ইয়োগা অনুশীলন: সর্তকতা ও করণীয়

প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০১৮, ১৪:১৪

এস. এম. শহীদুল হক ভূঁইয়া

যারা ইয়োগা চর্চা করছেন বা করবেন, তাদেরকে আসন আরম্ভ করার আগে কতগুলো বিষয় স্পষ্ট করে জানতে হবে। কতগুলো নিয়ম যেমন পালন করতে হবে তেমনি কতগুলো সর্তকতাও অবলম্বন করতে হবে। সে কারণে আসন আরম্ভ করার আগে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো খুব ভালোভাবে মনে রাখতে হবে।

১. পাঁচ বছর বয়স থেকে পঁচানব্বই, যেকোনো বয়সে আসন শুরু করা যেতে পারে। তবে বয়স ও শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী কার কোন আসন করা উচিত তা কোনো অভিজ্ঞ যোগশিক্ষকের কাছ থেকে জেনে নিলে ভালো হয়। পাঁচ থেকে দশ বছরের ছেলেমেয়েরা অর্ধমাত্রায় আসন করবে। পরবর্তীতে বয়স বাড়লে পূর্ণমাত্রায় করতে পারবে।

২. যারা কোনো শিক্ষক ছাড়া নিজে নিজে আসন করেন তারা খেয়াল রাখবেন আসন করে যদি কোনো উপসর্গ বেড়ে যায় বা নতুন কোনো উপসর্গ দেখা দেয় তাহলে আসন করা বন্ধ রেখে কোনো অভিজ্ঞ যোগশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে কিংবা যোগ চর্চাকেন্দ্রে গিয়ে আসন করবেন।

৩. যে আসনে আপনার শারীরিক কষ্ট দেখা দেয়, সে আসন করবেন না। আসনচর্চা বন্ধ না করে ওই শ্রেণির অন্য আসন করবেন।

৪. আসনের পূর্ণ ফল পেতে যম ও নিয়ম অভ্যাস করা দরকার। যম ও নিয়মের পোষকতা ছাড়া আসন অনেকটা মল্লক্রীড়ার মতো হয়ে পড়ে।

৫. যে কোনো আসন করার আগে ধ্যানাসন অভ্যাস করলে বেশি ফল পাওয়া যায়।

৬. যারা সুস্বাস্থ্যের জন্য আসন করবেন তারা অবশ্যই শৃঙ্খলা, বিশ্বাস, ধৈর্য ও অধ্যবসায় মেনে চলবেন। আসনে সঙ্গে সঙ্গে ফল পাওয়া যায় না। অন্তত ছয়মাস থেকে একবছর নিয়মিত আসন করলে ঈপ্সিত ফল লাভ করা যায়।

৭. আসন করার আগে মলমূত্র ত্যাগ করে নেবেন। নাক আর গলা পরিষ্কার করে নেবেন। যারা কোষ্ঠবদ্ধতায় ভোগেন কিংবা আসনের আগে মলত্যাগের বেগ না আসে তারা পবনমুক্তাসন, সর্বাঙ্গাসন জাতীয় দু-একটি আসন করবেন। পরে কোষ্ঠ পরিষ্কার হলে অন্য আসন করবেন। কোষ্ঠবদ্ধ অবস্থায় কখনও কোনো কঠিন আসন করবেন না।

৮. আসন গোসলের আগে ও পরে করা যায়। তবে গোসলের আগে আসন করা সহজ। আসন করার অন্তত ১৫ মিনিট পরে গোসল করবেন।

৯. আসন খালি পেটে করাই ভালো, তবে ক্ষুধার্ত অবস্থায় নয়। ক্ষুধার্ত থাকলে অল্পকিছু খেয়ে নেয়া ভালো। যেমন এক কাপ দুধ বা একটা ফল কিংবা দুটো বিস্কুট, নিদেনপক্ষে এক গ্লাস পানি। পূর্ণ আহারের পরে আসন করবেন না। পূর্ণ আহারের পর অন্তত চারঘণ্টা পর আসন করতে পারেন। আসন করার আধঘন্টা পর যেমন ইচ্ছা খেতে পারেন। হজম শক্তি বাড়ানোর জন্য বজ্রাসন আর অনিদ্রা নিবারণের জন্য গোমুখাসন রাতে আহারের পর বিছানায় বসে করতে পারে। আহারের পর সুখাসন ও করতে পারেন।

১০. নিয়ম মেনে আসন যখন ইচ্ছা করা যায় তবে সকালে ও সন্ধ্যায় আসন করা ভালো। ভোরের চেয়ে সন্ধ্যায় অনেক সহজে শরীরের অঙ্গ-পতঙ্গ নাড়ানো যায়, তাই সন্ধ্যায় আসন করা সহজ। ভোরে আসন করলে দিনের কাজে শরীরে ও মনে বেশি শক্তি পাওয়া যায় আর সন্ধ্যায় আসন করলে দিনের ক্লান্তি ও অবসাদ দূর হয়। মোটকথা নিয়ম মেনে যার যখন সুবিধা তখন আসন করা যায়। কারো যদি রাতে আসন করা সুবিধা হয় তাহলে রাতেই করবেন।

১১. প্রতিদিন একই সময়ে আসন করা ভালো, কোনোদিন কোনো কারণে যদি অন্যথা হয় তাহলে সেদিন অন্য সময়ে করবেন।

১২. গরম কিংবা ঠান্ডার মধ্য থেকে এসেই আসন করবেন না। একটু বিশ্রাম নিয়ে করবেন। 

১৩. খোলা জায়গা কিংবা অবাধ আলো বাতাসের ব্যবস্থা আছে এমন স্থানে আসন করবেন।

১৪. খালি মেঝে কিংবা অসমান জায়গায় আসন করবেন না। খুব নরম বা খুব শক্ত কিছুর উপর আসন করবেন না।

১৫. আসন করার সময় পাখা চালাবেন না। বেশি গরম হলে আস্তে চালাবেন।

১৬. শরীরে রক্ত চলাচলে সুবিধা হয় এমন পোশাক পরে আসন করবেন।

১৭. আসন করার সময় মুখের পেশীতে, কানে ও চোখে যেন অযথা টান না পরে, শ্বাস-প্রশ্বাসও যেন বাধা না পায় খেয়াল রাখতে হবে।

১৮. প্রথম প্রথম আসন করার সময় চোখ খোলা রাখবেন। চোখ বন্ধ রাখলে দেহের গতিবিধি দেখতে পাবেন না। যখন নির্ভুলভাবে আসন করতে পারবেন তখন চোখ বন্ধ রেখেই করবেন। তখন চোখ বন্ধ রাখলে দেহের গতিবিধি ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন এবং শরীরের সঠিক টান অনুভব করতে পারবেন।

১৯. আসনের সময় কেবল আপনার শরীরেই সক্রিয় থাকবে, মস্তিষ্কও থাকবে অক্রিয়, কিন্তু সতর্ক এবং তৎপর। আপনি যদি মস্তিষ্ককে সক্রিয় রেখে আসন করেন তাহলে আপনার ভুল আপনি দেখতে পাবেন না, আসন শুদ্ধ হবে না।

২০. আসন করার সময় আপনার সমস্ত মন-প্রাণ আসনেই নিবদ্ধ থাকবে। কথা বলবেন না, মনে মনে আসন ছাড়া কিছু ভাববেন না।

২১. আসন করার সময় নাক দিয়ে শ্বাস নিবেন, মুখ দিয়ে কখনো নয়।

২২. বিভিন্ন আসনে শ্বাস-প্রশ্বাসের যে ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে তা মেনে চলবেন। মুদ্রা ও প্রাণায়াম ইত্যাদির ক্ষেত্রে যেখানে যেমন ভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে বলা হয়েছে তা মেনে চলবেন।

২৩. প্রত্যেকটি আসনের পর শবাসনে বিশ্রাম নেবেন। যতক্ষণ ধরে আসন করবেন ততক্ষণ ধরে শবাসন করবেন।

২৪. আসন প্রতিদিনই করবেন, কোনো অনিবার্য কারণ ছাড়া আসন বন্ধ করবেন না। প্রথম প্রথম হয়তো অসুবিধা হবে, বিরক্ত লাগবে কিন্তু প্রাত্যহিক কর্মের মতো অভ্যাস করে নিলে দেখবেন একদিন আসন বাদ দিতে ইচ্ছা করছে না। আসন করাকে নিত্যকর্মের অন্তর্ভুক্ত করে নেবেন।

২৫. সারাদিনে একবার আসন করলেই চলে। বিশেষ অবস্থা ছাড়া কোনো আসন দুবার করার প্রয়োজন হয় না।

২৬. প্রাণায়াম আসন করার আগেও করতে পারেন পরেও করতে পারেন। তবে দুটোর মাঝে বেশ কিছুটা শবাসন করে নেবেন। প্রাণায়াম পরে আসন করলে মাঝে অন্তত দশ মিনিট শবাসন করবেন। প্রানায়মের আগে আসন করলে মাঝে অন্তত পাঁচ মিনিট শবাসন করবেন।

২৭. প্রাণায়াম করার সময় চোখ বন্ধ রাখবেন। নইলে মন বিক্ষিপ্ত হবে, বাইরের নানা বস্তুতে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াবে। প্রাণায়ামে মনোসংযোগ একান্ত প্রয়োজন।

২৮. প্রাণায়াম করার সময় মস্তিষ্ক নিস্ক্রিয় রাখবেন, কিন্তু ততপর। তার মানে তখন অন্যকিছু চিন্তা করবেন না, কিন্তু সতর্ক থাকবেন ভুল হলে সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করতে পারবেন।

২৯. অন্তঃসত্ত্বা নারীগণ অভিজ্ঞ শিক্ষক ছাড়া আসন বা প্রাণায়াম করবেন না।

৩০. যারা দুর্বল, যাদের অল্পেই মাথা ঘোরে বা শরীরে অস্বস্তি হয় তারা প্রথমে অল্প করে আসন করবেন, তারপর ক্রমান্বয়ে বাড়াবেন। প্রাণায়াম পূর্ণমাত্রায় করতে পারবেন।

৩১. যাদের হাই ব্লাড-প্রেশার, হার্টের অসুখ, স্পন্ডিলোসিস, স্লিপড ডিস্ক অথবা চোখের বা কানের কোনো কঠিন অসুখ আছে তারা সামনে ঝোঁকা বা শরীর ওলট-পালট করা কোনো আসন করবেন না, যেমন পদহস্তাসন, পশ্চিমোত্তানাসন, সর্বাঙ্গাশসন, হলাসন, শীর্ষাসন, শশাঙ্গাসন ইত্যাদি করবেন না। যোগমুদ্রা, বিপরীত করণী মুদ্রা ইত্যাদিও করবেন না।

৩২. গ্যাস্ট্রিক আলসার, ডিউওডিন্যাল আলসার ও পেপ্টিক আলসারের রোগীরা পেটের ভিতরে সরাসরি চাপ পড়ে এমন কোনো আসন করবেন না, যেমন-ময়ূরাসন, জানুশিরাসন, পশ্চিমোত্তাসন ইত্যাদি, তারা যোগমুদ্রা, উড্ডীয়ান বন্ধ ইত্যাদি ও করবেন না।

৩৩. যক্ষা, প্লুরিসি, জন্ডিস ইত্যাদি কোনো রোগ থাকলে সম্পূর্ণ নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত কোনো আসন বা মুদ্রা করবেন না।

৩৪. বাতজনিত কোনো ব্যথা বা ফোলা থাকলে চিকিৎসকের পরার্মশ অনুযায়ী ঔষধ ও আনুষঙ্গিক চিকিৎসার সাহায্যে ব্যথা ও ফোলা কমিয়ে তারপর আসন করাই ভালো।

৩৫. যাদের বয়স চল্লিশের উপর এবং কোনোদিন খেলাধুলা বা ব্যায়াম ইত্যাদি করেননি তারা সামনে ঝুঁকতে হয় এমন কোনো কঠিন আসন প্রথমদিকে করবেন না।

৩৬. মেয়েরা মাসিকের সময় আসন করবেন না। তবে রক্তস্রাব যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয় তাহলে উপবিষ্ট কোনাসন, বদ্ধ কোনাসন, বীরাসন, জানুশিরাসন, পশ্চিমোত্তাসন ও উত্তানাসন করলে উপকার পাবেন। এই সময়ে কোনোভাবেই শীর্ষাসন জাতীয় আসন (যেখানে শরীর ওলটাতে হয়) করবেন না।

৩৭. গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস যেসব আসন দাঁড়িয়ে বা সামনে ঝুঁকে করতে হয় এবং যেসব আসনের কম অঙ্গ চালনার প্রয়োজন হয় সেসব আসন অনায়াসে করা যেতে পারে। গোটা গর্ভাবস্থায় দিনের যেকোনো সময় বদ্ধ কোনাসন ও উপবিস্ট-কোনাসন করা যেতে পারে । উজ্জায়ী আর নারীশোধন প্রাণায়াম বদ্ধ কোনাসনে করতে পারলে আরো ভালো।

৩৮. প্রসবের পর এক মাস কোনো আসনই করা উচিত নয়। একমাস পর সহজ আসন ও তিনমাস পর সকল আসন সহজভাবে করা যায়।

৩৯. অন্যান্য ব্যায়ামে যেমন, ক্ষয় পূরণের জন্য বিশেষ খাদ্যের প্রয়োজন হয় আসনে তা দরকার হয় না, যার যেমন ব্যবস্থা তেমনই খাবেন, তবে সুষম খাদ্যের প্রতি নজর দেয়া উচিত।

৪০. আসন করতে গিয়ে ভুল হলে কয়েকদিনের মধ্যেই শরীরে অস্বস্তি হবে। কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে। সেজন্য কোনো যোগশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে আসন করা ভালো।

৪১. আপনি যদি ঠিক আসন করেন তাহলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আপনার শরীর হালকা মনে হবে এবং মন এক অনির্বচণীয় আনন্দে ভরে উঠবে। আপনি বুঝতে পারবেন, আপনার শরীর ও মনের মধ্যে ভালো কিছু হচ্ছে।

৪২. সাধকের মতো নিয়মিত আসন করলে আপনার গোটা দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যাবে। আপনার আহার-বিহারে, চাল-চলনে, কথা-বার্তায় এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে একটা শুচিতা আসবে। নিজেকে আপনার অন্য মানুষ মনে হবে।

৪৩. আসন ভালোভাবে আয়ত্ত হলে একেবারে অনায়াসে এবং অতি স্বচ্ছন্দে তা করতে পারবেন। আপনার দেহভঙ্গি তখন রাজকীয় মর্যাদা প্রতিভাত হবে, স্বাভাবিক সৌষ্ঠবে প্রোজ্জ্বল হবে।

লেখক: আন্তর্জাতিক ইয়োগা প্রশিক্ষক ও বিচারক

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত