অটিস্টিক শিশুর বিকাশে মায়ের ভুমিকা

প্রকাশ : ২০ নভেম্বর ২০১৬, ১৭:৩৬

ডা: জিল্লুর রহমান খান রতন

অটিজম বা অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার শিশুদের একটি স্নায়ুবিক-বিকাশজনিত সমস্যা (Neurodevelopmental Disorder) যা আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের তৈরি করা মানসিক রোগের শ্রেণিবিন্যাসের ভিত্তিতে রচিত। অটিজম উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেরও একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা। কোনো শিশুর অটিজমের যেকোনো লক্ষণ থাকলে তার অটিজমের সমস্যা আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।

লক্ষণসমূহ

মানুষ জন্মগতভাবে সামাজিক জীব। আমাদের একে অপরের সাথে দেখা হলে আমরা মুখে অথবা আকার ইঙ্গিতে কুশল বিনিময় করে থাকি যা শুরু হয় শিশুবয়সে। সাধারণত শিশুর জন্মের ৬ মাসের মধ্যে সে ইশারা, শব্দ করা এবং হাসি দেওয়া প্রভৃতি সংকেতে সাড়া দেয়। কিন্তু অটিস্টিক শিশুদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি অনুপস্থিত থাকে।

এ ধরনের শিশুরা একা থাকতে পছন্দ করে, অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলতে আগ্রহী নয়। কাছে ডাকলে ও আদর করলে আসতে চায় না, বরং বিরক্তি প্রকাশ করে। তারা সাধারণত সরাসরি তাকানো এড়িয়ে চলে।

কারো সাথে কথা বলা অথবা ইশারার মাধ্যমে সংযোগ স্থাপনের সমস্যা অটিজমের আরেকটি বৈশিষ্ট্য (Verbal & Non-verbal Communication)। যারা অল্পবিস্তর কথা বলতে পারে সেটিও অনেক ক্ষেত্রে অর্থহীন কথাবার্তা বলে মনে হয়। আবার দেখা যায় ২ বছর বয়সে গিয়ে পূর্বে অল্পবিস্তর কিছু শব্দ বলতে পারত তা আর বলতে পারে না।

অটিস্টিক শিশুদের সীমিত বিষয়ের প্রতি আগ্রহ যেমন : একই ধরনের পরিবেশ, খাবার, খেলনা, রং, পোশাক, বিছানা প্রভৃতির প্রতি আগ্রহ লক্ষ করা যায়। এর ব্যতিক্রম ঘটলেই তারা অস্থিরতা ও বিরক্তি প্রকাশ করে। বিভিন্ন ধরনের অর্থহীন অঙ্গভঙ্গি অটিজমের একটি বৈশিষ্ট্য।

এ লক্ষণসমূহ সাধারণত একবছরের মধ্যেই প্রকাশিত হয়। তবে পূর্ণাঙ্গ লক্ষণসমূহ প্রকাশ পেতে অনেক সময় ৩-৫ বছর অথবা তারও বেশি সময় লেগে যেতে পারে।

অটিজমের প্রকোপ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৬৮ জন শিশুর ১ জন অটিজমে আক্রান্ত যা বর্তমানে মহামারি পর্যায়ের। বাংলাদেশে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ঢাকা বিভাগে পরিচালিত (২০০৯) এক জরিপে দেখা যায়, এ দেশে প্রতি ১০০ শিশুর প্রায় ১ জনের অটিজমের সমস্যা রয়েছে যা উন্নত দেশগুলির কাছাকাছি। ছেলেদের অটিজম হওয়ার ঝুঁকি মেয়েদের চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি।

অটিজমের কারণ

বর্তমান বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এখন পর্যন্ত অটিজমের সুনির্দিষ্ট কারণ আবিষ্কৃত হয়নি। তবে বংশগতি ও জন্মগত কারণ, প্রতিকূল পরিবেশ, মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক গঠন ও ভ্যাকসিন (MMR Vaccine) প্রভৃতি কারণসমূহ অটিজম হবার ঝুঁকি বাড়ায়। শিশুকে পর্যাপ্ত সময় না দেওয়া বা শিশু পরিচর্যার ধরনের কারণে অটিজম হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে মায়েরা অপরাধবোধে ভোগেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এ বিষয়ে তথ্য-প্রমাণাদি নেই। এ জন্য অপরাধবোধে ভোগার কোনো অবকাশ নেই।

অটিজম নির্ণয় ও চিকিৎসা

দ্রুত অটিজম নির্ণয় করে ব্যবস্থা নিলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অটিস্টিক শিশুর কর্মক্ষমতা অনেকাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, ও অটিজম এক্সপার্টের সহায়তায় অটিজম নিরূপণ করা যায়। চিকিৎসার শুরুতে অবশ্যই শিশুর শারীরিক, মানসিক, ভাষাগত দক্ষতাসহ বিকাশের ক্রমপর্যায় সঠিকভাবে নিরূপণ করতে হবে। দুই-তৃতীয়াংশ অটিস্টিক শিশুর বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা থাকে যার চিকিৎসা ব্যতীত শিক্ষামূলক, পুর্নবাসনমূলক ও বিকাশে সহায়ক অন্যান্য চিকিৎসা ফলপ্রসূ হয় না।

অটিজমের চিকিৎসা একটি দলগত প্রক্রিয়া

অটিজমে আক্রান্ত শিশুর কার্যকর চিকিৎসা একটি দলগত প্রক্রিয়া যেখানে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, শিশু বিশেষজ্ঞ ও মনোবিদসহ বিভিন্ন সহায়ক পেশাজীবীর সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। শিশুর অভিভাবক ও পরিচর্যাকারীর অটিজম বিষয়ে প্রশিক্ষণ জরুরি। এ ছাড়াও ফিজিওথেরাপি, স্পিচথেরাপি, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।

অটিজমে আক্রান্ত শিশুর শারীরিক ও মানসিক রোগের চিকিৎসা

অটিস্টিক শিশুদের প্রায় ২৫-৪০ শতাংশ জনের খিঁচুনির সমস্যা দেখা যায় যেটি সাধারণত কৈশোর বয়সে (১১-১৪ বছর) আরম্ভ হয়। এ ছাড়াও পেটের পীড়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, বমিভাব, ঘুমের সমস্যা, মাথাব্যথা, কানের সমস্যা ও মূত্রনালীর সংক্রমণ হতে পারে। চিকিৎসা সহায়তায় ও সাধারণ পরামর্শের মাধ্যমে এগুলি দূর করা সম্ভব। অটিস্টিক শিশুর শতকরা ২৫ থেকে ৬০ ভাগের বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতার সমস্যা থাকতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ক্ষেত্রে অস্থিরতা ও অতি চঞ্চলতা  (Attention Deficit Hyperactivity Disorder), একই ধরনের আচরণ, বিষণ্নতা, উদ্বেগ, ভয় অন্যতম। এ সকল ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে ওষুধ প্রয়োগে ভালো ফল পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধরনের আচরণগত সমস্যা যেমন : সহিংস আচরণ, নিজের শরীরে আঘাত প্রভৃতি দেখা যায়। আচরণগত সমস্যা সমাধানে আচরণ পরিবর্তন পদ্ধতিসহ (Behavior Modification) বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারিক চিকিৎসা খুবই গুরুতপূর্ণ। এ ছাড়াও ফিজিওথেরাপি, স্পিচথেরাপি, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ জরুরি।

মায়েদের করণীয়  

মায়েদের অটিজম সর্ম্পকে স্বচ্ছ ধারণা থাকা ও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ জরুরি।
শিশুর ব্যক্তিগত দক্ষতা, যেমন পরিচ্ছন্নতা, খাওয়া, পোশাক পরিধান প্রভৃতি কাজ কিভাবে ধাপে ধাপে শিখানো যায় সে বিষয়ে জানতে হবে।

সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধাসমূহের ব্যাপারে খোঁজ-খবর জেনে তা ব্যবহার করতে হবে।

শিশুর সম্পত্তির অধিকার সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা গ্রহণ, শিশুরা যাতে পরিচিত ও অপরিচিতজনের দ্বারা হয়রানি, শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার না হয় সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে।

অটিস্টিক শিশুর ভেতর লুকিয়ে থাকা অপার সম্ভবনাগুলো খুঁজে বের করুন ও সেগুলো বিকাশে সহযোগিতা দিন। তাদের অর্জন ও ভালো কাজে উৎসাহ দিন ও তা উদযাপন করুন।

পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে নিন এতে পরিবারে সুস্থির পরিবেশ বিরাজ করবে।

অটিস্টিক শিশুর মা হিসেবে কখনোই লজ্জিত হবেন না। কারণ আপনি যদি বিষয়টি মন থেকে মেনে নিতে না পারেন তাহলে সেটি আপনার আচরণে প্রকাশ পাবে যা শিশুর বিকাশের জন্য ক্ষতিকর। এ ক্ষেত্রে চাপমুক্ত হওয়ার কৌশল অর্জন ও মানসিকভাবে মানিয়ে নেওয়ার কৌশল অর্জন প্রয়োজন হয়।

শিশু পরিচর্যার সাথে সাথে মায়ের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বজায় রাখা দরকার। এ জন্য ব্যক্তিগত জীবন উপভোগ করুন, অন্যথায় একসময় শক্তি নিঃশেষিত হয়ে যাবে ও আপনি ভেঙে পড়বেন।

অনেক সময় অটিস্টিক শিশু ও তার ভাইবোনদের মধ্যে মানসিক চাপ ও বিষণ্নতা দেখা যায়। এ জন্য চিকিৎসক ও পরামর্শকের সহায়তা প্রয়োজন।

অটিস্টিক শিশু লোকসমাজে উপস্থাপন

অটিস্টিক শিশুরা অপরিচিত ও বাইরের পরিবেশে এলে অনেক সময় অস্থিরতা ও অপ্রত্যাশিত আচরণ করে থাকে। এ জন্য আগে থেকে আচরণের ন্যূনতম প্রত্যাশিত মাত্রা নির্ধারণ করতে হবে যেন সে কোনো ক্ষতিকর অচরণ থেকে বিরত থাকে। পূর্ব প্রস্তুতির অংশ হিসেবে জায়গার মানচিত্র, ছবি বা ভিডিওচিত্র প্রদর্শন অনেকাংশে ফলপ্রসূ। এ ছাড়াও এসব পরিস্থিতিতে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ কৌশল অর্জন গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায় এটি শিশুর মনোজগতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ফেলবে।

শিক্ষামূলক কর্মসূচি

সরকারি পর্যায়ে অটিস্টিক শিশুদের জন্য বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকলেও বিদ্যামান প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্র, মিরপুর, ঢাকা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম ও জেলা পর্যায়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিচালিত স্কুল ও বেসরকারি সংস্থাসমূহের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে এ সেবা পাওয়া সম্ভব।

চিকিৎসা সহায়তা কোথায় পাবেন

সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিদ্যমান বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্র হতে অটিস্টিক শিশুদের বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা পেতে পারেন। এদের মধ্যে শিশু বিকাশ ক্লিনিক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (সোম ও বুধবার), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর পেডিয়াট্রিক নিউরোডিসঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (IPNA), মানসিক রোগ ও শিশু বিভাগ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, শিশুমাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, মাতুয়াইল, ঢাকা এবং জাতীয় প্রতিবন্দ্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, মিরপুর, ঢাকা এর অটিজম রিসোর্স সেন্টার অন্যতম। এ ছাড়াও সরকারি ও আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজসমূহের মানসিক রোগ বিভাগ ও শিশুরোগ বিভাগ হতে এ সেবা পাওয়া যাবে।

অটিজম বিষয়ে সচেতনতা

ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে অটিজম বিষয়ক সচেতনতা তৈরি অটিস্টিক শিশুর বেড়া ওঠায় গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ জন্য ইলেক্ট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকা প্রয়োজন। জতিসংঘ বিশ্বব্যাপী অটিজম বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ২০০৮ সাল থেকে ২ এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালনের সূচনা করে। বর্তমান সরকার অটিস্টিক শিশুসহ সব ধরনের বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধী শিশুর অধিকার রক্ষায় সংবেদনশীল। অটিস্টিক শিশুর সুস্থ বিকাশ ও  সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে অটিজমবিষয়ক সচেতনতা তৈরি ও একসঙ্গে কাজ করা এখন সময়ের দাবি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত