ‘মহাস্নানাগার’ সবচেয়ে আশ্চর্য স্থাপনা। সম্ভবত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো গণ-অনুষ্ঠানের জন্য এই মহাস্নানাগার ব্যবহৃত হত। এর পশ্চিমে রয়েছে একটি বিশাল শস্যগোলা। হরপ্পায় দুটি সারিতে মোট ছটি শস্যগোলার সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে একটি কেন্দ্রীয় পথও রয়েছে। মহেঞ্জোদাড়োয় মহাস্নানাগারের পাশেই আরও একটি অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এটি সম্ভবত কোনো উচ্চ পদাধিকারীর বাসভবন ছিল। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হল সভাকক্ষ। অন্যদিকে লোথাল ও কালিবঙ্গানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হল অগ্নিবেদি।

বাসস্থানের আকার আয় ও পেশা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন ছিল। মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পায় যে দুই কামরা-বিশিষ্ট সারিবদ্ধ বাড়ি পাওয়া গেছে সেখানে সম্ভবত গরিব মানুষেরা থাকত। বড়ো বড়ো বাড়িগুলি ছিল ধনীদের। বাড়ি, রাস্তা, নর্দমা সবই ইট দিয়েই তৈরি করা হত। পাথরের ব্যবহার ছিল না বললেই হয়। ইটের তৈরি বাড়িঘর জিপসাম দিয়ে জলনিরোধক করা হত।

মনে রাখতে হবে, হরপ্পা সভ্যতার শহরগুলি ছিল হয় বন্যাপ্রবণ নদী উপত্যকায়, নয় মরুভূমির প্রান্তে, নয়ত বা সমুদ্রের ধারে। অর্থাৎ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে এখানকার অধিবাসীরা ভাল রকম পরিচিত ছিলেন। এই জন্যই হয়ত নগর পরিকল্পনা ও জনজীবনের প্রণালীতে কিছু বৈচিত্র্য দেখা যেত।

লেখক: লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা​