সূর্যবাদ

উত্তর আমেরিকার নরভুক সূর্যদেব

প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৭:২৯

আতোয়ার রহমান

আটলান্টিকের পূর্ব পারে সূর্যবাদ (sun-cult) যখন ক্রমপ্রসরমান, তখন তার পশ্চিম পারের হাল কি?

তেমন বিস্তারিত কোনো বিবরণ আমাদের হাতে নেই। কিন্তু বিভিন্ন গবেষক তথা পুরাতত্ত্ববিদ এ যাবৎ যা দেখেছেন, তা নির্ভুল প্রমাণ দেয়, সূর্যদেবের রাজ্যসীমা আটলান্টিকের পশ্চিম পারেও বিস্তীর্ণ জনপদে প্রসার লাভ করে। আজ থেকে অন্ততঃ তিন হাজার বছর আগেই। এবং কয়েকশো বছর আগেও, ইউরোপে যখন আধুনিক বিজ্ঞানজীবী সভ্যতার জন্মলগ্ন প্রায় আসন্ন, তখনও তিনি দোর্দন্ড প্রতাপে এক সুগঠিত এবং আমাদের কাছে বিচিত্র মানবসমাজে রাজত্ব করেছেন। এলাকাটি ছিলো আজটেক-অধ্যুষিত মেক্সিকো। ইউরোপীয় ‘সভ্যতা’-র ছায়াতলে আসবার আগে দেশটি শাসন করেছে এ-সহস্রকের প্রায়াংশে ওই আজটেকরাই। এবং নিদারুণভাবে ধর্মশাসিত অজাটেকদের অসংখ্যপ্রায় দেবদেবীতে কীর্ণ দেবলোকে প্রধান দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন কার্যতঃ সূর্যদেব।

কিন্তু মেক্সিকোতে এবং অবশ্যই উত্তর আমেরিকার অন্যত্রও সূর্যপূজো বিশেষ কোনো সমাজে অকস্মাৎ প্রচলিত হয়নি। সূর্যদেবের পূজোর জন্যে যে অনুকুল পরিবেশ থাকা প্রয়োজন, তা যখন যেখানে দেখা গেছে, তখনই এবং সেইখানেই তিনি নৈবেদ্য পেতে শুরু করেছেন। এমন ঘটনা তাই স্বাভাবিকভাবেই কোনো যায়গায় ঘটেছিলো আগে, কোনো যায়গায় বা পরে। আবার, দেবজনের এক সমাজ থেকে আর এক সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভও যে সম্ভব, তারও কিছু ইঙ্গিত আমরা ইউরোপীয় সূর্যপূজোর আলোচনাতেই পেয়েছি। আজটেক সমাজে সূর্যদেবের আবির্ভাব কিভাবে ঘটেছিলো, তা নিয়ে পন্ডিতকুল কিছু কম ভাবেননি। আমার আলোচনার সংক্ষিপ্ত পরিসরে তাঁরে ভাবনার বিবরণ আর আনবো না, শুধু বলবো, আজটেক –অধ্যুষিত এলাকায় তাদের শাসন প্রতিষ্ঠার আগেও সূর্যপূজোর ব্যাপক প্রচলন দেখা গেছে। যেমন, টেয়োটিওয়াকান (Teotihuacan) সংস্কৃতিতে।

টেয়োটিওয়াকান সূর্যদেব
একজন মেক্সিকোবিদ-জি.সি. ভেইলান্ট-নানা তথ্য ঘেঁটে উক্ত সংস্কৃতির কাল নির্ণয় করেছেন খৃষ্টপূর্ব ৬০০ সাল থেকে খৃস্টীয় ৯০০ সাল তক। পুরাতত্ত্ববিদেরা এর নাম দেন মধ্য মেক্সিকোর একটি প্রাচীন স্থানের নাম অনুসারে, যেটি ছিল উক্ত সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র। আশ্চর্য জটিলতায় আর স্থাপত্য কৌশলে এই নগরভুমিটির প্রতিটি অনুকনা ছিলো ধর্মাশ্রয়ী, যেখানে পরিকল্পিত অনুক্রমে গড়ে উঠেছিলো, একের পর এক, চন্দ্রদেব, কৃষি এবং সূর্যদেবের মন্দির। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড়ো জায়গা শেষোক্ত মন্দিরের। যেমন উচ্চতায়, তেমনি প্রশস্ততায়। তার কাছে টেয়োটিওয়াকানের আর সব ইমারত যেন খেলার বস্তু। পুরাতত্ত্ববিদদের জগতে ‘সূর্যদেবের পিরামিড’ নামে পরিচিত এই সূর্যমিন্দর ভিতে প্রসস্ত প্রায় সাতশো পুট, উঁচু দু’শো ফুটের ওপর। ভিত থেকে চূড়োয় পৌঁছতে হয় চারটি থাক পেরিয়ে। এমন যাঁর মন্দির, টেয়োটিওয়াকান নগর তথা তথা সংস্কৃতিতে তাঁর প্রতিপত্তি যে কেমন ছিলো, তা সহজেই অনুমেয়।

টেয়োটিওয়াকান সভ্যতার পর মেক্সিকোতে অভুত্থান ঘটে আর এক প্রবল সভ্যতার। তার কারিগর নাহুয়া ভাষাভাষী টলটেক জাতি, যারা নাকি আগে ছিলো টলান নামের এক বিশাল নগরের অধিবাসী। ইতিহাসে তারা পরিচিত তাদের সাম্রাজ্যের রাজধানী টুলা হিডালগোর নাম অনুসারে টুলার টলটেক বলে। এই টলটেকদের ধর্মও ছিলো সূর্যের দ্বারা শাসিত। টলটেক পুরান বলে, প্রাণীজগতের ইতিহাসে, চারটি (বা পাঁচটি) যুগে বিভক্ত। প্রতিটি যুগেরই তারা নাম দেয় সূর্য। প্রথম যুগের নাম জলের সূর্য (the Water sun)। এটি বিশ্বজগৎ সৃষ্টির কাল। পৃথিবী মানুষে অধ্যুষিত হয় তৃতীয় যুগে, যার নাম ছিলো বায়ু যুগ বা বায়ুর সূর্য (the Water sun)। 

আজটেক সূর্যপূজো
সূর্যশাসিত পুরাণ ছিলো আজটেকদেরও, যদি ঠিক গোড়া থেকে নয়। মেক্সিকোতে আজটেক সাম্রাজ্যের কাল ধরা হয়, আনুমানিক হিসেবে, দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি তক। সূর্য নামের যুগধারণা তারা গ্রহণ করে সম্ভবতঃ টলটেক পুরাণ থেকে। আজটেকদেরও পুরাণেও যুগ বা সূর্য চার-পাঁচটি।

কিন্তু এসব তথ্য বা অনুমান যেন এমন ধারণা না দেয় যে, আজটেকদের ধর্ম ছিলো সরল বা অমৌলিক, যেমনটি পরিগৃহীত ধর্মের হওয়ার কথা। বস্তুতঃ আজটেক সমাজে ধর্মের মূলোৎপত্তির যে কাহিনী মেলে, সমগ্র মানবসমাজেই ধর্মের মূলোৎপত্তির কাহিনী তা-ই। যদিও বিভিন্ন কালে এবং পর্যায়ে বিভিন্ন ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত, এই লৌকিক ধর্মটির মূল পরিচয়, মানববিজ্ঞানী জি.সি ভেইলান্টের (G.C. Vaillant) ভাষায়-

Aztec religion, in purpose and practice, tried to attract those natural forces which are favourable to human existence and repulse those which are harmful…… 

The Aztecs and their forbeer believed the the forces of nature acted for good or evil very much as dose mankind, so that it was logical for them to personalize the elements as gods or goddesses….

Aztec religion was an outgrowth of the recognition and fear of natural forces and the attempt to constrain them.

প্রসঙ্গতঃ এই লেখক আজটেক ধর্ম সম্পর্কে আরো মন্তব্য করেছেন-এতে ‘the very essence of fear was honoured and worshipped’

এসব নিয়ে আলোচনা করবার স্থান এখানে নেই। এইমাত্র উদ্ধত কথাটি এবং উপরের উদ্ধতির শেষ উক্তিটির প্রসঙ্গে কেবল জানিয়ে রাখি, পরবর্তী আমরা দেখতে পাবো, ভয়ই যাদের ধর্মের উৎসমূল, তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানও ছিলো অনেক ক্ষেত্রে ভয়াবহ।
বস্তুতঃ সেগুলির বীভৎসতা আর নিষ্ঠুরতা সভ্য মানুষের কল্পনার অতীত।

আজটেক পুরাণে সূর্য
আগেই বলেছি, আজটেক পুরাণে পৃথিবী চারটি বা পাঁচটি যুগ তথ্য সূর্যে বিভক্ত। আজটেক সাম্রাজ্যের রাজধানী টেনচটিট্লানে (Tenchtitlan) প্রাপ্ত এক বিশাল পঞ্জিকাশিলা (ca’endar stone) থেকে জানা যায়, প্রথম যুগে আজকেদের দেবতা ছিলেন টেজকাটলিপোকা (Tezcatlipoca)। কালক্রমে তিনি সূর্যের রূপ পরিগ্রহণ করেন। শেষ তথা বর্তমান যুগ-যার সরকারী নাম ভূকম্প চতুষ্টয় (Four Earthquakes) সম্পূর্ণতঃই সূর্যদেবের দ্বারা শাসিত। তবে, আজটেক পূরাণে আদি দেবতা হলেন দুই পৃথিবী দেবীর অন্যতমা, বসন্তের দেবী কোটলিকুয়ের (Coatlique) পুত্র উইটজিলোপোচটলি (Huitailocpohotli)। আজটেক দেবলোকে দুই দেবতার প্রথম আবির্ভাব ঘটে, সন্দেহ নেই, প্রতিবেশী কোনো সমাজের ধর্মের প্রভাবে, টুলার টলটেক আমলের শেষ দিকে। এবং আজটেক আমলে প্রথমজন ছিলেন রাজধানী নগরীর প্রধান দেবতা, দ্বিতীয়জন টেশকোকো (Texcoco) নগরের। আজটেক শক্তির সার্বিক অভ্যুত্থানের আগে, চতুর্দশ শতকের দিকে, টেশকোকো পরিগনিত হয় মেক্সিকোর হ্রদমালার পূর্বতীরের সবচেয়ে সভ্য নগর রূপে।

টেজকাটলিপোকা
টেজকাটলিপোকা এক কালে মাঝে মাঝে আবির্ভূত হতেন টলটেক দেবতা কেটজালকোটলের (Quetzlcoati) বৈরী বা প্রতিদ্বন্দ্বী দেবতা হিসেবে। এর অর্থ, তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করেন টলটেক-আজটেক নরগোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে আজটেকদের জয়লাভের ফলে। আজটেক সমাজে তাঁর পূজোর প্রচলন ছিলো ব্যাপক। তাঁর ক্ষমতাবলীর অংশভাগী দেবলোকের বড়ো দেবতাদের মধ্যে দেখা গেছে অনেক। এদিকে, আজটেক পুঁথিপত্রের সাক্ষ্য, তিনি ছিলেন বহুরূপগ্রাহী। এবং একখানি পূঁথি বলে, তিনি চার বর্ণে চার দিকের অধিপতি। আজটেক এলাকার বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর দেবতারা এক সময় তাঁর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। তাঁদের অঙ্গে তখন দেখা যায় টেজকাটলিপোকার বেশভূষা, চরিত্রে তাঁর গুণাবলী।

এখানে উল্লেখ্য, সংখ্যাহীনপ্রায় নরগোষ্ঠীর বা উপজাতীয় দেবতাদের কথা বাদ দিই, এমনিতেই আজটেক দেবলোক ছিলো জনাকীর্ণ। অধিকন্তু, সেখানকার দেবদেবীরা নানা শ্রেণীর, উর্বরতাবাদের দেবদেবী থেকে শুরু করে ভ্রমণ-এমনকি, প্রসবকালে মৃতা নারীদের দেবদেবী তক। (এমন দেবদেবীবৈচিত্র্য, চোখে পড়ে কেবল হিন্দুর দেবলোকে) আজটেকদের এই দেবলোকের প্রধান ছিলেন, সার্বিক ধর্মগত অর্থে, ট্লোকে নাহুয়াকুয়ে (Tloque Nohuaque)। তিনি সেখানে সার্বভৌম-এবং অবশ্যই সৃষ্টিক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু তিনি অব্যক্ত তথা অনির্বচনীয়। আর, তাঁর পূঁজো হত কেবল টেশকোকো শহরের এক মন্দিরে। তাঁর সঙ্গে দেবলোকে কর্তৃত্ব করেছেন, আরো অনেক দেবতার মতো, টোনাটিয়ু। তিনি ছিলেন সূর্যদেবতা।

সূর্যদেব টোনাটিয়ু
আজটেক ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানে এই টোনাটিয়ুর সম্পৃক্ততা ছিলো আর সব দেবতার থেকে বেশী। কেননা, তিনি দর্শনযোগ্য, মানুষকে দেখা দেন প্রতিদিন। এবং প্রাণীসকলের অস্তিত্ব রক্ষায় তাঁর ভূমিকার গুরুত্ব অপরিসীম। সন্দেহ নেই, এসব কারণেই আজটেক সমাজে টোনাটিয়ুর ব্যাপক পূজো হয়ে উঠেছিলো অনিবার্য,- বস্তুতঃ আজটেকদের মধ্যে সূর্যদেবতা হিসেবে তার পূজোই হয়েছে সবচেয়ে ব্যাপকভাবে। ওদিকে, ইউটজিলোপোচটলি আর টেজকাটলিপোকার সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিলো ঘনিষ্ঠ।

এ-প্রসঙ্গে আর একটি কথা। এইমাত্র বলছিলাম, আজটেক মহলে আজটেক মহলে টোনাটিয়ুর পূজোই হয়েছে সবচেয়ে ব্যাপকভাবে। হ্যাঁ। এবং অবশ্যই সবচেয়ে আড়ম্বর সহকারে আর ভয়াবহরূপেও।

নরবলি
টোনাটিয়ুর পূজোর এক অপরিহার্য-এবং সবচেয়ে বড়ো-অঙ্গ ছিলো নরবলি। আজটেকরা সময়ে অসময়ে যুদ্ধযাত্রা করতো প্রধানতঃ এর জন্যে বন্দী সংগ্রহের ‘সাধু’ উদ্দেশ্য নিয়ে। তাদের সূর্যপূজোর বলির পাত্র ছিল যুদ্ধের বন্দী। এবং এই বন্দীরা তাদের সমাজে পেতো ‘লোভনীয়’ সামাজিক মর্যাদা। আজটেকদের পাপ-পুণ্যের বিচারের জন্যে কোনো পরলোক বা ‘শেষ বিচারের দিন’ ছিলো না, সেসবের ফলভোগের জন্যে স্বর্গ-নরক থাকা তো দুর কি বাত। কিন্তু সূর্যদেব টোনাটিয়ুর উদ্দেশে বলির প্রয়োজনে নির্বাচিত বন্দীরা মৃত্যুর পর স্থান পেতো যোদ্ধৃকুলের জন্যে নিদ্রিষ্ট এক বিশেষ ‘স্বর্গধাম’-এ। আর, সেটি ছিলো বড়োই সম্মানের আর সৌভাগ্যের ব্যাপার।

বলির জন্যে নির্বাচিত বন্দীকে অবশ্যি আমাদের উপমহাদেশের পরিচিত প্রথা অনুযায়ী সরাসরি খাঁড়ার নীচে যেতে হয়নি। সে আত্মরক্ষার সুযোগও পেতো। আজটেকদের মূল অনুষ্ঠানের (অর্থাৎ বলিদানের) আগে তার হাতে তুলে দিয়েছে অস্ত্র, যদিও নকল এবং সে তার সাহায্যে লড়াইও করেছে। সেই লড়াইয়ে জয়ী হলে সে পেতো প্রচুর সম্মান। কিন্তু তেমন ঘটনা ঘটেছে কদাচিৎ। অধিকাংশ বন্দীর ভাগ্যেই জুটতো পরাজয়। আর, তারপর অবধারিত মৃত্যু। পরাজিত বন্দীকে কয়েকজনে মিলে তুলে নিয়ে যেতো বলির বেদীতে। সেখানে পুরুত ঠাকুর পাথরের এক অস্ত্র দিয়ে শাস্ত্রীয় প্রথায় ক্ষিপ্র হাতে তার বুক থেকে পেট অবধি চিরে ফেলেছেন আর তারপর অভ্যাসে নিপুন কৌশলে প্রায় চক্ষের পলকে তার হৃৎপিন্ডটি ছিঁড়ে এনেছেন। বলা নিস্প্রয়োজন, হৃৎপিন্ডটি সূর্যদেব টোনাটিয়ুর উদ্দেশে নিবেদিত হত।

টেজকালিপোকার পূজোয়ও এমনিভাবে নরবলি দানের প্রথা ছিলো। বলির জন্যে নির্বাচিত বন্দী যতো অভিজাত আর সম্ভ্রান্ত তথা সামাজিক মর্যাদার অধিকারী হত, বলির পাত্র হিসেবে মূল্য এবং সম্মান পেতো সে ততো বেশী। এর উপর ছিলো মৃত্যুর পর ‘যোদ্ধার স্বর্গে’ স্থান লাভের গৌরবের সুনিশ্চিত সম্ভাবনা। এবং ধর্মের নিগড়ে বাঁধা আজটেক সমাজে এই সম্মান মাঝে মাঝে আত্মরক্ষার লড়াইয়ে বিজয়ী বন্দীকেও প্রলুব্ধ করেছে।

একবার বন্দী হিসেবে বলির জন্যে নির্বাচিত হয়েছেন ট্রাশকালান উপজাতির প্রদান। নাম তাঁর ট্লাহুইকল (Tlahuicol)। মানুষটি ছিলেন মহাবল এবং দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। আজটেকদের সাথে যুদ্ধে তাঁর পরাজয় ঘটে যেন ঘটনাচক্রে। কিন্তু বলিদান অনুষ্ঠানের আগে আত্মরক্ষার লড়াইয়ে তিনি একা মতজন হয়ে লড়লেন শত্রুপক্ষের এক দল লোকের সাথে। এমনকি নকল অস্ত্রের আঘাতেই বেশ কয়েকজনের মানবলীলার আবসান ঘটিয়ে। তাঁর হাতে যখমও হল অনেকেই।

এরপর ট্লাহুইকলের মুক্তি পাওয়ার কথা। অন্ততঃ আজটেকদের ধর্মীয় আইন তাই বলে। তা-মুক্তি তিনি পেলেনও এবং সসম্মানেই। শর্তহীন ক্ষমার মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, তাঁকে আজটেকদের এক সেনাদলে বড়ো একটি পদ দানের প্রস্তাবও দেওয়া হল।

কিন্তু তখন ঘটে আরেক নাটকীয় ব্যাপার। তিনি কিছুতেই কিছু নিতে রাজী নন। তাঁর কাছে নাকি বড়ো কেবল, সবচেয়ে বড়ো-বলি হিসেবে মৃত্যুবরণের গৌরব। (অর্থাৎ তিনিও ছিলেন সূর্যদেবতার ভক্ত)। সুতরাং তিনি এবার নিজেকে তুলে দিলেন আজটেক রাজপুরুষদের হাতে, স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে এবং সানন্দে।

উত্তর আমেরিকায় আদিবাসী মহলে সূর্যদেবতার উদ্দেশে নরমাংস নিবেদনের প্রথা প্রচলিত ছিলো শ’দুয়েক বছর আগেও। এক উপজাতি সূর্যদেবের পূজো করেছে শিকারের প্রথম পশু, মাছ আর নরমাংস দিয়ে। এই নৈবেদ্যের নরমাংস ছিলো যুদ্ধে বন্দীকৃত মানুষের। উপজাতিটির সূর্যদেবের নাম আগ্রেসকুয়ী (Agreswe)।

বিভিন্ন সংস্কৃতির সংঘাত-সংমিশ্রণ
ভাবতে অবাক লাগে, এসব যখন চলছিলো, আমাদের সহস্রক তখন অনেক দুর অগ্রসর। সমাগত আধুনিক সভ্যতার পদধ্বনি এ-সময়ে অনেক তথাকথিত অনুন্নত দেশেও স্পষ্ট। অভিজাত ধর্মগুলি তো পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশী জায়গা জুড়ে বসেছে। এর মধ্যে উত্তর আমেরিকার আদিবাসী সমাজে-বিশেষতঃ আজটেক জনপদে-অমন নিষ্ঠুর ধর্ম কেমন করে পালিত হচ্ছিলো? হচ্ছিলো যে-ঐতিহাসিক কারনেই। বিভিন্ন সভ্যতা-সংস্কৃতির সংঘাতে সংমিশ্রণে যে নতুন দিগন্তের সন্ধান মেলে, উত্তর আমেরিকায় সূর্যবাদ-প্রভাবিত এলাকা আর সমাজগুলিতে আলোচিত কালেও তা অজ্ঞাতই থেকে গেছে।

না, একটু ভুল বলা হল। কিছু সংঘাত-সংমিশ্রণ অবশ্যই ঘটেছে। কিন্তু কেবল স্থানীয়ভাবে, সংশ্লিষ্ট এলাকার অভ্যান্তরীণ ব্যাপার হিসেবে। আজটেক সভ্যতা-এবং তার আগেকার সভ্যতাগুলিও ছিলো উপজাতীয় গোত্র, গোষ্ঠী ইত্যাদির সভ্যতা-সংস্কৃতি তথা লৌকিক ধর্মের বিকাশের ফল। এই বিকাশের কালে, ইঙ্গিত আমরা আগেই পেয়েছি, বিভিন্ন লৌকিক ধর্ম আত্মরক্ষার সংগ্রাম যেমন করে, তেমনি কিছু কিছু আপোষ-মীমাংসাও। কিন্তু বহিরাগত এবং উপজাতিনিরপেক্ষ কোনো সংস্কৃতির বা ধর্মের সম্মুখে তারা পড়েনি। পখন পড়ে, তখন তত দিনে রীতিমতো অবক্ষীয়মাণ আজটেকদের সম্মুখে দেখা দেয় চরম বিড়দ। বিশেষতঃ আধুনিক জ্ঞানবিদ্যা আর অস্ত্রশস্ত্রের অভাবে। পাঠকরা জানেন, ষোড়শশতকে জনমানবসহ। টিকে থাকে কেবল স্থাপত্য, ভাস্কর্য আর অন্যবিধ শিল্পকলার কিছু নিদর্শণ। এবং অবশ্যই লিখিত কিছু কথাও। যেগুলি আজটেক ধর্মের অনেক তথ্য আমাদের সামনে তুলে ধরে।
লেখক আতোয়ার রহমান এর বই ‘সূর্যবাদ’ থেকে নেওয়া

পড়ুন ‘সূর্যবাদ’ ১ম পর্ব ‘প্রণতোহস্মি দিবাকরম্’

পড়ুন ‘সূর্যবাদ’ ২য় পর্ব ‘ইউরোপে সূর্যপূজো’

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী
এই গ্রন্থের তথ্যাবলীর জন্যে কয়েকখানি সুপরিচিত বিশ্বকোষ তথা অল্পপরিচিত অভিধান ছাড়াও ব্যবহৃত গ্রন্থাবলীর মধ্যে বিশেষভাবে গ্রাহ্য-
১। পাকিস্তানের উপজাতি-পাকিস্তান পাবলিকেশানস, ১৯৬৩
২। পৃথিবীর ইতিহাসঃ প্রাচীন যুগ-ফিওদর কারাভকিন; প্রগতি প্রকাশন, মস্কোঃ ১৯৮০
৩। প্রতীচ্য পুরাণ-ফরহাদ খান; বাংলা একাডেমী, ঢাকা-১৯৮৪
৪। ব্রক্ষ্মাগুপুরাণ
৫। ভারতীয় দর্শন (প্রথম খন্ড)-দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়; ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাঃ লিঃ, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রীট, কলকাতা-১৯৬৫
৬। ভারতবর্ষীয় উপাসক-সম্প্রদায়-অক্ষয়কুমার দত্ত; করুণা প্রকাশণী সংস্করণ, কলকাতা-১৯৮৭
৭। Asian Culture-no. 31-The Asian Culture Centre for UNESCO Tokyo; Spring-1982.
৮। Aztecs of Mexico-G. C. Vaillant; Pelican Book-1965
৯। Egyptian Wall Paintings-Christiane Desrochec-Novlecourt; Collins, Milan, Italy-1962
১০। Four Thousand Years Ago-Geoffry Bibby; Penguin Books-1965
১১। Lost Cities and Vanished Civilization-Robert Silvelberg; Bantam Book, New York-1963
১২। Man Makes Himself-V. Gordon Childe ; Penguin Book-1962
১৩। The Ancient world-Bhagawat Saran Upadhyaya: The Institute of Asian studies, Hyderabad, India-1954
১৪। The Growth of Civilisation-W.J. Perry; Pelican Books-1937
১৫। The Origins of Oriental Civilisation-Walter A. Fairservis, jr:, The New English Library; London: 4th printing-1959
১৬। What Happened in History? Gordon Childe; Penguin book-1962.

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত