সূর্যবাদ

মধ্য আমেরিকায় ইন্টিপূজো

প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৫:৩৭

আতোয়ার রহমান

বাইরের সংস্কৃতির সাথে সমান্তরভাবে বিকশিত কেবল আজটেকদের সংস্কৃতিই হয়নি। দুই-একটি উদাহরণ আগেই দিয়েছি। সূর্যোপূজোর আলোচনায় এখানে আর একটি সংস্কৃতির উল্লেখ করবো। এই সংস্কৃতি মায়া জাতির। যাদের এলাকা ছিলো মোটামুটি হিসেবে বেশ বিস্তৃত। মায়া সম্রাজ্য গড়ে ওঠে বর্তমান গুয়াটেমালা, ইউকাটান, পশ্চিম হন্ডুরাস, আর পূর্ব-দক্ষিণ কেক্সিকো নিয়ে। এবং মায়া সভ্যতার চরম বিকাশ শুরু হয় খৃস্টপূর্ব প্রথম শতকের একেবারে শেষ দিকে। আর সে সভ্যতা টিকে ছিলো প্রায় এক হাজার বছর। তার ঘটে নাহুয়া ভাষাভাষী কতকগুলির উপজাতির উপদ্রবে এবং পরিশেষে স্পেনীয়দের অভিযানে, ষোড়শ শতকের দিকে।

মায়া সমাজে সূর্য
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানি, মায়া সমাজেও সূর্য ছিলেন অন্যতম প্রধান দেবতা এবং তাঁর পূজো ছিলো অত্যন্ত ব্যাপক। পালাঙ্কুয়ের (Palanque) এক দেবমন্দিরে তিনি প্রতিষ্ঠিত হন সূর্যমন্ডলের প্রতীকে এবং ঠিক তার নিচেই খোদাই করা তাঁর মানবাকার মূর্তিতে। 

প্রসঙ্গতঃ ইউকাটানের মায়া সমাজ (the Yucatec Maya) সূর্যপূজক হয়েও ছিলো সম্ভবতঃ একেশ্বরবাদী। এই সমাজে সূর্যদেবতা পূজো পেতেন হুনাব কু (Hunab Ku) নামে। এ নামের আক্ষরিক অর্থ এক ঈশ্বর। তিনি ছিলেন সৃষ্টিক্ষমতার অধিকারী দেবতা।

মায়া সমাজে সূর্যমন্দিরের পুরুতের পদ ছিলো বংশগত। লোকে সন্ত্রম ভরে তাঁকে বলতো আহকিন। যার অর্থ সূর্য্যি ঠাকুরের উনি (he of the Sun)।

আজ মায়া, টলটেক, আজটেকরা নেই। তাদের অন্য কোনো সূর্যপূজোক জাতি বা নরগোষ্ঠীর সাম্রাজ্যও। তার অর্থ অবশ্যি এই নয় যে, উপরি-উক্ত সভ্যতাগুলির পতনের সাথে সাথেই মধ্য বা উত্তর আমেরিকা থেকে সূর্যপূজো উঠে যায়। বরং খবর মেলে, ও-অঞ্চলে-বিশেষ করে, উত্তর আমেরিকায় কোনো কোনো আদিবাসী মহলে কিছু কাল আগেও সূর্য ছিলেন রীতিমতো জাগ্রত দেবতা। তখন, উদাহরণতঃ ন্যাচেজ উপজাতির লোকেরা তাঁর পূজো করেছে দারুণ ধূমধামের সাথে।

ইন্কা সূর্যদেব ইন্টি
উত্তর আমেরিকায় সূর্যপূজোর সূচনা কবে হয়েছিলো, আমরা সঠিক জানিনে। কিন্তু নির্ভুল প্রমাণ মেলে, দক্ষিণ আমেরিকায় সূর্যদেবতা পূজো পেয়েছেন টেয়োটিওয়াকান সভ্যতার অন্ততঃ এক হাজার বছর পরে। এই ভূখন্ডে তাঁর প্রধান পূজোক ছিলো ইন্কা জাতি। ইন্কা সভ্যতার বিকাশ ঘটে পেরুর উত্তর উপকূলে আর দক্ষিণের মালভূমি এলাকায়, চতুর্দশ শতকের আগে। এবং তা টিকে থাকে ষোড়শ শতকের কিছু পরও। ইন্কারাও ছিলো পশ্চিম গোলার্ধের আদিবাসী। এবং তাদের সভ্যতাও বিলুপ্ত হয় স্পেনীয় অভিযানের ফলে।

ইন্কা দেবলোকে পৃথিবীর স্রষ্টা রূপে পরিচিত ছিলেন ভিরুকোচা। কিন্তু প্রধান দেবতা হিসেবে পরিগনিত এবং অবশ্যই পূজিতও হয়েছেন সূর্য। ইন্কা সমাজে যাঁর নাম ছিলো ইন্টি তিনি স্পষ্টতঃই কৃষিজীবী সমাজের দেবতা। বলা হয়ে থাকে, তাঁরই তাপস্বরূপ অনুগ্রহে ফসল পেকেছে এবং আল্ডিস পর্বতমালা আর তার আশপাশের মাটি উচ্চতা লাভ করেছে। ইন্কাদের ধারণা ছিলো, সূর্যদেব ইন্টিই তাদের আদি পিতা। সেই ধারণা থেকে জনৈক ইন্কা সমাপ্ত তাঁকে উপাধি দেন ‘আমার পিতা’। 

ইন্টি বিশেষ কোনো আকারে বা মূর্তিতে ইন্কাদের সামনে কখনো আবির্ভুত হয়েছেন কিনা, আমাদের জানা নেই। কিন্তু ইন্কা সাম্রাজ্যের সব সূর্যমন্দিরেই তাঁর এক প্রতিরূপ দেখা যেতো। সেখানে তিনি আপন কিরণমালায় শোভিত মন্ডলের বুকে মানুষের মুখ-কেবল মুখ-নিয়ে আবির্ভুত। মন্দিরে মন্দিরে এই মুর্তিতে তিনি পূজিত হয়েছেন সাড়ম্বরে এবং সকল মহলে। কিন্তু যেহেতু তিনি কৃষির দেবতা, সূর্যদেব ইন্টি তাই সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন ইন্কা চাষী সমাজে। 

স্পেনীয় হামলার সময় ইন্কারা প্রাণপণে বাধা দেয়। ইউরোপীয় সভ্যতার মারণাস্ত্রের মোকাবেলায় সে-বাধায় অবশ্যি শেষ পর্যন্ত কোনো লাভ হয়নি। ইন্কারা প্রাণ হারিয়েছে হাজারে হাজারে। এবং তাদের কীর্তিগুলি হয়ে যায় চূর্ণ বিচূর্ণ। যেগুলি টিকে ছিলো, সেগুলির মধ্যে নামডাক সবচেয়ে বেশী কুজকোর মন্দিরের। তার কিছু ভগ্নাবশেষ আজও আছে। সম্পূর্ণতঃই পাথরে তৈরী এই মন্দিরটির পরিধি ছিলো বারো শত ফুটের উপর। আর একটি সূর্যমন্দিরের সন্ধান পাওয়া গেছে ভিলকাশুমান নামে একটি জায়গায়। ইন্কাদের মতে, এই জায়গাটি ছিলো নাকি ভৌগোলিক দিক থেকে পৃথিবীর কেন্দ্রভূমি। আল্তিস পর্বতমালার সবচেয়ে উঁচু শিখরগুলির অন্যতম আন্কোকাগুয়ার কাছে আবিস্কৃত হয়েছে এক অতি প্রাচীন সূর্যমন্দির। এখান থেকে প্রচারিত দৈববাণী ছিলো ইন্কাদের কাছে শিরোধার্য। মন্দিরটিতে তারা পরম ভক্তিভরে নিয়মিতভাবে বলিদান করেছে। টিটিকাকা হ্রদের বৃহত্তম দ্বীপগুলির অন্যতম টিটিকাকাতেও সূর্যদেব ইন্টির একটি মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়।

কিন্তু এ আর কয়টি? ইন্কা সম্রাজ্যে ইন্টিদেবের মন্দির তো ছিলো প্রায় যেখানে সেখানে। কোথাও ছোটো, কোথাও বড়ো। এদিকে, ইন্কারা যখন যেখানে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে, সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের পরমারাধ্য সূর্যদেব ইন্টির মন্দির।

ব্যক্তিগত জীবন ইন্টি
অনেক দেশের পুরাণেই দেখি, ব্যক্তিগত জীবনে সূর্যদেবতা সঙ্গীহীন। কিন্তু ইন্টি ছিলেন সংসারী দেবতা। তাঁর পত্নীর নাম মামা-কিলিয়া। আসলে তিনি চন্দ্রদেবী (Moon Mother) এই সংসারের বাইরে ভক্তমহলে সূর্যদেব ইন্টির সেবায় নিয়োজিত থাকতেন পুরুতেরা, নির্বাচিত রমণীদের সহযোগে। সব মন্দিরেই কর্তৃত্ব করেছেন পুরুতেরা। কিন্তু কুজকোর মন্দিরের পুরুত ছিলেন এই পুরুতকুলের প্রধান। সরকারিভাবে ভিলাক উমু নামে পরিচিত, উক্ত পুরুত ক্ষমতায় ইন্কারাজের সাথেও প্রতিদন্দ্বিতা করেছেন।

নির্বাচিতা রমণীরা অভিহিত হতেন আকলা কুনা নামে। তাঁরে ছিলেন উঁচুদরের পুরুত ঠাকরুন, মোহন্ত। পুরুত সমাজে কোনো নারী মোহন্তের উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়নি। ইন্কা সমাজ অবশ্যি আকলা কুনাদের এর থেকেও বড়ো সম্মান দিয়েছে। তাদের কাছে তাঁরা ছিলেন মহাপ্রভু সূর্যদেবের পন্তী। তাঁরা নির্বাচিত হতেন সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে।

জুন মাসে, যখন সূর্য আকাশে থাকে সবচেয়ে উঁচু জায়গায়, ইন্কাদের পেরুদেশে অনুষ্ঠিত হত এক বিরাট উৎসব, ইন্টিদেবের সম্মানে।

ইন্কা সমাজে ইন্টিপূজোর ব্যাপকতা আর আড়ম্বর দেখে মনে হয়, তাদের দেশে সূর্যবাদ ছিলো রাষ্ট্রের ধর্ম।

পড়ুন ‘সূর্যবাদ’ ১ম পর্ব ‘প্রণতোহস্মি দিবাকরম্’

পড়ুন ‘সূর্যবাদ’ ২য় পর্ব ‘ইউরোপে সূর্যপূজো’

পড়ুন ‘সূর্যবাদ’ ৩য় পর্ব ‘উত্তর আমেরিকার নরভুক সূর্যদেব’

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী
এই গ্রন্থের তথ্যাবলীর জন্যে কয়েকখানি সুপরিচিত বিশ্বকোষ তথা অল্পপরিচিত অভিধান ছাড়াও ব্যবহৃত গ্রন্থাবলীর মধ্যে বিশেষভাবে গ্রাহ্য-
১। পাকিস্তানের উপজাতি-পাকিস্তান পাবলিকেশানস, ১৯৬৩
২। পৃথিবীর ইতিহাসঃ প্রাচীন যুগ-ফিওদর কারাভকিন; প্রগতি প্রকাশন, মস্কোঃ ১৯৮০
৩। প্রতীচ্য পুরাণ-ফরহাদ খান; বাংলা একাডেমী, ঢাকা-১৯৮৪
৪। ব্রক্ষ্মাগুপুরাণ
৫। ভারতীয় দর্শন (প্রথম খন্ড)-দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়; ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাঃ লিঃ, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রীট, কলকাতা-১৯৬৫
৬। ভারতবর্ষীয় উপাসক-সম্প্রদায়-অক্ষয়কুমার দত্ত; করুণা প্রকাশণী সংস্করণ, কলকাতা-১৯৮৭
৭। Asian Culture-no. 31-The Asian Culture Centre for UNESCO Tokyo; Spring-1982.
৮। Aztecs of Mexico-G. C. Vaillant; Pelican Book-1965
৯। Egyptian Wall Paintings-Christiane Desrochec-Novlecourt; Collins, Milan, Italy-1962
১০। Four Thousand Years Ago-Geoffry Bibby; Penguin Books-1965
১১। Lost Cities and Vanished Civilization-Robert Silvelberg; Bantam Book, New York-1963
১২। Man Makes Himself-V. Gordon Childe ; Penguin Book-1962
১৩। The Ancient world-Bhagawat Saran Upadhyaya: The Institute of Asian studies, Hyderabad, India-1954
১৪। The Growth of Civilisation-W.J. Perry; Pelican Books-1937
১৫। The Origins of Oriental Civilisation-Walter A. Fairservis, jr:, The New English Library; London: 4th printing-1959
১৬। What Happened in History? Gordon Childe; Penguin book-1962.

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত