চৈত্র সংক্রান্তি: বাঙালি শেকড়ের জীবনদর্শন
প্রকাশ | ১৪ এপ্রিল ২০১৮, ১৩:২৭ | আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৮, ১৪:১০
পৌরাণিক সূত্রে জানা যায় রাজা/প্রজাপতির দক্ষের সাতাশজন কন্যার চন্দ্রদেবের সাথে বিয়ে হয় তাদেরই একজন চিত্রার নামানুসারে চিত্রানক্ষত্রা এবং চিত্রানক্ষত্র থেকে চৈত্র মাসের নামকরণ করা হয়। চৈত্র মাসের শেষ দিনটিকে বাঙালি চৈত্র সংক্রান্তি হিসেবে উদযাপন করে। এক অর্থে সংক্রান্তি এর ধারণাটি এমন যে কালের আবর্তে অসীমের মাঝে সাঁতরে সূর্য এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে (মীন প্রতীকের মধ্যে প্রবেশ করে) গমন করে, ছুটে চলে সময়, দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর, অবিরাম চলে ক্রান্তির সঞ্চার। অর্থাৎ এক ক্রান্তি বা এক প্রন্ত বা কিনারা থেকে আরেক প্রান্ত বা কিনারায় যাওয়া। এ দিনকে সূর্য সংক্রান্তিও বলা হয়।
তবে অনেকবেশি ভাববাদী এই চিন্তার পাশাপাশি বছরের শেষ মাস হিসেবে চৈএ’র যাত্রা অনেকাংশে সম্রাট আকবর সুবে বাংলা প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশে ফসল কাটার সময়কে মাথায় রেখে খাজনা আদায়ের বস্তুবাদী (Cultural Materialism) চিন্তার সাথে জড়িত বলে অনেকে মনে করেন। কৃষিভিত্তিক সমাজে জীবনাচরণে মার্ক্স এর ‘ভিত্তি’ ও ‘উপরিকাঠামোর’ মতই কৃষি অর্থনতির সাথে সাথে এগিয়ে চলে গ্রাম বাংলার সংস্কৃতি। চৈত্রের কাঠফাটা রোদ পার করে আসন্ন দিনে দু’বেলা ভাত আর মাটির ঘরের চালে কয়েক আঁটি খড় তুলে দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকে কৃষক। আর তাই ধর্ম যাই হোক কৃষক তার স্বপ্ন পূরণে মেতে উঠে উৎসবে।
জেমস ফ্রেজার এর Law of Similarity এর মত করেই শিবের গাজন তাই খুব চেনা একটি উৎসব। যেখানে কলাগাছের কাণ্ডের অংশ কেটে মাটিতে পুঁতে তার ওপর কিছু কাদামাটি দিয়ে তারপর একটা লাল সরা বসানো হয়। সেই সরায় কালো পাথরের ছোট্ট শিবলিঙ্গ রেখে জল দুধে ডুবিয়ে রাখা হয়। কৃষক ভাবে সূর্য বা শিব কে এইভাবে জলে ডুবিয়ে রাখলে খেত-ও এইভাবে জলে ডুবে থাকবে অর্থাৎ যথেষ্ট বৃষ্টি হবে এবং বেশি ফসল উৎপন্ন হবে।
প্রচণ্ড দাবদাহে উদ্বিগ্ন কৃষককূল নিজেদের বাঁচার তাগিদে বৃষ্টির দ্রুত আগমনের জন্য প্রার্থনা করতে থাকে – ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে’ বলে। প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি গান করে নগদ টাকা বা চাল সংগ্রহ করে বড় গাছের নিচে শিরনি রান্না করে গ্রামের মানুষের মধ্যে বিতরণ করার প্রচলন ছিল একসময়। শিরনি খাওয়ার লোভ নয় বরং এর মূল সুর আসলে গাজনের সুরের সাথেই বাঁধা। শিবতলা থেকে শোভাযাত্রা বের করে নন্দি, ভৃঙ্গী, ভূত-প্রেত, দৈত্যদানব ইত্যিাদি সেজে হর-পার্বতী বা শিব-দুর্গার সঙ্গে নেচে দুজন লোক দেবতা শিবের সন্তুষ্টিতে বিভিন্ন ধরনের লৌকিক গান গেয়ে গ্রামময় ঘুরে বেড়ায়। কৃষির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত গ্রাম-সংস্কৃতির রোদ ও বৃষ্টির এই কৃত্যানুষ্ঠান ও উৎসব এক সময়ে রূপ নিয়েছে মেলায়। এই উৎসব আসলে একধরনের সহাবস্থানের কথা বলে। এমনকি এটিকে আর্য দূর্গা আর অনার্য শিব এর মিলনের মধ্য দিয়ে শ্রেণী বিলুপ্তির উৎসবও বলা যেতে পারে।
অনার্য আর গ্রাম্য হবার কারণে হয়তো শিবের মূর্তি না গড়ে পাথরকেই প্রতীক ধরে শিবকে মূলত নিম্নবর্গীয় (বাগদি, কৈবর্ত, হাড়ি, ডোম, মালাকর, শব্দকর, জেলে-মালো ইত্যাদি) মানুষই পূজা করতো। কিন্তু নিম্নবর্গীয় মানুষ হঠাৎ শিবকে নিয়ে এত উদ্বিগ্ন কেন? বৈদিক যাগযজ্ঞে ঋষি ব্রাহ্মণেরা ছিলেন উচ্চবর্গীয় যাদের বেদ জ্ঞান ছিল আর বেদকে অনেকে জ্ঞান মনে করেন সে অর্থে জ্ঞানের আওতার বাইরে রয়ে যায় নিম্নবর্গীয় মানুষ। এটাই ছিল এক সময় সামাজিক প্রথা।
ব্রাত্যস্তোমের (একধরণের শুদ্ধিযজ্ঞ) মতোই গাজনেও নিম্নবর্গীয় ও ব্রাহ্মণ সবাই উপবীত বা উত্তরীয় গ্রহণের মধ্য দিয়ে সমান হয়। ১৩১২ সালে প্রকাশিত শ্রী দীনেন্দ্রকুমার রায়ের পল্লীবৈচিত্র্য বইয়ে এরকম বর্ণনা আছে যে পূজারিদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজন সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত হয়ে চড়ক পূজা পর্যন্ত তারা পবিত্রতার সঙ্গে সন্যাসব্রত পালন করে ও আমিষ জাতীয় খাবার গ্রহণ করে না। দেবতার পূজা-অর্চনা শেষে সন্যাসীদের পিঠে লোহার বড়শি গেঁথে রশিতে বেঁধে চড়ক গাছে ঝুলিয়ে ঘোরানো হয়। হয়তো আমরা পূজার উৎসবে এই ধরণের দৈহিক যন্ত্রণা দিয়ে অনুধাবন করতে চাই এই ধরণী ফুল শয্যা নয়। বরং সুখ এর পাশাপাশি আছে দুঃখও। আর সুখের সঙ্গে দুঃখকে যে যত সহজভাবে গ্রহণ করবে সেই জীবন সংগ্রামে জয়ীর মাল্য গলায় নিবে।
তবে প্রশ্ন আসতে পারে এইরকম দার্শনিক চিন্তা চড়ক পুজোর সাথে কিভাবে সম্পৃক্ত হল? বৌদ্ধধর্মের প্রভাব যখন ম্লান হয়ে এসেছে তখন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। তেমনই কয়েক জন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী আশ্রয় নিয়েছিলেন বাংলায় এবং পরে তাঁরা হিন্দুত্ব গ্রহণ করেন। ফলে হিন্দু ধর্মে মিশে যায় কিছু বৌদ্ধ তন্ত্র মন্ত্রের সাধন। ধারণা করা হয় এই তান্ত্রিক ক্রিয়া থেকেই পরবর্তী কালে উদ্ভব চড়ক পুজোর। চড়ক পুজোয় যোগদানকারী সন্ন্যাসীরা তান্ত্রিক সাধনা অভ্যাসের ফলে নিজেদের শারীরিক কষ্টবোধের ঊর্ধ্বে উঠে চড়কের মেলায় নানা রকম শারীরিক কষ্ট স্বীকার করেন।
‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে গবেষক বিনয় ঘোষ লিখেছেন ফ্যানির অভিজ্ঞতার টইটম্বুর ভ্রমণ বৃত্তান্ততে (১৮২২-১৮২৮) কালীঘাটে চড়ক উৎসবে গাজন সন্ন্যাসীদের যন্ত্রণাদায়ক ইতিবৃত্ত। ১৮৬৩-১৮৬৫ সালে ছোটলাট বিডন এই প্রথা রোধ করার জন্য বলল। কিন্তু শত শত বছর ধরে বাংলায় যে সংস্কৃতি পালিত হয়ে আসছে সেটি তো আর এক আদেশেই বন্ধ হয়ে যাবার নয়।পুরনো খনার বচনেও এই চৈত্র মাসের জীবনাচরণের বর্ণনা পাওয়া যায়।
চৈতে গিমা তিতা,
বৈশাখে নালিতা মিঠা,
জ্যৈষ্ঠে অমৃতফল আষাঢ়ে খৈ,
শায়নে দৈ।
ভাদরে তালের পিঠা,
আশ্বিনে শশা মিঠা,
কার্তিকে খৈলসার ঝোল,
অগ্রাণে ওল।
পৌষে কাঞ্ছি, মাঘে তেল,
ফাল্গুনে পাকা বেল।
চৈত্র সংক্রান্তিতে বিশেষ খাবার ছাতু, চিড়া, দই, মুড়ি, খই, তিল ও নারিকেলের নাড়ু ইত্যাদি খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছ। তার সাথে দুপুর বেলার খাবারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘চৌদ্দ’ রকমের শাক খাওয়া। এর মধ্যে অন্তত একটি তিতা স্বাদের হতে হবে। যেমন গিমা শাক। চৈত্র মাসে গিমা শাক খেতেই হবে। গ্রাম বাংলায় প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে -শাক শাক বারো শাক, পাতে দিলে জামাই রাগ।এখানে বারো শাক বলা হলেও সাধারণত এর চেয়ে বেশি পরিমান শাকও রান্না হয়।
শহুরে ফাস্টফুড অভ্যস্ত মানুষের কাছে অদ্ভুত মনে হবে এতো শাক পাওয়া যায় কিনা। চৈত্র সংক্রান্তিতে মেয়েরা ঘরের পাশে, রাস্তার ধারে, ক্ষেতের আইলে, অনাবাদি জায়গা থেকে শাক তুলতে বের হয়। লক্ষণীয় বিষয় হল আপাত অদরকারি শাক, লতাপাতা যদি বিলুপ্ত না হয়ে থাকে তবে বুঝতে হবে চারপাশের প্রকৃতি ঠিক আছে, অন্যথায় বুঝতে হবে বাস্তুসংস্থান ঠিক নেই। দ্বিতীয়ত হল শাক তোলার কথা বলা হয়। আমরা শাক কাটি এটি সচরাচর বলি না। এর একটা কারণ হতে পারে গাছটি উপড়ে ফেললে বা কেটে ফেললে প্রাণ বৈচিত্র নষ্ট হবে। কিন্তু যদি চারপাশের প্রাণ ঠিক থাকে তাহলে আগামী বর্ষে প্রবেশ শুভ, পহেলা বৈশাখ শুভ। তাই বুঝাই যাচ্ছে, চৈত্র সংক্রান্তি আসলে লোকজ জ্ঞানের পরিচয়। এখানে বাংলার জনগোষ্ঠির যাপিত জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গি হয়ে বিরাজ করে সংস্কৃতি।এমনকি বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর কাছে এটি একধরনের লোকজ চিকিতসা ব্যাবস্থা। তাঁদের জীবনাচরণের বিশ্বাস ঋতু পরিবর্তনের এই সময় বিভিন্ন শাক-সবজি দিয়ে রান্না পাঁচন খেলে পরবর্তী বছরে রোগ-ব্যাধী কম হবে। দেখা যায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উৎসব বিঝুর দিনে বাড়ীতে টক, মিষ্টি, পাঁচন রান্না করা হয়। এটা আর কিছু নয় এই বিশ্বাস থেকেই যে বছরের শেষ দিন তিতা, মিঠা খেয়ে বছর বিদায় দিলে বিগত বছরের দুঃখ কষ্ট, আনন্দ বেদনা দূর হয়ে যাবে। শুধু তাই নয় সমতলের মতই তারাও দলবেঁধে গরয়া নৃত্য করে ঘুরে বেড়ায় ও গরয়া দেবতার পুজো দেয়। এই পুজোও আসলে সেই কৃষি বা খাদ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়ার সাথেই সম্পৃক্ত।
মারভিন হ্যারিস ভারতে গোহত্যা না করার পেছনে ধর্মকে নয় বরং বেঁচে থাকার কৌশলকেই দায়ী করেছেন।এখানেও বিশ্বাস কারায়া গরয়া বনের হিংস্র পশুদের নিয়ন্ত্রণকারী দেবতা তবে তারচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আগামী বছরে জুমচাষ ও খাদ্য সংগ্রহের সময় বনে জঙ্গলে গেলে হিংস্র পশুদের আক্রমণ হতে রক্ষা পাওয়া যাবে। তবে আমরা দেখেছি পাহাড়ে রিজার্ভ ফরেস্ট এর নামে, কৃত্রিম বনায়ন করে, জমিতে প্রাণবিনাশী সার-কীটনাশক ব্যাবহার করে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছি দেশীয় শাক-সবজি, নষ্ট করছি প্রকৃতির স্বতস্ফূর্ততা, পাল্টে যাচ্ছে বাস্তু সংস্থান। ভূমিকেন্দ্রিক সংস্কৃতির এই দেশে শুধু জমিতে উর্বরতা নয়, ঘরেও যাতে উর্বরতা আসে সেজন্য চড়কের গাছটিকে পোঁতা হয় পুরুষাঙ্গের ন্যায় এবং যেদিন পুকুর থেকে উঠানো হয় সেদিন যেসব নারীদের সন্তান হয় না তাদের ওই পুকুরে গোসল করানো হয় সন্তান লাভের প্রত্যাশায়।
শত শত বছর ধরে এদেশের মানুষের এইযে প্রত্যাশা সেখানে অর্থনীতির একটি বিশাল যোগসূত্র রয়েছে। অর্থনীতির হিসাবে বলতে গেলে, একটি চক্রাকার হিসাবে সকল পর্যায়ে ধর্ম-বর্ণ, গোত্রের ও শ্রেণী-পেশার মানুষ এর সাথে সম্পৃক্ত। তবে নগর সংস্কৃতির ডামাডোলে চৈত্র সংক্রান্তিকে সর্বজনীন মিলনমেলায় পরিণত করতে যেয়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতির করাল গ্রাসে আবহমান গ্রামবাংলার চাষীর যে আনন্দঘন উৎসব আর জীবনাচরণের সাথে মিশে থাকা বিশ্বাস কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। তবে নীলকণ্ঠ শিব যেমন জগতের সব বিষ পান করেও মঙ্গলময় । ঠিক তেমনিভাবে এই উৎসব আপামর বাঙালির জন্য কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে এমনটিই বিশ্বাস। আলোচনায় এটা খুব স্পষ্ট যে এটি বাংলার মানুষের শেকড়ের সাথে মিশে থাকা এক উৎসব। এরসাথে মিশে আছে জীবনদর্শন।
লেখক: প্রভাষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়